Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জ্যাকিমোভ: ‘হোম অভ ডলারস’ নাকি ‘হোম অভ নো ডলার’?

জ্যাকিমোভ। পশ্চিম চেক প্রজাতন্ত্রের একটি শহর, যা কিনা স্পা’র জন্য বিখ্যাত। জার্মান সীমান্তবর্তী এই শহরটি ওরে পর্বতমালার সর্বোচ্চ শিখর ক্লিনোভেকের পাদদেশে, কারলোভি ভ্যারির ঠিক উত্তরে অবস্থিত। এককালে রোমান সাম্রাজ্যের রৌপ্য উত্তোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত এই শহরটি,  ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানদের আধিপত্যে তার যাত্রার শীর্ষে আরোহণ করেছিল। জার্মান মুদ্রা গণনার একেক ‘টেলার’, যা থেকে আজকের ডলার শব্দটি উদ্ভূত- মূলত জোচিমস্টেলারকেই নির্দেশ করে, যার প্রচলন শুরু হয়েছিল ১৫১৭ সালে জ্যাকিমোভে। ডলারের সাথে জ্যাকিমোভ শহরটির ওতপ্রোত সম্পর্কের গল্প নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।

রয়েল মিন্ট হাউস মিউজিয়াম; Image Source: bbc.com ©️ Eliot Stein

বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রা ডলার এবং বিশ্বব্যাপী মজুদকৃত স্বর্ণের বিনিময় মূল্যও নির্ধারিত হয় ডলারের হিসেবেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ফিন্যানশিয়াল রিজার্ভের ৬২% ডলারে সঞ্চিত যা ইউরো, ইয়েন, রেনমিনবিতে রক্ষিত মোট রিজার্ভের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। বিশ্বের মোট ৩১টি দেশ হয় তাদের সরকারি মুদ্রা হিসেবে ডলারকে গ্রহণ করেছে, নয়তো তাদের নিজেদের মুদ্রার নামে ডলারকে উল্লেখ করেছে এবং ৬৬টি দেশ তাদের মুদ্রার মান ডলারের সাথে সাযুজ্য রেখে হিসেব করে। শুধু আধুনিক বিশ্বেই নয়, বরং ডলার আজ উত্তর কোরিয়া, সাইবেরিয়া এমনকি উত্তর মেরুর জনমানবহীন গবেষণা কেন্দ্রেও সর্বজনস্বীকৃত মুদ্রা হিসেবে গৃহীত হচ্ছে।

অদ্ভুতুড়ে বিষয় হলো, আর্থিক লেনদেনে সমগ্র পৃথিবীব্যপী ডলার মোটামুটি ঈশ্বরের অবস্থান দখল করে বসে থাকলেও একটি শহরে কখনোই ডলারের বিনিময় হয় না। অথচ আজ থেকে ৫০০ বছর আগে ঠিক এই শহরটিতেই ডলারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। চেক-জার্মান সীমান্তঘেঁষা এই শহরটিতে সর্বসাকুল্যে ২৭০০ লোকের বসবাস। শহরটিকে বলা হয় ‘হোম অভ ডলারস’ এবং ‘হোম অভ নো ডলার’! বোহেমিয়া জনপদের নাম তো আমাদের কমবেশি সকলেরই জানা। এই বোহেমিয়ার সাথেই অবধারিতভাবে যে শহরটির নাম চলে আসে, সেটি আর কিছু নয়- ইউনেস্কো কর্তৃক প্রবর্তিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় নব্য সংযোজন ‘জ্যাকিমোভ’। বিশ্বায়নের এই যুগে মুক্ত পৃথিবীর ধারণাকে বেগবান করতে ডলারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ ডলারের উৎপত্তিস্থল এই জ্যাকিমোভ শহরটি এখনও সাম্যবাদের ভাঙন কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং এ এমনই এক শহর, যেখানে ব্যাংকের চেয়ে গণিকালয়ের সংখ্যাই বেশি। 

বোহেমিয়াতে প্রাগের পর জ্যাকিমোভ ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর; Image Source: bbc.com ©️ Eliot Stein

জ্যাকিমোভের বুকে মানুষের পায়ের ছাপ পড়ার বহু আগে, বর্তমান বোহেমিয়া ও স্যাক্সনীকে পৃথককারী পর্বতমালা ও নিকটবর্তী ঘন বন একসময় বন্য নেকড়ে ও ভালুকের অভয়ারণ্য ছিল। ১৫১৬ সালে বিপুল পরিমাণ রূপার খনি আবিষ্কার হওয়ার পর এই অঞ্চলটির ইতিহাস রূপ নেয় অন্য দিকে। ১৫১৯ এর দিকে এসে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। এই মুদ্রার নাম দেওয়া হয় জোচিমস্টেলার, যা উচ্চারণ করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হতো। উচ্চারণের সুবিধার্থে কিছুকাল পরেই এর নাম সংক্ষিপ্ত হয়ে টেলার হলো। মূলত ডলার শব্দটি এই টেলার শব্দের অ্যাংলিসাইজড রূপ।

টেলার মুদ্রার প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন শাসনামলের বহাল রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নকশা করা হতো; Image Source: bbc.com ©️ Eliot Stein

সময়ের পরিক্রমায় টেলার শব্দটির পৃথিবীর দূর-দূরান্তে পরিভ্রমণ শুরু হলো। স্লোভেনিয়াতে টোলার, নেদারল্যান্ডে ডাডলার, সুইডেন-ডেনমার্ক-নরওয়েতে ডেলার এবং প্রুশিয়া, জার্মানিতে টেলার নামে ছড়িয়ে পড়ে এই মুদ্রা। স্কটল্যান্ডেও সপ্তাদশ শতাব্দীতে টেলার মুদ্রা চালু ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডেও মুদ্রা হিসেবে ডলারের প্রচলন ছিল। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকেও ডলারের উল্লেখ পাওয়া যায় (অঙ্ক ১, দৃশ্য ২), যা মঞ্চস্থ হয় ১৬১১ সালে। একই বছর মঞ্চস্থ হওয়া দ্যা টেম্পেস্ট নাটকেও (অঙ্ক ৩, দৃশ্য ১) শেক্সপিয়ার ডলার শব্দটি ব্যবহার করেন।

ঔপনিবেশিক যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত একটি মুদ্রা ছিল ইংলিশ পাউন্ড স্টার্লিং। এই মুদ্রা ব্যবস্থায় বাজারে চলমান একটি মুদ্রার ভর ছিল ১ ট্রয় পরিমাণ স্টার্লিং রূপার (৯২.৫% বিশুদ্ধ রুপা এবং ৭.৫% অপদ্রব্য) সমতুল্য। দ্বিতীয় আরেকটি চলমান মুদ্রা ছিল স্প্যানিশ পিয়াস্ট্রে এবং সর্বাধিক স্বীকৃত ও ব্যবহৃত মুদ্রাটি ছিল টেলার, যা চালু হয় হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়ার রাণী মারিয়া থেরেসার শাসনামলে। 

ইংরেজ সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত হয়ে অ্যামেরিকা যখন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, তখন নতুন একটি মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। তৎকালীন হর্তাকর্তারা চাইলে পাউন্ড স্টার্লিং বা পিয়াস্ট্রেকেই গ্রহণ করতে পারতেন, কিন্তু এসবের পরিবর্তে তারা বেছে নিলেন ডলারকে। ১৭৮৬ সালে থমাস জেফারসন অ্যামেরিকার মুদ্রা হিসেবে ডলার প্রস্তাব করেন এবং এরই ফলস্বরূপ ১৭৯৪ সালে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডলার, অ্যামেরিকার বৈধ মুদ্রা হিসেবে এর যাত্রা শুরু করে। 

জ্যাকিমোভে গোথিক-রেনেসাঁ স্থাপত্যের নিদর্শন; Image Source: bbc.com ©️ dpa picture alliance/Alamy

এ তো গেল ডলার আর যুক্তরাষ্ট্রের মেলবন্ধনের কথা। কিন্তু ডলারের প্রতীক এলো কীভাবে? এ সম্পর্কে অসংখ্য ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে সর্বজনবিদিত দু’টি মতবাদ নিয়ে আমরা আলোচনা করব। প্রথম মতটি হচ্ছে, পিয়াস্ট্রের বহুবচনবোধক চিহ্ন হিসেবে ইংরেজি আপার কেস ‘পি’ (P) এর উপর লোয়ার কেস ‘এস’ (s) বসানো হয়। এই চিহ্নটি পরিবর্তিত হয়ে শেষ অবধি ‘P’ এর আবদ্ধ অংশটি (Loop) বিলুপ্ত হয় এবং ‘P’ এর খাড়া অংশটি ‘s’ এর মধ্যে দিয়ে চলে যায়; আর এভাবেই আজকের ডলারের প্রতীকটি চালু হয়।

এ সম্পর্কে দ্বিতীয় মতবাদটি হলো U.S. মনোগ্রাম ভিত্তিক। ‘U’ এর নীচের আবদ্ধ অংশটি (Bottom loop) বিলুপ্ত হয় এবং ‘S’, অবশিষ্ট দু’টি খাড়া অংশের উপর সমাপতিত হয়। সময়ের পরিক্রমায় দু’টি খাড়া দাগ একীভূত হয়ে আজকের ডলার প্রতীকের যাত্রা শুরু হয়।  

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ওপেনহেইমারের আণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এরপর ১৯৪৯-১৯৬৪ সালের মাঝে প্রায় ৫০,০০০ সোভিয়েত রাজনৈতিক বন্দীকে পর্যায়ক্রমে জ্যাকিমোভে পাঠানো হয় সেখানকার খনিসমূহ থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন ও সংগ্রহের কাজে। পরবর্তী সময়ে এই ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয় সোভিয়েত আণবিক অস্ত্রাগারের জ্বালানি হিসেবে। এ থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দুই পরাশক্তির ভিতটা রচিত হয়েছিল সুপ্রাচীন বোহেমিয়া জনপদেই। শুধু ডলার নামক মুদ্রার যাত্রা নয়, রাশিয়াও পরমাণু শক্তির পথে হাঁটা শুরু করেছিল জ্যাকিমোভের বদৌলতেই।  

ঊনিশ শতকের দিকেই সর্বপ্রথম ইউরেনিয়াম আবিষ্কৃত হয় জ্যাকিমোভের পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে; Image Source: bbc.com ©️ Martin Trabalik

জ্যাকিমোভের মানুষ তাদের হারানো ও আবেগপূর্ণ অতীত নিয়ে প্রতি মুহূর্ত নিজেদের সাথেই যেন যুদ্ধ লড়ছে। যে অঞ্চলটি একসময় শুধু খনিতে খনিতে সয়লাব ছিল, তা আজ সবুজে সবুজে ভরে গেছে। ইউরেনিয়ামের মতো ধাতুর নিষ্কাশনের কারণে যে এলাকা ছিল তেজস্ক্রিতায় পরিপূর্ণ, তা আজ তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। সেই হারানো গোথিক কিংবা রেনেসাঁ স্থাপত্যের হুবহু নিদর্শন হয়তো জ্যাকিমোভ কখনোই ফিরে পাবে না তবুও ছোট্ট শহরতলী তার হারানো ঐতিহ্যের পথে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে।

জ্যাকিমোভের শেষ সক্রিয় রৌপ্যখনি, যা কি না রূপা সরবরাহ করেছিল প্রথম ডলারের জন্য, আজ তা থেকে তেজস্ক্রিয় পানি উত্তোলিত হয়। অত্যন্ত খরুচে একটি স্পা’র জন্যও জ্যাকিমোভ বিখ্যাত- ‘রেডন-ওয়াটার-স্পা‘র জন্য এই পানি ব্যবহৃত হয়।   

রেডন-ওয়াটার-স্পা’র জন্য নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি; Image Source: bbc.com ©️ Matthew Vickery

জ্যাকিমোভের সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো চিহ্নই নেই, যার মাধ্যমে তারা ডলারের জন্মস্থানের প্রতিষ্ঠিত দাবিদার হতে পারে। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই এই সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তবুও যদি ডলারের পঞ্চশতবার্ষিকী উপলক্ষে আপনি রয়েল মিন্ট হাউজ জাদুঘরে গিয়ে ডলার সম্পর্কে কিছু জানতে চান, তারা গর্বের সাথে দেয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে জর্জ ওয়াশিংটনকে দেখিয়ে দেবেন। পরবর্তী ভ্রমণে পাসপোর্টে ডলার এন্ডোর্স করার সময় জ্যাকিমোভকে স্মরণ করতে ভুলবেন না যেন। কে জানে পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে হয়তো বোহেমিয়াই আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে!  

This article is in Bangla language. This is about Jáchymov, the birthplace of dollar.

All the necessary references are hyperlinked in the article. 

Featured Image: bbc.com

Related Articles