এক রোহিঙ্গা স্কুলশিক্ষক এবং তার গণহত্যার ডায়েরি (৯ম পর্ব)

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একজন ফুতু। তার এবং তার পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে এসেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের Sarah A. Topol-এর The Schoolteacher and the Genocide শিরোনামের একটি সুদীর্ঘ আর্টিকেলে। আমাদের এই সিরিজটি সেই আর্টিকেলেরই অনুবাদ। এটি হচ্ছে সিরিজের নবম পর্ব

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে ফুতুকে নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি; Image Source: Twitter

ফুতুর সাথে আমার (মূল লেখক Sarah A. Topol-এর) দেখা হয়েছিল আগস্টের সেই হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরের এক বিকেলে, ক্যাম্পগুলোর পাশে অবস্থিত সবচেয়ে বড় লোহার ব্রিজটির পাশে। ব্রিজটি নির্মিত হয়েছিল জাপান সরকারের অনুদানে। সেখানে খোদাই করে লেখা ছিল, “জাপানের জনগণের পক্ষ থেকে”।

২০১৭ সালের গ্রীষ্মকালে বিশ্ববিবেককে কাঁপিয়ে দেওয়া সংবাদগুলো ছিল মানুষের দুর্দশাকে পুঁজি করে এক ধরনের অশ্লীল ব্যবসা। জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন মায়ানমারের সামরিক কমান্ডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু যারা রোহিঙ্গাদের দুর্দশার সংবাদ রাখছিল, তারা জানত আগস্টের সেই ঘটনাটি ছিল অবধারিত।

রোহিঙ্গারা এমন একটি দেশে দিনের পর দিন বাস করত, যে দেশের মানুষ তাদেরকে চায়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদেরকে ঋতু পরিবর্তনের মতো বারবার দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। এক বৃদ্ধের সাথে আমার দেখা হয়েছিল, যিনি এ পর্যন্ত চারবার শরণার্থী হয়েছেন। কীভাবে তিনি প্রতিবার ফিরে গিয়েছিলেন? কীভাবে তিনি প্রতিবার নতুন করে তার জীবন শুরু করতে পেরেছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে, এবার তার পরিণতি ভিন্ন কিছু হবে? কীভাবে মানুষ দিনের পর দিন ধার করা সময়ে বেঁচে থাকে?

দুনসে পাড়ায় কী ঘটেছিল সেটা বোঝার জন্য একজন অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে আমি দুই শয়েরও বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সে সময়ই আমি এই সম্প্রদায়ের সবচেয়ে জ্ঞানী সদস্য হিসেবে ফুতুর নাম জানতে পেরেছিলাম। অথচ তার বয়স তখন ত্রিশও পেরোয়নি। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তার নাম প্রকাশ না করার জন্য। যদি দুনসে পাড়ায় ফিরে যেতে হয়, তাহলে প্রতিশোধের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য তিনি তার শৈশবের ডাক নামটি আমাকে ব্যবহার করতে বলেছিলেন।

ফুতুর বলা কাহিনীগুলো খরস্রোতা জলধারার মতো বারবার হোঁচট খাচ্ছিল। প্রায়ই আমি যেসব ঘটনা জানতে চাইতাম, তিনি আরো কয়েক বছর আগের ঘটনা থেকে সেগুলোর বর্ণনা শুরু করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তিনি তার কাহিনী ব্যাখ্যা করে যেতেন। দিনের বেলা ফুতু কাজ করতেন, আর সন্ধ্যার পরে বিদেশিদের ক্যাম্পগুলোতে থাকার অনুমতি ছিল না। কাজেই আমরা সাক্ষাৎ করতাম তার কর্মস্থলে, তার বস্তিতে এবং তার পরিবারের সদস্যদের খুপরিতে। যখনই সুযোগ পেতাম, তার ব্যস্ততার মধ্যে থেকে আমরা কিছুটা সময় ছিনিয়ে নিয়ে কাজে লাগাতাম।

অন্য যাদের সাথে আমি কথা বলেছিলাম, তারা নিজেদের সম্প্রদায়কে বর্ণনা করতে গিয়ে ‘দুর্দশাগ্রস্ত,’ ‘করুণ’ এবং ‘হতভাগ্য’ শব্দগুলো ব্যবহার করত। কিন্তু ফুতু কখনো এভাবে কথা বলতেন না। তিনি মায়ানমারে বসবাস করতেন এই বিশ্বাসে যে, যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা করলে পরিবর্তন আনা সম্ভব। তার এই বিশ্বাস এই কারণে গড়ে উঠেনি যে, এ ব্যাপারে তার বিশাল কোনো পরিকল্পনা ছিল। যদিও এটা সত্য যে, তার আসলেই বিশাল কিছু করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তার এই বিশ্বাস মূলত গড়ে উঠেছিল এই কারণে যে, শেষপর্যন্ত এছাড়া তার অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির; Image Source: Adam Dean/New York Times

শরণার্থী শিবিরের জীবন ছিল একইসাথে মায়ানমারের জীবনের তুলনায় ভালো এবং খারাপ। তাদের গ্রামের মতো এখানে তাদেরকে সারাক্ষণ মৃত্যুর ভয় তাড়া করে ফেরে না, রাতের বেলা তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। কিন্তু তারা ক্যাম্পগুলোর বাইরে কোথাও যেতে পারে না, সীমানার বাইরে ভালো হাসপাতালে যেতেও তাদেরকে অনুমতি নিতে হয়। তাদের সম্প্রদায়ের বাইরের বাহিনীরা এখানে তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।

মায়ানমার এবং বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আলোচনা করছে। অনেক রোহিঙ্গা বলছে, তারা আনুষ্ঠানিক জাতিগত স্বীকৃতি ছাড়া ফিরে যাবে না। কিন্তু আলোচনার জন্য তাদের নির্বাচিত কোনো নেতা বা প্রতিনিধি নেই। ওদিকে আরসা ক্যাম্পগুলোতে তাদের উপস্থিতি জাহির করছে এবং যারা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের মৃত্যুদণ্ড অব্যাহত আছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে জানে এই জায়গাটিও কবে আবার রোহিঙ্গাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়!

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদেরকে সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেওয় না। ইউনিসেফ ‘চাইল্ড-ফ্রেন্ডলি স্পেসেস’ প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু শিশুরা সেখানে যায় মূলত খেলতে এবং ছবি আঁকতে, পড়াশোনা শিখতে না। দাতব্য সংস্থাগুলোও কিছু ‘শিক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করেছে, কিন্তু কোনো নির্ধারিত পাঠ্যক্রম ছাড়াই। সেগুলোর অকার্যকারিতা নিয়ে ফুতু প্রায়ই ঠাট্টা করেন।

কিছু প্রাইভেট টিউটরিং স্কুল আত্মপ্রকাশ করেছে। উদ্বাস্তু হিসেবে ফুতু যেরকম স্কুলে অংশ নিয়েছিলেন, অনেকটা সেরকম। কিন্তু সেগুলোতে কেবল প্রাথমিক গণিত এবং ভাষাই শেখানো হয়; ইতিহাস, বিজ্ঞান কিংবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অন্য কোনো বিষয় শেখানো হয় না। সেগুলোতে দিনে মাত্র এক ঘণ্টা ক্লাস চলে। পুরো একটি প্রজন্ম যেন কবরস্থানে বসবাস করছে। এখনও তারা বার্মিজ শিক্ষা ব্যবস্থাই অনুসরণ করছে, এই আশায় যে, একদিন তাদের পরিস্থিতি বদলে যাবে এবং তারা তাদের দেশে ফিরে যাবে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির; Image Source: Jon Warren

দিনের পর দিন ফুতু টিকেছিলেন, এবং বলা যায় তিনি উন্নতি করছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের হয়ে কাজ শুরু করেছিলেন এবং পদোন্নতি পেয়ে একটি এইড বিতরণ সাইটের পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি শিক্ষকতা বন্ধ করে দিয়েছেন, ডায়েরি লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।

এখনো মাঝে মাঝে তিনি তার মোবাইল ফোনে কিছু কিছু ঘটনার দিন-তারিখ লিখে রাখেন, যেমন রেড ক্রসের প্রতিনিধিদের একটি আন্তর্জাতিক কমিটির শরণার্থী শিবির পরিদর্শন, কিংবা পরিচিত কোনো শিশুর জন্ম, কিন্তু প্রতি রাতে তিনি যেভাবে ইতিহাসের মতো করে দিনপঞ্জি লিখে রাখতেন, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি আমাকে বলেছিলেন, এর কারণ ছিল ক্যাম্পের ভিড় এবং আর্দ্রতা। তার চিন্তাভাবনাগুলোকে গুছিয়ে আনার মতো পরিবেশ সেখানে ছিল না। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল, এর পেছনে কি অন্য কিছু আছে? তার এই জীবনে কি এমন কিছু আছে, যা তিনি লিপিবদ্ধ করতে চান না?

এ পর্যন্ত আমরা যতবার কথা বলেছি, ফুতু শুধু আমার কাছে একটা বিষয়ই জানতে চেয়েছেন: রোহিঙ্গাদের কী হবে বলে আমি মনে করি? আমি তাকে বলেছি, আমি জানি না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুনসে পাড়ায় ফিরে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কী ভাবছেন? তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি তার অধিকার নিয়ে ফিরে যাওয়ার বেশি আর কিছুই চান না। আরেকদিন তিনি জানালেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, স্বীকৃতি ছাড়া ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি বরং সমুদ্রে ডুবে মারা যাবেন।

আমি জানতে পেরেছিলাম, বার্মিজ সরকার দুনসে পাড়ার জমিতে একটি মডেল গ্রাম তৈরি করছে, যে গ্রামটিতে এখন পোড়া গাছের গুঁড়ি আর পরিত্যক্ত মাঠ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি যখন ফুতুকে সংবাদটা দিলাম, তিনি আমাকে জানালেন, তিনিও এটা শুনেছেন, কিন্তু বিশ্বাস করেননি। তাদেরকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেটা পরিপূর্ণভাবে দখল করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা তার কাছে অনেক বেশি অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিল।

৯ অক্টোবর এবং ২৫ আগস্টের ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘুরেফিরে ফুতুর মনে পড়ে। ঘুমাতে গেলে তিনি শুধু তার বাবাকেই স্বপ্নে দেখেন, যিনি কয়েক মাস আগে মারা গিয়েছিলেন। তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল শরণার্থী শিবিরের কবরস্থানে, যে দেশ থেকে তিনি এসেছিলেন, সেখান থেকে অনেক অনেক দূরে। “সবাইকে একদিন মারা যেতে হবে” ফুতু আমাকে বলেছিলেন। “আমাকেও মরতে হবে। আমি এটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু যে কষ্টের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি, সেটা আমি মেনে নিতে পারছি না। সেটা ভুল যাওয়ার জন্য আমি আমার মনকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছি।”

পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bangla language. It's a translation of the article "The Schoolteacher and the Genocide" by Sarah A. Topol, published in The New York Times Magazine.

Featured Image: New York Times

Related Articles

Exit mobile version