বিশাল সাগর। অথৈ ঢেউয়ের গর্জন চারিদিকে। দূর সীমানায় টহল দিচ্ছে শত্রুসেনাদের ভারী অস্ত্র আর কামানে সজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ। মাথার উপর আকাশে ক্ষণে ক্ষণে উড়ে যাচ্ছে বোমারু বিমান। সাগরের একটি জাহাজের শত্রু বাকিরা সবাই। যুদ্ধ করে বাঁচার কোনো পথ নেই, জাহাজটির ৪৫ জন সৈন্য মৃত্যু এড়াতে পারবে কেবল যদি এই ভয়ঙ্কর প্রহরার কঠিন বেষ্টনী পাড়ি দিয়ে পালিয়ে পৌঁছাতে পারে বন্ধু দেশের নৌ সীমায়। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইন্দোনেশিয়ার সাগর সীমায় জাপানের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পড়ে সঙ্গীহারা হয়ে ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই পড়েছিল মিত্র বাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ ‘এইচএনএলএমএস আব্রাহাম ক্রেইনসেন’। আর এই মৃত্যুফাঁদ পেরিয়ে জাহাজটির সৈন্যরা অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গিয়েছিল দুর্দান্ত এক বুদ্ধি খাটিয়ে। সেই দুঃসাহসী যাত্রার গল্প নিয়েই আজকের লেখা।
এইচএনএলএমএস আব্রাহাম ক্রেইনসেন ছিল ডাচ নৌবাহিনী ‘রয়েল নেদারল্যান্ডস নেভি’র একটি মাইনসুইপার যুদ্ধজাহাজ। মাইনসুইপার মানে হল, এই জাহাজের কাজ ছিল নৌপথে মাইন শনাক্ত করে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা। ১৯৩০ এর দশকে তৈরি এই জাহাজটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবস্থান করছিল তৎকালীন ডাচ উপনিবেশ ‘নেদারল্যান্ডস ইস্ট ইন্ডিজ’ এ। আজকের ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ছিল সেই উপনিবেশ এর অধীনে। ১৯৪১ সালের শেষ দিকে অক্ষশক্তির অন্যতম দেশ জাপান ভয়াবহ আক্রমণ করে এই অঞ্চলে। তখন সেখানে অবস্থানরত মিত্র বাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয় মিত্র শক্তির আরেক দেশ অস্ট্রেলিয়ার দিকে পিছু হটতে। এই নির্দেশ পেয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আব্রাহাম ক্রেইনসেন।
আব্রাহাম ক্রেইনসেন নেদারল্যান্ড এর নৌবাহিনীর জন্য ১৯৩০ এর দশকের শেষ দিকে নির্মিত আটটি ‘ইয়ান ভ্যান আমস্টেল- ক্লাস মাইনসুইপার’ মডেলের যুদ্ধজাহাজগুলোর একটি। ১৯৩৭ সালে এটিকে নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৪৫ জন ক্রু ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট ৪৭৬ টন ওজনের এই জাহাজটি ছিল ১৮৪ ফুট দীর্ঘ। এতে স্থাপিত ছিল একটি স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র, দুটি কামান এবং সাবমেরিন বিধ্বংসী বিস্ফোরক। জাহাজটির নামকরণ করা হয় ১৭ শতকের বিখ্যাত ডাচ নৌ কমান্ডার আব্রাহাম ক্রেইনসেন এর নামে।
তৎকালীন ডাচ উপনিবেশ বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া-তে ঘাঁটি গড়েছিল আব্রাহাম ক্রেইনসেন যেখানে জাপান আক্রমণ করে ১৯৪১ সালে। ১৯৪২ সালে জাপানের নৌবাহিনী ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভি’ জাভা সাগর ও সানডে প্রণালীতে পরপর দুটি যুদ্ধে ভয়ানক ভাবে পর্যুদস্ত করে মিত্র বাহিনীকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় নৌ যুদ্ধ ছিল জাভা সাগরের যুদ্ধ যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার একত্রিত নৌবাহিনী পরাজিত হয় জাপানের নৌবাহিনীর কাছে। এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ছয়টি যুদ্ধজাহাজ ডুবে যায়, নিহত হয় ২৩০০ সৈন্য। এর পরপরই সানডে প্রণালিতে জাপানের আরেকটি আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডের তিনটি যুদ্ধজাহাজ ডুবে যায় এবং নিহত হয় মিত্র বাহিনীর ১০৭১ জন সৈন্য। এই দুই চরম পরাজয়ের পর এই অঞ্চলে অবস্থিত মিত্র বাহিনীর বাকি জাহাজগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয় দ্রুত অস্ট্রেলিয়ার নৌসীমায় ফিরে যাওয়ার জন্য।
এই নির্দেশ যখন দেওয়া হয় তখন সেখানে মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ আর অবশিষ্ট ছিল চারটি। জাপানের নৌ ও বিমান বাহিনী ব্যাপক যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে টহল দিচ্ছে সার্বক্ষণিক। এর মধ্য দিয়ে নির্দেশ মোতাবেক অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে যাবার পথ নেই। এই অবস্থায় দুটো জাহাজের সৈন্যরা নিজেরাই এদের জাহজগুলোকে ছিদ্র করে দিয়ে ডুবিয়ে দেয় যাতে জাপানীরা জাহাজ দুটো দখলে নিতে না পারে। আরেকটি জাহাজ লম্বোক প্রণালী দিয়ে পালানোর সময় ডুবে যায় জাপানী যুদ্ধজাহাজের আক্রমণে। চারটির মধ্যে তিনটিই বিধ্বস্ত। সাগরে জাপানী নৌসেনাদের টহল আর আকাশ হতে বিমানবাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণের মুখে একেবারেই একা হয়ে পড়ল আব্রাহাম ক্রেইনসেন।
আগেই বলেছি ক্রিয়েনসনের সামরিক শক্তির কথা, মাত্র একটি স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র, দুটি কামান আর সাবমেরিন বিধ্বংসী বিস্ফোরক। ঐ সময় জাপানের ভয়ঙ্কর শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের কোনো রকম আক্রমণ ঠেকানোই এর পক্ষে সম্ভব ছিল না, পালটা আক্রমণ করে বিজয় অর্জন তো অনেক পরের কথা। বোমারু বিমান থেকে যদি বোমা ফেলা হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। এদিকে জাহাজের গতিটাও ছিল মাত্র ১৫ নট অর্থ্যাৎ ঘন্টায় মাত্র ২৮ কিলোমিটারের মত। এই শামুক গতি আর দুর্বল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাহাজটি জাপানীদের প্রহরা ফাঁকি দিয়ে পালাবে, সেটা একরকম অসম্ভবই ছিল।
কী করা যায়? বাঁচার জন্য আকুলতা মানুষের বুদ্ধিকে কেমন দুর্দান্ত রকমের প্রখর করে তুলতে পারে তার নজির সৃষ্টি করল ক্রিয়েনসেনের সৈন্যদল। ইন্দোনেশিয়ার সাগর জুড়ে তখন প্রায় আঠারো হাজার দ্বীপ, প্রতিটি দ্বীপ গাছপালায় ভর্তি। তারা ঠিক করল, গোটা জাহাজটাকে এমনভাবে ছদ্মবেশ দেবে যেন মনে হয় এটি সেই জঙ্গল বেষ্টিত দ্বীপগুলোরই একটি! সেই দ্বীপবেশী জাহাজটিকে এরপর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অস্ট্রেলিয়ার দিকে। অদ্ভুত আর দুঃসাহসী এই বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর জন্য মরিয়া হয়ে পড়ল জাহাজের সৈন্যরা।
জাহাজ ভিড়ানো হল দ্বীপগুলোর উপকূলে। জাহাজের ক্রুরা সব নেমে গেল। দ্বীপের জঙ্গল থেকে তারা গাছ কাটা শুরু করল। সে এক অসামান্য পরিশ্রম। এমন ভাবে গাছ কাটতে হবে যাতে কেটে ফেলা গাছের আকৃতিও আসল গাছের মতই থাকে। সেই প্রায় আস্ত গাছগুলো নিয়ে তারা তুলতে লাগল জাহাজের ডেকে। এই বিশাল জাহাজের পুরোটা ঢেকে দিতে কী পরিমাণ গাছের প্রয়োজন তা নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়। সাথে আছে প্রতি মুহূর্তে জাপানের আক্রমণের ভয়। আকাশে টহল দিয়ে বেড়ানো বিমানগুলোর একবার চোখে পড়ে গেলেই হল। ওখানেই সলিল সমাপ্তি। এই জীবন মরণ অবস্থাতেই সৈন্যরা গাছ কেটে জাহাজে আনতে লাগল। গাছগুলোকে জাহাজের উপর বসানো হল এমনভাবে যাতে উপর থেকে এটিকে জঙ্গলের সবুজ আচ্ছাদনের মতই দেখায়।
পুরো জাহাজের চারপাশের প্রতি ইঞ্চি তো আর গাছ দিয়ে ঢাকা সম্ভব নয়। সেটার জন্যও বুদ্ধি বের হল। জাহাজের যে অংশগুলো ফাঁকা রয়ে গেল সেখানে তারা মাটি আর পাথরের মত দেখাবে এমনভাবে রঙ লেপ্টে দিল। উপর থেকে দেখলে যাতে মনে হয়, জঙ্গলের আশেপাশে একটু মাটি দেখা যাচ্ছে।
গোটা জাহাজটাকে ছদ্মবেশ দেয়ার কাজটা হল অবশেষে। কিন্তু তখনও তো কথা থেকে যায়। আকাশ থেকে গাছপালায় ভর্তি একটা দ্বীপের মত দেখালেও জাপানী বৈমানিকেরা যদি দেখে দ্বীপের একটা অংশ রীতিমত জাহাজের গতিতে চলাচল করছে যার গঠনে জাহাজের এন্টেনার মত উঁচু অংশও আছে, তাহলে তাদের নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ধরে ফেলতে অসুবিধা হবে না। চলন্ত জঙ্গলে বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয়া তাদের জন্য মুহূর্তের ব্যাপার। সুতরাং এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ফাঁকি দেয়া যায় আকাশসেনাদের চোখ।
এত বড় একটা জাহাজকে দ্বীপে রুপান্তরিত করেছে যারা তাদের বুদ্ধিতে এই সমস্যারও সমাধান আসবে। সমাধান এল, দিনের আলোতে কোনো রকম নড়াচড়া করা যাবে না। জাহাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে শুধু রাতে।
দিনের আলো ফুটলেই জাহাজটিকে তারা নোঙর করতে থাকল সাগরের দ্বীপগুলোর পাশেই। আর আঁধার নামলে জাহাজ চালিয়ে নিতে লাগল প্রতি রাতে। ইন্দোনেশিয়ার সাগরে তখনও পর্যন্ত দ্বীপ ছিল ১৭,৫০৮টি। এর মধ্যে দ্বীপের সংখ্যা যে ১৭,৫০৯টি হয়ে গেছে সেটা তো আর জাপানীর টের পায় নি। আর এই সর্বশেষ দ্বীপটি যে প্রতি রাতে অবস্থান পাল্টে ফেলছে সেটাও এড়িয়ে গেছে তাদের চোখ, টের পেলে কী হবে সেটা ভেবেই প্রার্থনা করতে লাগল ক্রিয়েনসনের ক্রুরা যেন এত পরিশ্রম আর বুদ্ধি খাটানোর পর জীবনটা বাঁচে এই যাত্রায়।
এই নিদারুণ শঙ্কা নিয়ে জাহাজ চলতে লাগল। জাপানের সৈন্যরা ধরতে পারল না কুশলী ফাঁকিটুকু। জাপানী বিমান আর যুদ্ধজাহাজের মৃত্যুফাঁদ পেরিয়ে আট দিন চলার পর ১৯৪২ সালের ২০ মার্চ অবশেষে আব্রাহাম ক্রেইনসেন পৌঁছে গেল অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিম্যান্টল এ। জয় হল মানুষের বুদ্ধি আর প্রজ্ঞার। নিদারুণ সংকটের মাঝেও স্থিরভাবে চিন্তা করে যে সেই সংকট পেরুনোর উপায় বের করা যায় তার একটা শিক্ষা মানুষের উদ্দেশ্যে ইতিহাসের পাতায় লিখে দিল যুদ্ধজাহাজ আব্রাহাম ক্রিয়েনসেনের সৈন্যরা।
নেদারল্যান্ডস ইস্ট ইন্ডিজের সর্বশেষ জাহাজ হিসেবে ১৯৪২ সালে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছানোর পর জাহাজটিকে এইচএমএএস আব্রাহাম ক্রেইনসেন নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘রয়েল অস্ট্রেলিয়ান নেভি’ তে, এখানে এটিকে নিযুক্ত করা হয় সাবমেরিন আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য প্রহরী জাহাজ হিসেবে। পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে আবার একে নেদারল্যান্ডের নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেয়া হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় জাহাজটি অস্ট্রেলিয়ান নৌসীমানাতেই কাজ করে। যুদ্ধশেষে জাহাজটিকে ইস্ট ইন্ডিজে বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে এটিকে ফিরিয়ে আনা হয় নেদারল্যান্ডে। ১৯৬০ সালে এটিকে নেদারল্যান্ডস এর নৌ ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে ডাচ নেভি মিউজিয়াম এ আব্রাহাম ক্রেইনসেন এর ঠাঁই হয় যাদুঘরের প্রদর্শনীর জন্য। সেখানেই এখন রাখা আছে ইতিহাসের দুঃসাহসী যাত্রার সাক্ষী জাহাজটি।
This article is in Bangla Language. It's about the escape story of Abraham Crijnssen
References & Image Sources:
- http://museumships.us/netherlands/abraham-crijnssen http://www.navy.gov.au/hmas-abraham-crijnssen
- http://www.wearethemighty.com/articles/dutch-warship-island