Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য কনসেপসিয়ন: সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে হারানো গুপ্তধনের খোঁজে

আজ থেকে প্রায় তিনশো আশি বছর আগের ঘটনা। ‘দ্য ন্যুয়েস্ত্রা সেনোরা দি লা কনসেপসিয়ন’ নামের এক স্প্যানিশ জাহাজ সে সময়ে আকার ও আয়তনের দিক থেকে অন্য সব জাহাজকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জাহাজটি দৈর্ঘ্যে ছিল প্রায় ১৫০ ফুট। প্রায় দুই হাজার টন মালামাল বহন করার ক্ষমতা ছিল জাহাজটির।

২০ সেপ্টেম্বর, ১৬৩৮ সালে জাহাজটি চারশোজন যাত্রীসহ ম্যানিলা থেকে মেক্সিকোর আকাপালকো বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। জাহাজের মধ্যে ছিল এক বিশাল মালপত্রের বহর। সেই মালপত্রের আর্থিক মূল্য কম করে হলেও এক কোটি ডলার হবে। সেই সময়ের স্পেনীয় মুদ্রার হিসেবে ৪০ লক্ষ পেসো। এসব মালপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রেশমের তৈরি কাপড়, সিরামিকের জিনিসপত্র, পোর্সেলিন, হাতির দাঁত এবং প্রচুর হিরে-জহরত ছাড়াও বিভিন্ন রকমের দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র।

মূলত ব্যবসা এবং বিভিন্ন স্থানে উপঢৌকন দেয়ার জন্য এই জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সমুদ্রে ডুবে থাকা এক প্রবাল পাহাড়ের দেওয়ালে ধাক্কা লেগে জাহাজটির বেশ বড় রকমের ক্ষতি হয়। এই ধাক্কা লাগার কিছু সময় পরেই জাহাজটির সলিল সমাধি ঘটে। এই দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল জনা পঞ্চাশেক মানুষ। প্রায় দশ মাস পরে তাদের ছয়জন স্পেনীয় নৌকোয় করে দেশে ফেরে।

স্প্যানিশ জাহাজ দ্য কনসেপসিয়ন; Image Source: guampedia.com

কিন্তু জাহাজটি ডুবে যাওয়ার পেছনে সেই সময়ের অনেকেই শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দায়ী করেন না, এর পেছনে রয়েছে অন্য এক ইতিহাস। সেই ইতিহাসে মিশে আছে মানুষের লোভ আর দুর্নীতি। শোনা যায়, কনসেপসিয়ন সমুদ্রযাত্রার শুরু থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। ম্যানিলার ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনোরকম সুসম্পর্ক ছিল না। প্রতিনিয়তই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগে থাকতো। একইসঙ্গে ছিল ম্যানিলার দুর্নীতিপরায়ণ গভর্নর করসুয়েরার দুর্ব্যবহার।

গভর্নর করসুয়েরা; Image Source: somatemps.me

মানুষ হিসেবেও তেমন ভাল ছিলেন না করসুয়েরা। সারাক্ষণ তার কর্মচারীদের সাথে বাজে ব্যবহার করতেন। গভর্নর হয়েও লুটপাট, ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন করসুয়েরা। জানা যায়, কনসেপসিয়নে থাকা বেশ কিছু দামী সোনা, হিরে, জহরত তিনি লুট করে তা অন্য একটি জাহাজে তুলে দিয়েছিলেন। এ মূল্যবান সামগ্রীগুলো উৎকোচ হিসেবে পাঠানো হচ্ছিল প্রাচ্যে। এছাড়াও আরেকটা কান্ড করেছিলেন করসুয়েরা। কনসেপসিয়ন জাহাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার ভাইপো ডন জুয়ান ফ্রান্সিসকোর ওপর।

বাইশ–চব্বিশ বছর বয়সের জুয়ানের নৌ সংক্রান্ত কাজে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বললেই চলে। ফলে জাহাজের অফিসাররা কেউ তাকে মানতে চাইলেন না। লেগে গেল অশান্তি আর ঝগড়াঝাটি। সবাই নিজেকে ক্যাপ্টেন বলে ভাবতে শুরু করলেন। জুয়ানের ক্ষমতা ছিল না সেই বিদ্রোহ দমন করার। জাহাজের মধ্যেই শুরু হয়ে গেলো পরস্পরের প্রতি দোষারোপ। জাহাজটা কীভাবে চলছে সেদিকে কারো নজর নেই।

দ্য কনসেপসিয়ন জাহাজের যাত্রাপথের মানচিত্র; Image Source: ancient-origins.net

এর মধ্যেই প্রকৃতি হয়ে উঠলো অশান্ত। বাতাসের বিপক্ষে জাহাজ চালাতে গিয়ে ভেঙে গেলো মাস্তুল। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জাহাজ পড়লো ঘোর সমুদ্রে। সমুদ্রের স্রোত আর ঝড়ো বাতাসে জাহাজ হয়ে পড়লো দিকভ্রান্ত। জুয়ানের পক্ষে এই বিপদে কোনো বাস্তব সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো যথেষ্ট জ্ঞানও ছিল না। হঠাৎই দিকভ্রান্ত হয়ে চলতে থাকা জাহাজটি ধাক্কা মারলো ডুবো পাহাড়ের দেওয়ালে। সমুদ্রের প্রচন্ড স্রোত, তীব্র ঝড়ো বাতাস আর প্রবাল পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা মুহূর্তের মধ্যেই টুকরো-টুকরো করে দিল জাহাজটাকে। এর আগেও স্পেনের অনেক বড় বড় জাহাজ এভাবেই ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে কনসেপসিয়নের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছিল মর্মান্তিক এক ঘটনা।

১৬৪৪ সালে গঠিত এক তদন্ত কমিটিতেও বিষয়গুলো উঠে আসে। ম্যানিলা থেকে একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দেয়া হয় যেখানে জাহাজটির দুর্ঘটনার জন্য গভর্নর করসুয়েরা ও জাহাজের ক্যাপ্টেন ডন জুয়ান ফ্রান্সিসকোকে দায়ী করা হয়। দুর্ঘটনার ত্রিশ বছর পর স্পেন সরকারের প্রেরিত এক বিশেষ দল কনসেপসিয়নের কিছু ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে বিভিন্ন ধাতুর তৈরি কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র ও বেশ কয়েকটা কামান এবং আট-দশটা নোঙর উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু তখনও কনসেপসিয়নের মূল অংশ এবং জাহাজের অধিকাংশ সম্পদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর ক্যাপ্টেনের অদক্ষতায় ডুবতে হয় দ্য কনসেপসিয়নকে; Image Source: BBC.com

এই ঘটনার প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পর ১৯৮৭ সালে উইলিয়াম ম্যার্থাস নামে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্পদ অনুসন্ধানকারী একজন গবেষক তার দলবল নিয়ে কনসেপসিয়ন জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করতে সক্ষম হন। ম্যার্থাস এই কাজে বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। এশিয়ান ইতিহাসের ছাত্র ম্যার্থাস ভিয়েতনামে উদ্ধারকারী অফিসার হিসেবে মার্কিন নৌবাহিনীতে কাজ করেছেন। নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতা এবং প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি জ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্বের প্রতি গভীর আগ্রহ তাকে কনসেপসিয়ন সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে। তিনি স্থির করেন, যেভাবেই হোক এই জাহাজটিকে সমুদ্রের অতল থেকে খুঁজে বের করতেই হবে।

ডুবে যাওয়া কনসেপসিয়ন জাহাজের গুপ্তধন নিয়ে রচিত বই; Image Source: iCollector.com

কনসেপসিয়ন উদ্ধারের পূর্বে জাহাজটি সম্পর্কে ম্যার্থাস টানা দু’বছর প্রচুর গবেষণা করেন। ঘুরে বেরিয়েছিলেন রোম, গুয়াম, মেক্সিকো, আমেরিকা এবং ম্যানিলায়। নানা তথ্য সংগ্রহের পর জনা তিরিশেক নাবিক এবং ঘনিষ্ট কয়েকজন ডুবুরিকে নিয়ে উদ্ধার কাজে নেমেছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালের ১০ মার্চ কনসেপসিয়ন আবিষ্কার করে তার দল। তাদের জাহাজটির নাম ছিল টেনজার    

কনসেপসিয়ন জাহাজে প্রাপ্ত হিরে-জহরত; Image Source: ns.gov.gu

ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজটির সন্ধান পেয়ে অভিভূত হয়ে যান ম্যার্থাস ও তার দল। এই জাহাজ থেকে পাওয়া গিয়েছিল বহু লক্ষ টাকার হিরে-জহরত ও মূল্যবান সব জিনিসপত্র। স্পেনের রাজা ওই জাহাজেই জাপানের সম্রাটকে পাঠাচ্ছিলেন বহু মূল্যবান উপঢৌকন। জাহাজটি থেকে পাওয়া গেছে ঝড়ে-জলে নষ্ট হওয়া বেশ কিছু কামানের গোলা এবং দেড়শোর বেশি কলসি। এসব কলসিতে পাওয়া গিয়েছে বিচিত্র ধাতু, সোরা, গন্ধক, নুন, কর্পুর, ভিনেগার এবং পানীয়। কিছু কিছু কলসিতে পানিও ছিল। আর পাওয়া গিয়েছে সুদূর প্রাচ্যের দুর্মূল্য হিরে-জহরতের বিরল সব নিদর্শন।

ধ্বংসপ্রাপ্ত কনসেপসিয়ন জাহাজ থেকে পাওয়া সেই সময়ের স্প্যানিশ মুদ্রা; Image Source: pinterest.com

ধ্বংসপ্রাপ্ত এই জাহাজ থেকে যেসব অলঙ্কার পাওয়া গেছে তা থেকে সে সময়ের স্পেনীয়দের সৌখিনতার ছাপ বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়। হিরে বসানো পোশাক, চুনি, হিরে, নিলার বড় বড় আংটি, একশো ষাট ফুট লম্বা সোনার হার, যেটি বত্রিশটি ছোট ছোট হারের সমন্বয়। পাওয়া গেছে সাড়ে বাইশ ক্যারেটের তেরশো সোনার অলঙ্কার। সোনার পুঁতি, সোনার ক্রুসিফিক্স, সোনা দিয়ে তৈরি তারের কারুকাজ, দামি পাথর বসানো সোনার ব্রোচ ইত্যাদি। এছাড়া কচ্ছপের খোল এবং হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনিও প্রচুর পাওয়া গিয়েছে। রত্ন, অলংকার ছাড়াও পাওয়া গেছে দামি পোর্সেলিনের পাত্র।

ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ থেকে প্রাপ্ত অলঙ্কার সামগ্রী; Image Source: ancient-origins.net

এসব নিদর্শন থেকে সপ্তদশ শতকের মানুষদের পোশাক-পরিচ্ছদ, রুচি, বিলাসিতার এক বর্ণাঢ্য ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায়। আর ম্যার্থাস ও তার দলের এই আবিষ্কারের মাধ্যমে  প্রশান্ত মহাসাগরের এক টুকরো ইতিহাসই যেন উঠে এসেছে। তিনি খুলে দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্বের এক নতুন দিগন্ত।

ফিচার ইমেজ- ancient-origins.net

Related Articles