Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাইকেল রকফেলার: নরখাদকদের শিকার এক তরুণ

ঘটনার সূচনা ১৮ নভেম্বর ১৯৬১ সালে। আমেরিকান এক তরুণ সঙ্গীসহ পাপুয়া নিউগিনির দুর্গম একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। উদ্দেশ্য স্থানীয় এক ভয়ঙ্কর আদিবাসীগোষ্ঠীর মুখোমুখি হওয়া, যাদের কাছে এমন কিছু রয়েছে যেগুলো সভ্য সমাজের সামনে তুলে ধরলে সবাই চমকে যাবে। এই আদিবাসীদের মুখোমুখি আগেও একবার হয়েছিল মাইকেল! কিন্তু এবার তারা যখন নিউগিনির দক্ষিণ উপকূলে পৌঁছালো, উত্তাল সাগরের কারণে আর এগিয়ে যেতে পারছিল না। মাইকেল সিদ্ধান্ত নিল সে সাঁতরে ডাঙায় গিয়ে পোঁছাবে, কিন্তু সমুদ্রের সেই অংশটিতে ছিল ক্ষুধার্ত সব কুমিরের আবাস! সাগরের পানিতে নামার পর তার আর হদিস পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে একটি সার্চ টিম তাদের উদ্ধার করতে আসে। উদ্ধারকারীরা তার সঙ্গীকে উদ্ধার করে, কিন্তু মাইকেল রকফেলারের কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি।

কেন একজন ধনী পরিবারের সন্তান হঠাৎ বিশাল সম্পত্তির মায়াজাল থেকে বেরিয়ে অভিযাত্রিক হতে গেল, যেখানে সে পুরো জীবন আয়েস করে কাটাতে পারতো? সে কি কুমিরের পেটেই গিয়েছিল নাকি আদিবাসীদের খাদ্যে পরিণত হয়েছিল? সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আদিবাসীদের কাছেই বা কীভাবে পৌঁছালো সে? এসব নিয়েই আমরা জানব আজকের লেখায়।

মাইকেল রকফেলারের জন্ম ১৯৩৮ সালে আমেরিকার সেই সময়কার সবচেয়ে ধনী এক পরিবারে। তার বাবা ছিলেন নিউ ইয়র্কের তৎকালীন মেয়র নেলসন রকফেলার। পাঁচ সন্তানের ভেতর মাইকেল ছিল সবার ছোট। তার দাদা জন রকফেলার ছিলেন স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানীর কর্ণধার, যিনি আমেরিকানদের ভেতর সর্বপ্রথম বিলিয়নিয়ার।

রকফেলার পরিবার; Image Source: nypost.com

১৯৬০ সালে মাইকেল রকফেলার হার্ভার্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করে। তার বাবা চাইছিলেন সে যেন এবার দাদার বিশাল সাম্রাজ্য দেখাশোনায় মনোযোগ দেয়, কিন্তু রকফেলারের চিন্তা ভিন্ন। বংশের অন্যান্যদের তুলনায় কিছুটা শান্ত স্বভাবের মাইকেল ছিল সাহিত্য আর শিল্পমনা। স্যুট-টাই পরে রকিং চেয়ারের উপর বসে দোল খাওয়ার চেয়ে অ্যাডভেঞ্চারকেই বেছে নিল সে।

তার বাবা ছিলেন আর্টের বিশেষ ভক্ত, যার কারণে তিনি বিভিন্ন সভ্যতার দর্শনীয় বস্তু সংগ্রহ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় নিউ ইয়র্কে তিনি ‘প্রাইমেটিভ আর্টের’ আস্ত মিউজিয়াম খুলে বসেন এবং সেগুলো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। বিশেষ করে নাইজেরিয়া এবং মায়ান সভ্যতার নানা নিদর্শন সেখানে স্থান পেয়েছিল। বাবার শখ ছেলের কাছে সিরিয়াসনেস হয়ে ধরা দেয়!

মাইকেল রকফেলার চেয়েছিল তার বাবার সংগৃহীত জিনিসের বাইরে সম্পূর্ণ নতুন কিছু সংগ্রহ করা যেগুলো নিউ ইয়র্ক আগে কখনো দেখেনি, খুব সম্ভবত সভ্য জগতের কেউই না! রকফেলার বাবার মিউজিয়ামে বোর্ড মেম্বার হিসেবে জায়গা করে নেয়। তারপর হার্ভার্ডের পরিচিত এক নৃতাত্ত্বিক এবং ডাচ মিউজিয়ামের জাতিতত্ত্বের একজন এক্সপার্টসহ রওনা হয় সে। গন্তব্য নিউ গায়ানার একটি দ্বীপ। এখানে ‘অসমত‘ নামে একটি আদিবাসীগোষ্ঠীর বসবাস।

 অসমতদের সঙ্গে মাইকেল রকফেলার; Image Source: mirror.co.uk

বহুদিন ধরে এই দ্বীপে ডাচ কর্তৃপক্ষ এবং মিশনারীরা নিয়মিত যাতায়াত করছে। কিন্তু অসমতদের ভেতর অনেকেই কখনো সাদা চামড়ার মানুষ দেখেনি! অসমতরা মনে করতো, তাদের দ্বীপটি কোনো এক শক্তি ঘিরে রেখেছে, যেখান আসা কিংবা যেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়! তাই তারা যখন কোনো সাদা চামড়ার মানুষকে আসতে দেখলো, স্বভাবতই তাদেরকে অতিপ্রাকৃত প্রাণী হিসেবে ধরে নিল!

রকফেলার ও তার টিম অসমতদের বড় একটি সম্প্রদায় ‘অসজানেপ’দের পাড়ায় প্রবেশ করল। তারা এতটাই মুগ্ধ আর মোহাবিষ্ট হয়েছিল যে, স্থানীয়রা যে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে সেটা ভুলে গেল! সাদা চামড়ার প্রাণীগুলো তাদের কাছে এগিয়ে গেল এবং পরিচিত হওয়ার চেষ্টা চালালো। যদিও তারা আগন্তুকদের খুব একটা ভালো চোখে দেখছিল না! রকফেলার যখন তাদের ছবি তুলতে চাইলো, তারা তাতে আনন্দের সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল! কিন্তু তাদের ধর্মীয় কিংবা সামাজিক রীতি পালনের জায়গাগুলোতে মাইকেল ও তার টিমকে যেতে দেওয়া হলো না। কিন্তু এগুলোর জন্যই তারা এতদূর এসেছিল!

সেই সময়গুলোতে অসমতরা ছিল সভ্য জগতের নিয়ম-নীতি থেকে অনেক দূরে। নিজেদের উদ্ভট আইন আর গ্রামকেন্দ্রিক যুদ্ধগুলোই ছিল তাদের সময় কাটানোর একমাত্র উপায়! বিপক্ষ সৈনিকদের মাথা আলাদা করে ফেলত তারা এবং তাদের মাংস ঝলসে খেত! ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিগুলোতে যৌনতার মতো ব্যাপারগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তবে তাদের স্বকীয়তা মাইকেল ও তার টিমকে বিমোহিত করে ফেলেছিল। মাইকেল তার ডায়েরিতে লিখে,

আমি যতটুকু প্রত্যাশা করেছিলাম, এই জায়গাটি এবং এর মানুষগুলো তার চেয়েও বেশি কিছু।

রকফেলার ও তার সঙ্গীরা সেখান থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সেটা আরও বড় পরিসরে গবেষণা চালানোর জন্য, এদের সম্পর্কে আরও বেশি জানার তৃষ্ণা তাদের মাঝে পেয়ে বসেছিল। তার আড়ালে নিউ ইয়র্ককে ‘একেবারে ভিন্ন কিছু’ দেখানোর স্বপ্নটা মাইকেলের মনে তখনও ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

আদিবাসীদের ধর্মীয় জিনিসগুলো সভ্যজগতের নাগালের বাইরে; Image Source: netgeo.com

১৯৬১ সালে সে আবারও নিউ গায়ানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, এবার তার সঙ্গে ছিল সরকারি এক নৃতাত্ত্বিক রেনে ওয়াশিং। তারা যখন অসমতদের দ্বীপ থেকে মাত্র ১২ মাইল দূরে তখনই সমুদ্র হঠাৎ উত্তাল হয়ে ওঠে। তাদের নৌকাটি একটা জায়গায় আঁটকে পড়ে, তাছাড়া ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের অবস্থাও হয়ে পড়েছিল দেখার মতো! রেনেকে রেখে মাইকেল সাঁতরে সাগর পাড়ি দেওয়ার চিন্তা করে। রেনের সতর্কবাণী কানে না নিয়েই সে পানিতে ঝাঁপ দেয়। এরপর রেনে মাইকেলকে আর ভেসে উঠতে দেখেনি।

খবর পেয়ে ডাচ কর্তৃপক্ষ রেসকিউ টিম পাঠায়। আর নেলসন রকফেলার বিমান, হেলিকপ্টার আর জাহাজের ব্যবস্থা করেন পুত্রের খোঁজ পেতে। ডাচ কর্তৃপক্ষ পুরো এলাকা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও মাইকেল রকফেলারের কোনো চিহ্ন পেলো না। এভাবে বেশ কিছুদিন খোঁজার পর ডাচরা তাদের হাল ছেড়ে দেয়। তারপরও ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষীণ আশা থেকে নেলসন আরও কিছুদিন খোঁজ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তাতে রাজি হয়ে ডাচরা প্রায় ১০ দিন খোঁজার কার্যক্রম পরিচালনা করে। অবশেষে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।

এদিকে পত্রিকাগুলোর শিরোনামজুড়ে কেবল মাইকেল রকফেলারের মৃত্যু সংবাদ। তার মৃত্যু নিয়ে নানা গুজব ছড়াতে থাকে তারা। কেউ বলতে থাকে, কুমিরে খেয়েছে আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ঘরের সন্তানকে! আবার কারো মতে, সে এত প্রতিপত্তি আর বিলাসিতা থেকে আড়াল হতে সেখানে সন্ন্যাস জীবন শুরু করেছে! কিন্তু ডাচ কর্তৃপক্ষ এসব গুজবকে নাকচ করে দেয় এবং এটাকে স্রেফ মৃত্যু বলেই প্রচার করে তারা। সে যে যা-ই বলুক, সবার প্রশ্ন একটাই, কীভাবে জলজ্যান্ত একটা মানুষ চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো!

পত্রিকাগুলো রকফেলারকে নিয়ে সংবাদ ছাপে; Image Source: whaleoil.net.nz

২০১৪ সাল, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের রিপোর্টার কার্ল হফম্যান তার বই ‘Savage Harvest: A Tale of Cannibals, Colonialism and Michael Rockefeller’s Tragic Quest for Primitive Art‘- এ বলেন, রকফেলারকে অসমতরাই হত্যা করেছে।

প্রায় ৫০ বছর আগের একটি রহস্যাবৃত কেস সমাধা করতে কার্ল অসমতদের দ্বীপে আসেন। সেখানে কার্ল স্থানীয়দের কালচার আর জীবনধারা সম্পর্কে জেনে নেওয়ার আড়ালে মাইকেল রকফেলারের হত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। স্থানীয়রা ইতোমধ্যে অনেকটুকুই বদলেছে, সভ্যজগতের ছোঁয়া পেয়েছে। তাদের থেকে কার্ল জানতে পারেন, রকফেলারকে অসমতরাই হত্যা করেছে! এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বাস করা মিশনারীরাও তাকে যথেষ্ট তথ্যের যোগান দেয়।

রকফেলার গায়ানাতে আসারও ৩ বছর আগে ১৯৫৭ সালে ডাচরা এই দ্বীপে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তখন তারা মাত্র দ্বীপের দখল নিয়েছিল, সেই সময় স্থানীয় অসমতরা বিভিন্ন গ্রামে বিভক্ত ছিল এবং প্রায়ই নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। ডাচরা তাদের ভেতর যুদ্ধ বন্ধ করতে এসে নিজেরাই তাদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয় ভুল বোঝাবুঝির কারণে! এতে ডাচদের সঙ্গে উল্টো আসমতদের সংঘাত বেধে যায়। ডাচরা ফিরে যায় এবং এই হত্যাযজ্ঞের কথা ধামাচাপা দেয়।

ডাচরা অসমতদের আক্রমণ করে ভুলক্রমে; Image Source: listwand.com

সঙ্গী রেনেকে নৌকায় রেখে মাইকেল পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার পর সবাই যখন তাকে মৃত ভেবেছিল, সে পানিতে সাঁতরে দ্বীপের কাছাকাছি চলে আসে, তখন স্থানীয় আদিবাসীদের একটি দল নৌকায় চড়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে অসমতরা কুমির হিসেবে ধরে নেয়। পরে যখন সে একদম কাছে চলে যায়, নৌকায় থাকা লোকগুলো সাদা চামড়ার মানুষ দেখতে পেয়ে তাকে বন্দি করে। ডাচদের হত্যার কথা তখনো তারা ভুলতে পারেনি। যার কারণে রকফেলারকে শত্রু ভেবে অসমতদের এই দলটি তাকে হত্যা করে। হত্যার পর তার শরীর থেকে মাংস এবং মগজ আলাদা করে ফেলা হয় এবং সেগুলো তারা সামাজিক অনুষ্ঠানের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে! তার শরীরের অন্যান্য অংশও সংরক্ষণ করে তারা এবং সেগুলো দিয়ে মাছ ধরার যন্ত্র তৈরি করে! তাকে হত্যার পর অসমতদের এই দলটি সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করে, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রকফেলারের ছিন্ন-ভিন্ন দেহ!

ডাচদের এই নৃশংসতা অসমতদের মনে সাদা চামড়ার প্রতি ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল, যার বলি হতে হয়েছিল রকফেলারকে। এতগুলো বছর পর ডাচরা এটা নিয়ে আর তেমন কিছুই করতে পারেনি, কারণ ইতোমধ্যে গায়ানার বেশিরভাগ দ্বীপ ইন্দোনেশিয়ার হাতে চলে এসেছে। রকফেলারের পরিবার তাদের সন্তানকে হত্যার খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হয়, যে জিনিসটা কেউ পূর্বে চিন্তাতেও আনেনি। তখনকার পত্রিকাগুলোর গুজব ডাচরা কেন সিরিয়াসলি নিয়েছিল তার কারণ এখন স্পষ্ট সবার সামনে।

তবে অসমতদের কাছে রকফেলারের হত্যাকান্ডটি শুধুই এক প্রাকৃতিক শক্তির ভারসাম্য! ডাচরা তাদের মানুষগুলোকে হত্যা করে শক্তির ভারসাম্যের যে ক্ষতি করেছে, রকফেলারকে হত্যা করে তারা সেটা পুনরুদ্ধার করেছে! তাদের কাছে এটা ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচয়।

২০১১ সালে এই বিষয়ে হলিউডে নির্মিত হয় ‘দ্য সার্চ ফর মাইকেল রকফেলার’। এছাড়াও ক্যানিবালিজমের উপর ভিত্তি করে বেশ কিছু ডকুমেন্টারিও তৈরি হয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন সময়ে সভ্য জগত থেকে দূরে থাকা এ মানুষদের সমাজ-সংস্কৃতি তুলে এনেছে। আর মানুষখেকো এই মানুষগুলোর হাতে নিহত হওয়া সভ্য জগতের মানুষও কম নয়। কখনো সভ্য জগতের মানুষগুলো তাদের হত্যা করেছে, কখনো বা তারাই ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নৃশংসতা দেখিয়েছে।

একই ক্যাটাগরির আরও কিছু বই পড়ে নিন আজই

১) বঙ্গবন্ধু হত্যা : জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ

২) একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা কাহিনী

৩) জেল হত্যা মামলা

This article is about Michael Rockefellers mysterious disappearance & his cannibalism in coastal area of new guinea. 

Necessary sources are hyperlinked in the article.

Image Source: mirror.co.uk

Related Articles