Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উরু: বিদ্রোহের সাক্ষী যে ফল

“একটি নির্জন দ্বীপ! দ্বীপের একটি ছোট গুহায় আশ্রয় নিয়েছে একই পরিবারের ছয় সদস্য। সকলেই খাবারের জন্য ছটফট করছে, তবে তেমন কোনো খাদ্যের সন্ধানও মিলছে না। গুহার আশেপাশে যে বন্য ফার্ন জন্মেছে, তা খেয়েই কোনোরকমে কাজ চালাতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু এভাবে আর কত দিন যাবে?

এই ভাবনা পরিবারের কর্তাকে সারাক্ষণ বিচলিত করতে থাকে। বাকি সদস্যদের করুণ দশা দেখে সেই ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলেন, তিনি নিজেকে গুহার পেছনের দিকে সমাহিত করবেন এবং সেখানে তিনি একটি সুন্দর গাছ হিসেবে পুনর্জন্ম নিয়ে বিকশিত হবেন, যা তার পরিবারের সদস্যদের খাদ্যের যোগান দেবে। তবে তার স্ত্রী এই কথার বেশি একটা মূল্যায়ন করেননি। পরদিন সকালে সবার ঘুম ভাঙলে শত চেষ্টা করেও সেই ব্যক্তির আর কোনো খোঁজ খাওয়া পায় যায়নি।

এরই মাঝে গুহার পেছনে মোটামুটি বড় আকারেরই একটি গাছ জন্মে, যা আঞ্চলিক ভাষায় ‘উরু’ নামে পরিচিত। এক রাতেই গাছটি বেড়ে উঠে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে, যার মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে কাঁঠালের মতো ফল দেখা যায়”।

উক্ত অংশটুকু ফ্রেঞ্চ পলিনিশিয়ানের একটি বিখ্যাত কিংবদন্তির, যা রায়াতিয়া দ্বীপে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে দেশটিতে প্রচলিত হয়। দুর্ভিক্ষের সত্যতা থাকলেও এই কিংবদন্তির সত্যতা যাচাই করা যায়নি। বর্তমানে এই রায়াতিয়া দ্বীপ ‘মাহিনা’ নামে পরিচিত, তবে বেশিরভাগ আঞ্চলিক লোকজন একে এখনও ‘তুয়া-উরু’ নামেই ডাকে, যার অর্থ ‘উরু ফলের উপত্যকা’।

মাহিনা দ্বীপে ‘উরু’ বা ‘ব্রেডফ্রুট’ এর গুরুত্ব বোঝার জন্য তাদের প্রচলিত কাহিনী জানারও কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, এই দ্বীপে আসলেই পথে-ঘাটে, হাটবাজারে যে বস্তুটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হলো এই উরু ফলটি। রাস্তার দু’ধারে বড় বড় উরু গাছ দেখা যায়, যার মধ্যে ডুমুরের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে এই ফল দেখা যায়। প্রচুর পরিমাণে ফলনের কারণ হিসেবে পলিনেশিয়ার একজন ব্যক্তি বলেন, “এর অর্থ হলো, আপনি আপনার পরিবারকে বছরের পর বছর ভালোমতো খাওয়াতে পারবেন।” এই ধারণা সকলের মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তির দরুণই জেগেছে।

উরু; Image source: npr.org

১৭৬৮ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির জাহাজ এইচএমএস এন্ডেভারে করে ইংরেজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যার জোসেফ ব্যাংকস এবং আরও সিপাহীসহ অনুসন্ধানমূলক ভ্রমণে যান। সেই সময়ে তারা ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার দ্বীপ তাহিতিতে তিন মাসের জন্য বিরতি নেন। তবে তাদের অনুসন্ধানমূলক যাত্রাটি ছিল তিন বছরের। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন কোনো গাছের সন্ধান এবং ক্রীতদাসদের ভরণপোষণের জন্য কম দামী কোনো খাদ্যের সন্ধান করা।

বিরতিতে আশ্রয় নেয়া পলিনেশিয়ান দ্বীপটি সেই যুগেও প্রাকৃতিকভাবেই উরু গাছে ভরা ছিল। গাছগুলো খুব কম যত্নে রাখলেও অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এর পেছনে বেশি খরচ বা অন্য কোনো ঝামেলাও নেই। তাছাড়া বছরের সাত মাসই পাওয়া যায় এর বাম্পার ফলন। একটি গাছের এত বৈশিষ্ট্য দেখে দুজনের মাথায় একটি বুদ্ধি চেপে বসে। তারা ইংল্যান্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে নিয়ে আসা ক্রীতদাসদের খাবারের যোগান দিতে এই ফল ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেন। কম কষ্টে ও টাকায় কৃতদাসদের ভরণপোষণ করার মন-মানসিকতার দরুণ এই উদ্ভাবন। ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার পর ব্যাংকস এবং ক্যাপ্টেন কুক সম্রাট তৃতীয় জর্জকে তাদের নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে জানান এবং এ থেকে তারা কীভাবে লাভবান হতে পারেন তা বুঝিয়ে বলেন। তাদের পরিকল্পনা সকলের নিকট সমাদৃত হলেও এই উরু গাছগুলো কীভাবে স্থানান্তর করা হবে তা নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। এমনকি আর কোনো পথ না পেয়ে ব্যাংকস নিজেও ঘোষণা দেন, কোনো ব্যক্তি যদি ১,০০০ উরু গাছের চারা তাহিতি থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে স্থানান্তর করতে পারে, তবে তাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু সেই সময়ে কুক ও ব্যাংকসের এই কূটনীতি সফল হতে পারেনি।

স্যার জোসেফ ব্যাংকস; Image source: britannica.com

উল্লেখ্য, পরবর্তীতে এই উদ্ভিদবিজ্ঞানী ব্যাংকস বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান ‘রয়্যাল সোসাইটি’র প্রেসিডেন্ট হন। তিনি একজন প্রকৃতিবিদ এবং কিউ গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।

তাহিতি দ্বীপ; Image source: orangesmile.com

ক্যাপ্টেন কুকের প্রাথমিক অভিযানের প্রায় দুই যুগ পরে সম্রাট তৃতীয় জর্জ লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লাইকে তাহিতি দ্বীপ থেকে উরু গাছের চারা স্থানান্তর করার দায়িত্ব দেন। ১৭৮৭ সালের ২৮ নভেম্বর ব্লাই তার দল নিয়ে এইচএমএস বাউন্টিতে যাত্রা শুরু করেন। তার সাথে দুজন মালীও ছিলেন। অভিযানে শুরু থেকেই বিভিন্ন ঝামেলার শুরু হয়। উঁচু জোয়ার-ভাটা, ঝড়-বৃষ্টি বারবার থামিয়ে দিচ্ছিল সমুদ্রযাত্রাটি। কোনোভাবে তাহিতি গিয়ে পৌঁছাতে পারলেও উরু পরিবহনে ব্লাই ও তার দলকে অপেক্ষা করতে হয় পাঁচ মাস। কারণ ফুটবল সাইজের ফলগুলো বছরে সাত মাস পাওয়া যায়।

লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লাই; Image source: en.wikipedia.org

আর ব্লাই তাহিতিতে বছরের এমন এক সময়ে পৌঁছান, যখন এই ফল জন্মায় না। তাই তাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এরপরেও কারণে-অকারণে দেরি হতে থাকে ফিরে আসার যাত্রা। অবশেষে ১৭৮৯ সালের ২৯ এপ্রিল ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের তত্ত্বাবধানে তাদের মূল উদ্দেশ্য, তথা ওয়েস্ট ইন্ডিজে উরুর চারা পরিবহন করে নিয়ে যাওয়ার কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তবে তা আর কখনও সফল হতে পারেনি।

এই দিনে লেফটেন্যান্ট ব্লাইয়ের হঠাৎ করে ঘুম ভাঙে বুকের উপর জোরে চাপ পড়ার কারণে। চোখ খুলতেই দেখতে পান, তার দলের সিপাহীরাই তার দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। এর মূল হোতা ছিলেন ২৩ বছরের ফ্লেচার ক্রিস্টিয়ান। ব্লাইকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় তার জাহাজের কাছে, যেখানে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, বিদ্রোহীরা তার জাহাজ দখল করে নিয়েছে। আর যারা তার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন, তারাও এখন বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি। ব্লাইসহ মোট ১৯ জনকে বিদ্রোহীরা দয়া করে মেরে না ফেললেও জোরপূর্বক একটি লঞ্চে প্রেরণ করেন, যেখানে এই ১৯ জনের জন্য পাঁচ দিনের যথেষ্ট খাবার এবং পানির ব্যবস্থা ছিল। তবে লঞ্চটিতে কোনো মানচিত্র ছিল না। ক্রিস্টিয়ান এবং বাকি বিদ্রোহীরা নিশ্চিত ছিলেন যে, ব্লাই ও বাকি সিপাহীরা মাঝরাস্তায় কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে কিংবা খাদ্যাভাবে করুণভাবে মারা যাবেন। অর্থাৎ সেই দয়া কোনো মহৎ মানসিকতার নিদর্শন ছিল না।

কিন্তু ভাগ্যক্রমে ব্লাইয়ের কাছে ছিল একটি কম্পাস, একটি কোয়াড্রেন্ট (কৌণিক মাপের সাহায্যে উচ্চতা মাপার যন্ত্র), নৌযাত্রার জন্য কিছু খণ্ড খণ্ড সারণী এবং একটি ভাঙা সেকসট্যান্ট। এগুলোর সহায়তা তিনি প্রায় ৪,০০০ মাইলের ঐতিহাসিক সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করেন। এই যাত্রায় শুধুমাত্র একজন সিপাহী মারা যান। বাকিরা নিরাপদেই ব্লাইয়ের সাথে ইংল্যান্ডে ফিরতে পারেন।

মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি; Image source:famous-trials.com

এখন কথা হলো, কেন এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়? লেফটেন্যান্ট ব্লাই ও তার বাহিনী তাহিতি দ্বীপে উরুর ফলনের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলেন, তখন তার দলের বেশিরভাগ সিপাহী তাহিতি দ্বীপের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হতে থাকে। তাছাড়া ব্লাইয়ের কঠোর নিয়ম-কানুন কিংবা সিপাহীদের পারিশ্রমিক ঠিকমতো না দেওয়ার কারণে তাদের মনে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়। এর মূল হোতা ফ্লেচার ক্রিস্টিয়ান ও তার পুরো পরিবার ব্লাইয়ের কাছে ঋণগ্রস্ত ছিলেন। এসব অসন্তোষ ও ক্ষোভের কারণেই ব্লাইয়ের এই দশা হয়। আর এই বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় ‘মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

ফ্লেচার ক্রিস্টিয়ান; Image source:geni.com

তবে দ্বিতীয়বার সমুদ্রযাত্রায় গিয়ে ব্লাই উরুর চারা স্থানান্তর করতে সফল হন। এই সময়ে তিনি দ্বিতীয় বিদ্রোহের হাত থেকে কোনোভাবে বেঁচে যান। কিন্তু ১৮০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাউথ ওয়েলসে গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত হলে সেখানে আরেকটি বিদ্রোহের জন্ম নেয়। দোষ-ত্রুটি থাকলেও ব্লাই প্রায় ৪,০০০ মাইলের একটি অসম্ভব সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করার জন্য ইতিহাসের পাতায় এখনও স্মরণীয় হয়ে আছেন।

The aricle is in Bangla language. It's about ‘Uru’, the fruit which witnessed a mutinity. Sources have been hyperlinked in this article.
Featured image: Wikimedia Commons

Related Articles