ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত নটর ডেম ক্যাথেড্রাল, বা লোকেমুখে আওয়ার লেডি অফ প্যারিস নামেও পরিচিত, ইতিহাসের অন্যতম কালজয়ী একটি স্থাপনা। সমগ্র ফ্রান্সজুড়ে যেসমস্ত স্থাপনা রয়েছে তার মধ্যে এই ক্যাথেড্রালটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুপ্রসিদ্ধ।
সিন নদীর পাশে অবস্থিত ৮৫০ বছর পূর্বের এই স্থাপনাটি প্যারিসের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। নটর ডেম ক্যাথেড্রালের বাইরে ‘পয়েন্ট জিরো’ লেখা একটি নামফলক রয়েছে, যেটাকে কেন্দ্র করে প্যারিস থেকে ফ্রান্সের অন্যান্য জায়গার দূরত্ব পরিমাপ করা হয়। সেই সাথে, এই নামফলকটি প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দুর নির্দেশকও। ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান গির্জা হিসেবে মর্যাদা পেয়ে আসা নটর ডেম ক্যাথেড্রাল বহু রাজকীয় বিয়ে, সম্রাট হিসেবে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অভিষেক, জন অফ আর্কের মৃত্যুর পর সাধু হিসেবে পোপ কর্তৃক মাহাত্ম্য প্রদানের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরির ফ্রান্সের রাজা হিসেবে যাত্রা শুরু হয় নটর ডেম ক্যাথেড্রালে অভিষেকের পরেই। স্কটল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জেমস এবং ফ্রান্সের রাজকন্যা ম্যাডেলিন অফ ভ্যালয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয় এখানে। প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গল এবং ফ্রান্সিস মিটারল্যান্ডের মৃত আত্মার শান্তি কামনায় এখানেই সমবেত হয়েছিল শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিচিতজনেরা।
ফ্রান্সের সার্বিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্যারিসের যখন উত্থান হতে থাকে, ঠিক সে সময় রাজা সপ্তম লুইস অনুমোদন দেন নটর ডেম ক্যাথেড্রাল বিনির্মাণের।
বলা হয়ে থাকে, ফ্রান্সে খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসারের পূর্বে, বর্তমানে যেখানে নটর ডেম ক্যাথেড্রাল দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে রোমান দেবতা জুপিটারের একটি মন্দির ছিল। এবং এরপরে একই জায়গায় ক্যাথেড্রালটি নির্মাণের পূর্বে চার চারটি গির্জা নির্মিত হয়েছিল। প্রথমে আনুমানিক চতুর্থ শতাব্দীর দিকে একটি ব্যাসিলিকা নির্মিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে কয়েকবার সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যায়। ব্যাসিলিকা মূলত রোমান স্থাপনার আদলে তৈরি গির্জাস্বরূপ দালান, যেখানে প্রার্থনার পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তির কাজও চলতো। ধারণা করা হয়, ব্যাসিলিকাটি সাধু স্টেফেনের প্রতি উৎসর্গ করে বানানো হয়েছিল।
আরেকটি মতবাদ রয়েছে যে, এই ব্যাসিলিকাটির পূর্বে ‘চিল্ডেবার্টের ক্যাথেড্রাল’ নামে আরেকটি গির্জা এখানে স্থাপিত হয়েছিল এবং সেই গির্জা থেকে সপ্তম শতাব্দীতে নতুন গির্জাটি নির্মিত হয়। নতুন এই ব্যাসিলিকাটি পরে সাধু ইটিনের ক্যাথেড্রাল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সাধু ইটিনের ক্যাথেড্রালটি ৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে ক্যারোলিংগিয়ান পরিবারের তত্ত্বাবধানে পুনরায় সংস্কারপ্রাপ্ত হয়। নটর ডেম ক্যাথেড্রাল স্থাপনের ঠিক পূর্বে যে গির্জাটি ছিল, সেটি রোমান স্থাপনার আদলে তৈরি করা হয়েছিল। ১১৬০ সালে, প্যারিসের তৎকালীন বিশপ, মরিস ডি সালি, সিদ্ধান্ত নেন একটি নতুন এবং আরো বিস্তৃত গির্জা নির্মাণের। তিনি আগের গির্জাটি ভেঙে তার উপাদানগুলো পুনঃব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। সালি সিদ্ধান্ত নেন, নতুন ক্যাথেড্রাল (নটর ডেম ক্যাথেড্রাল) নির্মিত হবে গোথিক আদলে। রাজা সপ্তম লুইস এবং পোপ তৃতীয় অ্যালেকজান্ডারের উপস্থিতিতে ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দের আনুমানিক ২৪-২৫ মার্চের মধ্যে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়।
প্রথমে প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়ার স্থান আর ক্যাথেড্রালের বাইরের অংশের করিডোর নির্মাণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কাজ। ১১১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রার্থনা সঙ্গীতের স্থানটি এবং ১১৮২ সালে পুরো বেদী নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে যায়। নবম লুইস সেইন্ট চ্যাপেল প্যারিসের আরেকটি বিখ্যাত গির্জা সেইন্ট চ্যাপেল নির্মাণের সময়কালে ল্যাটিন সম্রাট দ্বিতীয় বাউডুয়োনের কাছ থেকে অনেক অর্থের বিনিময়ে প্যাশন অফ ক্রাইস্টের ভগ্নাবশেষ কিনেছিলেন। এই ভগ্নাবশেষের মধ্যে কাঁটার তৈরি মুকুট, ক্রুশ হতে একটুকরো রূপা এবং একটি পেরেক ছিল। নবম লুইস নটর ড্যাম ক্যাথেড্রালের নির্মাণের সময় এই ভগ্নাবশেষটুকু দান করে দেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে নির্মাণকার্যের মধ্যে একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে, যখন গির্জার ট্রান্সেপ্ট রোমানিয়ান ঘরানায় পুনরায় নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। ১২৪০ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে ভাস্কর জেন ডি চ্যালেস উত্তরের ট্রান্সেপ্টে একটি তিনকোণা দরজা সংযোজন করেন, যার উপরিভাগে ছিল একটি নান্দনিক বৃত্তাকার জানালা। এর কিছুকাল পরেই, ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেঞ্চ স্থপতি পিয়ের ডি মন্ট্রেউল দক্ষিণের ট্রান্সেপ্টের নকশাও একই আঙ্গিকে করেন। উভয় ট্রান্সেপ্টের দরজাসমূহ নানা রকমের ভাস্কর্য দ্বারা সজ্জিত ছিল। দক্ষিণ ট্রান্সেপ্টের দরজায় সেইন্ট স্টেফেন ও অন্যান্য স্থানীয় ধর্মযাজকদের জীবন নিয়ে ভাস্কর্য রয়েছে, উত্তর দিকের দরজায় ভাস্কর্যের দ্বারা ফুটে উঠেছে যিশুর ছোটবেলার কাহিনী এবং থিওফিলিয়াসের গল্প।
বিখ্যাত স্থপতিশিল্পী জেন র্যাভি, জেন ডি বটিলিয়ে এবং রেমন্ড ডু টেম্পল, ভাস্কর জেন ডি চ্যালেস এবং স্থপতি পিয়ের ডি মন্ট্রেউলের উত্তরসূরী হিসেবে কাজ করে গিয়েছিলেন। এছাড়াও নিজেদের মধ্যে একজনের মৃত্যুর পর অন্যজন তার কাজটুকু এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। র্যাভি, চ্যালেসের রুড স্ক্রিন এবং চেভেট চ্যাপলের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন, এবং পরে ১৫ মিটার দীর্ঘ ফ্লায়িং বাট্রেস বা গির্জার দেয়ালকে সমর্থন দেয়ার জন্য বাইরের দিকে নির্মিত সুউচ্চ, মাথার দিকে ধনুকের মতো তীক্ষ্ণ দেয়ালের কলামের কাজ শুরু করেন।
জেন ডি বটিলিয়ে ছিলেন জেন র্যাভির ভ্রাতুষ্পুত্র এবং তিনি ১৩৪৪ সালে র্যাভির মৃত্যুর পর তার কাজগুলো শেষ করার দায়িত্ব নেন। ১৩৬৩ সালে বটিলিয়ের মৃত্যুর পর তার সহকারী রেমন্ড ডু টেম্পল তার কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যান। নটর ডেম ক্যাথেড্রালের সম্মুখ চত্বরে ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে একটি ফোয়ারা স্থাপন করা হয়। রাজা চতুর্দশ লুই, তার বাবা তৃতীয় লুইয়ের অনুরোধে ক্যাথেড্রালের বাইরের অংশে কিছু পরিবর্তন আনেন। এই কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব তিনি স্থপতি রবার্ট ডি কোটের হাতে অর্পণ করেন। কোটে প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়ার স্থানটির সামনে থেকে চ্যালেসের রুড স্ক্রিন সরিয়ে ফেলেন এবং সেখানে দেন সোনালী রঙয়ের একটি বেষ্টনী। পেটা লোহার এই বেষ্টনীটি তৈরি করতে বেশ অর্থ খরচ করতে হয়েছিল। এছাড়াও কোটে গির্জার মূল অংশে স্থাপিত কবরগুলোও সরিয়ে ফেলেন। নতুন বেদী তৈরির পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন আসবাবপত্রও শোভা পেতে শুরু করে গির্জায়।
১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্যারিসের স্বর্ণকারদের সমবায় সংঘ নটর ডেম ক্যাথেড্রালের জন্য বেশ কিছু অনুদান দিয়ে থাকতো। ১৬৩০ সালে তারা সিদ্ধান্ত নেয় সরাসরি অর্থের অনুদান প্রদানের বদলে প্রতিবছর মে মাসের প্রথম দিন তারা গির্জার বেদীর পেছনে স্থাপন করা জন্য নতুন ছবি প্রদান করবেন। এই কাজগুলো পরবর্তীতে পরিচিত হয় ‘গ্রান্ডস মেইস’ নামে। ১৭০৮ সাল পর্যন্ত প্রায় সাতাত্তরটি ছবি প্রদান করা হয়েছিল, পরে অর্থগত কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এই চিত্রকর্মগুলো ১৭৯৩ সালের দিকে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ফ্রান্সের কিছু জাদুঘরে সেগুলো পাঠানো হয়। ক্যাথেড্রালের মধ্যে অবশিষ্ট থাকা চিত্রকর্মসমূহের মধ্যে কয়েকটি উনিশ শতকের দিকে সরিয়ে নেয়া হয়। বাকি তেরটি চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম হলো জ্যাকিস ব্লানচার্ডের আঁকা লা ডিসেন্টে ডু সেইন্ট এস্পিরিট (১৬৩৪), লরেন্ট ডে লা হায়রের আঁকা সেইন্ট পিয়ের গুয়েরসান্ট লা মালাদিস ডি সন ওমব্রে (১৬৩৫) এবং লা কনভারসন ডি সেইন্ট পল (১৬৩৭), অবিন ভটের আঁকা লা সেন্টেনিয়ার করনিয়াল অক্স পিডস ডি সেইন্ট পিয়ার (১৬৩৯), জেমস পোয়েরসনের আঁকা লা প্রিডিকশন ডি সেইন্ট পিয়ের আ জেরুসালেম (১৬৪২), লুইস চেরনের আঁকা ল্যা প্রফেট আগাবাস প্রিডিসান্ট আ সেইন্ট পল সে সফ্রান্সেস আ জেরুসালেম (১৬৮৭), ম্যাথিউ ইলিয়াসের আঁকা ল্যা ফিলস ডি স্কেভা বাট্টুস পার লা ডেমন (১৭০২) ইত্যাদি। এছাড়াও রাজা চতুর্থ লুইয়ের আমলে মাতা মেরীর জীবন নিয়ে অঙ্কিত ছয়টি চিত্রকর্ম আন্টোনি ডি লা পোর্ট নটর ডেম ক্যাথেড্রালের জন্য রাজাকে উপহার দেন। একই সময়ে চার্লস ডি লা ফসে তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘এবরশন অফ দ্য মিজাই’ তৈরি করেন, যা বর্তমানে প্যারিসের লুভ্যর মিউজিয়ামে সজ্জিত রয়েছে।
১৩০২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ ফিলিপস ফ্রান্সের প্রথম আইনসভার আয়োজন করেন নটর ডেম ক্যাথেড্রালে। ১৪৩১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দশ বছর বয়সী ইংল্যান্ডের ষষ্ঠ হেনরির ফ্রান্সের রাজা হিসেবে অভিষেক ঘটে এখানেই। রেনেসাঁর যুগে নটর ডেমের গঠনশৈলী যুগোপযোগী বলে বিবেচিত না হওয়ায় ক্যাথেড্রালের দেয়াল এবং ভেতরের স্তম্ভগুলো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে আন্দোলনকারী ধর্মীয় দলগুলোর একটি ছিল হুগেনটস গোষ্ঠী। সেসময় তারা ক্যাথেড্রালের বেশ কিছু মূর্তি ধ্বংস করে দেয়, কারণ তাদের মতে তা ছিল ধর্মবিরোধী। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর নটর ডেম ক্যাথেড্রালসহ আরো অনেক বিখ্যাত স্থাপনা দখল করা হয় এবং সর্বসাধারণের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
১৭৯৩ আলে ক্যাথেড্রালটি পুনরায় তার আগের মালিকানায় (কাল্ট অফ রিজনের কাছে) চলে যায়। মালিকানা বদলে পরে কাল্ট অফ সুপ্রিম বিয়িং ক্যাথেড্রালটির মালিকানা পায় পরবর্তীতে। কিন্তু এ সময়টায় ক্যাথেড্রালের ভেতরে বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাইবেলে উল্লেখিত রাজাদের যে আটাশটি মূর্তি ক্যাথেড্রালের পশ্চিমদিকের ভবনের বাইরের অংশে স্থাপিত ছিল, তাদেরকে ফ্রান্সের রাজাদের মূর্তি ভেবে শিরোশ্ছেদ করা হয়। মাথাগুলোর কয়েকটি ১৯৭৭ সালে ক্যাথেড্রালের কাছেই খননকার্য চালালে পাওয়া যায়। বর্তমানে সর্বসাধারণের জন্য তা মিউজি ডি ক্লুনি নামে প্যারিসের একটি মিউজিয়ামে রাখা আছে। ক্যাথেড্রালের বিশাল ঘন্টাগুলো বেশ কয়েকবার গলে গিয়ে নষ্ট হতে হতে বেঁচে যায়। গির্জার বাইরে রাখা মাতা মেরীর মূর্তি ব্যতীত বেশ কিছু বড় বড় মূর্তি ফরাসি বিপ্লবের সময় ভেঙে ফেলা হয়।
বিপ্লবের সময় ক্যাথেড্রালটি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৮০১ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং সপ্তম পোপ পায়াসের মাঝে চুক্তির পর নেপোলিয়ন নটর ডেম ক্যাথেড্রালকে ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। ফ্রান্সের সম্রাট হিসেবে নেপোলিয়নের অভিষেকের পূর্বে নকশাকারক চার্লস পারসিয়ার এবং স্থপতি পিয়ের-ফ্রান্সেস-লিওনার্ড ফন্টেইন মিলে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের গঠনে কিছুটা গোথিক ঘরানার পরিবর্তন আনেন।
ফরাসি বিপ্লবের পর ১৮০৩-১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে নেপোলিয়নিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর নটর ডেম ক্যাথেড্রালের অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে পড়েছিল যে, প্যারিসের সরকারপ্রধান পুরোপুরিভাবে তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। এসময় এগিয়ে আসেন ফরাসি ঔপন্যাসিক, কবি ও নাট্যকার ভিক্টর হুগো, যাকে নটর ডেম ক্যাথিড্রাল বেশ মুগ্ধ করতো।
প্রিয় স্থাপনাটিকে রক্ষা করতে হুগো ১৮৩১ সালে রচনা করেন তার বিখ্যাত উপন্যাস নটর ডেম ডি প্যারিস, যা নটর ডেমের কুঁজো নামেও পরিচিতি পেয়ে থাকে। সারা বিশ্বে বইটি বিরাট হুলস্থূল লাগিয়ে দেয় এবং নটর ডেম ক্যাথেড্রালের তৎকালীন দুরবস্থা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ তৈরি করে। ১৯৩৯ সালে বইটি অনুসারে উইলিয়াম ডিয়েটেরেলের পরিচালনায় সিনেমা তৈরি হয়। অভিনেতা চার্লস লটেন এবং অভিনেত্রী মরিন ও'হেরা এই সিনেমায় অভিনয় করে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেন।
এর ফলস্বরূপ, ১৮৪৪ সালে রাজা লুইস ফিলিপ ক্যাথেড্রালটি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে যে কাজ শুরু হয়েছিল তা ছিল বেশ ব্যয়বহুল।
জোয়ান অফ আর্ক ইংরেজদের সাথে শতবর্ষী যুদ্ধে পুরুষের বেশ নিয়ে ফরাসি সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কম্প্যেন যুদ্ধের সময় ১৪৩০ সালের মে মাসে জোয়ান ধরা পড়েন এবং বার্গান্ডিবাসী তাকে জেলে পুরে দেয়। জেল থেকে পালাতে ষাট ফুট উঁচু ভবন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে ইংরেজদের কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়। ডাইনী অভিযোগে অভিযুক্ত করে কালোজাদুর সহায়তায় যুদ্ধজয়ের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়। পরে ১৪৩১ সালের ৩০ মে সীন নদীর তীরে উত্তর ফ্রান্সের একটি লোকালয়ে চার্চের প্রতি অবাধ্যতার অভিযোগ এনে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়।
নিউ অরলিন্সের বিশপ ফেলিক্স ডুপানলুপের প্রচেষ্টায় ১৯০৯ সালে নটর ডেম ক্যাথেড্রালে অনুষ্ঠিত হয় জোয়ান অফ আর্ককে সাধু হিসেবে সম্মাননা দেয়ার অনুষ্ঠান। পোপ দ্বিতীয় পায়াস অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।
১৯৪৪ সালের প্যারিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ক্যাথেড্রালটি অসামান্য কিছু ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে দিয়ে যায়। একই সালের আগস্টের ২৬ তারিখ প্যারিসের স্বাধীনতা উপলক্ষে ক্যাথেড্রালে প্রার্থনার আয়োজন করা হয় জার্মানদের পক্ষ থেকে।
৮০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৯৬৩ সালে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের বহির্ভাগে গত কয়েক শতকে রেখে যাওয়া হিংস্র আক্রমণের ছাপ মুছে ফেলা হয় এবং ক্যাথেড্রালটি তার পূর্বের আধো সাদা রঙে রঙিন হয়ে ওঠে।
উনিশ এবং বিশ শতকে প্যারিসে বায়ু দূষণ বেড়ে যাওয়ার ফলস্বরূপ ক্যাথেড্রালের পাথরের গাঁথুনি অনেকটুকুই মলিন হয়ে পড়েছিল। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ক্যাথেড্রালের গম্বুজের চূড়াগুলো এবং ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্মিত গারগোয়েলগুলো ভেঙে যেতে শুরু করে। এসব কারণে ১৯৯১ সালে দশ বছরব্যাপী একটি সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ক্যাথেড্রালের আসল রূপ ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। ক্যাথেড্রালের বিভিন্ন অংশে ব্যবহৃত চুনাপাথরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও পায়রাদের আনাগোনা কমানোর জন্য ছাদে তারের সংযোজন করা হয়। তাছাড়াও নতুন করে ক্যাথেড্রালের পাইপ অরগ্যানের নিয়ন্ত্রণে কম্পিউটারের সাহায্য নেয়া হয়। গির্জার পশ্চিম অংশও বেশ তোড়জোড় করে পরিষ্কার করা এবং পুরো ক্যাথেড্রালের দায়িত্বে থাকা সকল লোকজন প্রস্তুত হতে শুরু করে ২০০০ সালকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
২০০৭ সালে প্যারিসের আর্চবিশপ জিন-ম্যারি লাস্টিগারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় এই ক্যাথেড্রালে।
নটর ডেম ক্যাথেড্রালের ৮৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে উত্তর দিকের মিনারগুলোর ঘন্টাগুলো গলিয়ে ব্রোঞ্জের তৈরি নতুন ঘন্টা সংযোজন করা হয় ২০১৩ সালে।
১৯৯০ সালের সংস্কারের পরও ক্যাথেড্রালটির স্থানে স্থানে অনেক ভঙ্গুর দশার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে ফ্রান্সের সরকার ২০১০ সালের শেষের দিকে পুনরায় আরেকটি সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়। এই সংস্কার প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে ১০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ হতো, যার জন্য প্যারিসের আর্চবিশপ সরকারি ও বেসরকারি অনুদানের সাহায্য নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর নটর ডেম ক্যাথেড্রালের প্রথম ভবন স্থাপনের ৮৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে শুরু হয় বছরব্যাপী আয়োজন। এই আয়োজনের সময়েই ঘটে একটি অযাচিত ঘটনা। ২০১৩ সালের ২১ মে, ইতিহাসবিদ ডমিনিক ভেনার গির্জার বেদীতে একটি চিঠি রেখে সেই মুহূর্তেই নিজেকে গুলি করেন। তার মৃত্যু তৎক্ষণাৎই ঘটে। এ সময় উপস্থিত ১,৫০০ জন দর্শককে সাথে সাথেই সরিয়ে নেয়া হয়।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে,ফরাসি পুলিশ মন্টপিলিয়ের কাছে চার জঙ্গিকে গ্রেফতার করে যারা কি না এই ক্যাথেড্রালে আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে প্যারিসে এসেছিল। ওই বছরেরই জুনের ৬ তারিখ, গির্জার প্রাঙ্গনে হাতুড়ি নিয়ে এক ব্যাক্তি পুলিশকে আক্রমণ করতে এলে বহু লোক ভেতরে আটকা পড়ে। ৬ মিলিয়ন ইউরোর একটি সংস্কার কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষে এবং ২০১৯ পর্যন্ত এই সংস্কারের কাজ গড়ায়।
২০১৮ সালের এই সংস্কার কাজ, যা ২০১৯ সালেও গড়ায়- এই সংস্কারই মূলত নটর ডেম ক্যাথেড্রালের সহস্র বছরের ইতিহাসে রচিত করেছিল এক কালো অধ্যায়ের। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখে সন্ধ্যা সাতটার দিকে নটর ডেম ক্যাথেড্রালে আগুন লাগে। এই আগুন ছড়িয়ে পড়লে ক্যাথেড্রালের ছাদ ও ছাদের পেচানো অংশের ‘স্পায়ার’ ধসে পড়ে। এ সময় ছাদের স্পায়ারের নিচে থাকা কাঠের কুক্ষি ও রঙিন কাচের জানালাগুলোও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে ক্যাথেড্রালের দুটি বেল টাওয়ারসহ প্রধান অংশ বেঁচে যায় আগুনের লেলিহান শিখা থেকে।
প্রায় ৫০০ জনের দমকল বাহিনী বেলটাওয়ার ধসে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এ সময় ক্যাথেড্রালকে ঘিরে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। তাদের মধ্যে কেউ সহস্র বছরের প্রাচীন এই স্থাপনাকে চোখের সামনে জ্বলতে দেখে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিল, কেউ বা নিভৃতে চোখের জল ফেলছিল।
প্যারিসের অন্যান্য গির্জা এ সময় নটর ড্যাম ক্যাথেড্রালের করূণ দশার জন্য মুক্তি চেয়ে প্রার্থনার আয়োজন করছিল। গির্জাগুলোর বড় বড় ঘন্টা একতালে বেজে যাচ্ছিল। অগ্নিকান্ডের পাঁচদিন পরই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দেশি-বিদেশি নানা সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় চলছে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের কাজ। ইউনেস্কোও বিশাল পরিমাণের আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছে এই কাজে।
অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া পুরাকীর্তি ও চিত্রকর্মগুলো এখন প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। আর অন্যদিকে পুরোদমে চলছে ক্যাথেড্রালটির সংস্কারের কাজ।
১৯৯১ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষিত হওয়া নটর ডেম ক্যাথেড্রাল পাড়ি দিয়ে এসেছে অনেক পথ, ইতিহাসের অনেক ঘটনার নিবিড় পর্যবেক্ষক হয়ে সীন নদীর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই শতবর্ষী ক্যাথেড্রালটি। শুধুমাত্র গির্জা হিসেবে নয়, জাদুঘর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসা প্যারিস নগরীর এই অনন্য স্থাপনাটি তার পূর্বেকার জৌলুস ফিরে পাবে এই আশায় রয়েছে বিশ্ববাসী।
This article is about the history of the age old Notre Dame Cathedral.
Refrences:
1) Notre Dame through the ages in pictures - The Guardian
2) Notre-Dame de Paris: a visual history - Cnet
3) History of Notre Dame Cathedral in Paris - EU Touring
4) A Brief History of Paris’s Notre-Dame - The Culture Trip
5) 10 Facts About the Notre-Dame Cathedral's History You Should Know - The Travel
6) Notre-Dame: Massive fire ravages Paris cathedral - BBC
Feature image: theculturetrip.com