Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বড়দিন: মানবতার কাছে হার মেনেছিল নৃশংসতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নির্মম সহিংসতার মধ্যবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই যেন পশ্চিমা যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে বয়ে যায় এক ঝলক স্বস্তির বাতাস। ১৯১৪ সালের কথা। চারপাশে যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে, হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কে কোথায় কী অবস্থায় আছে কেউ জানে না। চারদিকের থমথমে নীরবতার চাদর ছিন্ন করে থেকে থেকেই চলছে গুলি আর কামানের গোলার আঘাত। কিন্তু আচমকাই যেন পাল্টে গেল পুরো পরিস্থিতি। রক্তের বন্যা আর গুলির ধারা থেমে গিয়ে যেন জায়গা করে দিল সৈন্যদের মুখে ফুটে ওঠা হাসির রেখার জন্য, সাধারণ মানুষের ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। কী ছিল সেই উপলক্ষ, যার কারণে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে? কারণ ছিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম বড়দিনের আগমন। শান্তি বার্তা বয়ে আনে বড়দিন, যুদ্ধ নয়। তাই পুরো ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট জুড়ে অনানুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি দিয়ে পালন করা হয় বড়দিন। কেমন ছিল সেই দিনগুলো?

বড়দিনের আগের রাতে ব্রিটিশ আর্মির রাজকীয় আইরিশ রাইফেলসের ক্যাপ্টেন আর্থার ও’সুলিভান অবস্থান করছিলেন ফ্রান্সের রিও ডি বয়েজে। ব্যারাক থেকে জার্মান উচ্চারণে একটি বাক্য কানে আসে তার, ‘রাত ১২টার পরে গুলি করো না, আমরাও করব না’। কিছুক্ষণ নীরবতার পরে যোগ করা হয় পরের লাইনটি, “তোমরা ইংরেজরা যদি ব্যারাক থেকে বের হয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে আসো, আমরা তোমাদের গুলি করব না”। রাইফেলধারী এক আইরিশ সৈন্য আমন্ত্রণের সত্যতা যাচাই করতে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পরে উপহারস্বরূপ হাতে এক প্যাকেট সিগার নিয়ে নিরাপদে ব্যারাকে ফিরে আসে সে, বাকিরাও তখন বুঝতে পারে যুদ্ধক্ষেত্র কিছুক্ষণের জন্য হলেও চেহারা বদলে ফেলেছে। দুই বাহিনীর মধ্যকার নো ম্যানস ল্যান্ড বা সীমান্তরেখা অচিরেই মুখরিত হয়ে ওঠে দুই দলের সৈন্যদের পদচারণায়। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয় বড়দিন উপলক্ষে ১৯১৪ সালের অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি।

শুভেচ্ছা বিনিময়রত সৈন্যদের প্রতীকী ছবি; Source: wikimedia.org

ফ্রান্স আর বেলজিয়ামের অন্য সৈন্যরাও শুনতে পায় ফ্রান্স সীমান্ত থেকে ভেসে আসা গানের সুর। জার্মান সৈন্যরা তখন গাইছে- “Stille Nacht, Heilige Nacht”, অর্থাৎ “নীরব রাত, পবিত্র রাত”। তাদের সাথে সুর মেলাচ্ছে মিত্রপক্ষের সৈনিকরাও। একেকজন একেক ভাষায় যার যার মতো করে গলা ছেড়ে গাইছে বড়দিনের গান। সেই আওয়াজ শুনে কৌতূহলী সৈন্যদের ভিড় বাড়তে থাকে সীমান্তের কাছে। কাছে গিয়ে দেখে জার্মানরা হাতে লণ্ঠন নিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ডাকছে ব্রিটিশদের, বারবার বলছে তাদের কোনো ক্ষতি করবে না জার্মানরা। ক্ষতি তো দূরে থাক, বড়দিনে ‘মেরি ক্রিসমাস’ কথাটা বলার জন্যই তাদের স্বাগত জানাচ্ছে বিরোধী দল। দু’পক্ষের লোকজন মিলিত হয়, হাত মিলিয়ে সিগারেট আর খাবার-পানীয় ভাগ করে সবাই মিলে উদযাপন করে এই যুদ্ধবিরতি। ভ্রাতৃসুলভ কোলাকুলি থেকে শুরু করে বন্দী বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে এই বিশেষ দিনটিতে।

লোকমুখে অতিরঞ্জিত হতে হতে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো প্রায়শই সত্যতা থেকে অনেকখানি দূরে সরে যায়। তাই এক পক্ষ যেমন দাবি করে ‘ক্রিসমাস ট্রুস’ বা ‘বড়দিন উপলক্ষে যুদ্ধবিরতি’র বিষয়টি একেবারে মনগড়া, ঠিক তেমনি অপর পক্ষ দাবি করে এই দিনটিতে নাকি দু’পক্ষের সৈন্যরা মিলে সকারও খেলেছিল। সেদিন তাদের প্রধান বক্তব্য ছিল- “বাঁচো এবং বাঁচতে দাও”। কিছুক্ষণ আগেও যারা একে অপরের জীবন নেয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিল, হঠাৎ করে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা সখ্যতা মানব ইতিহাসে জন্ম দেয় এক অনবদ্য অধ্যায়ের। প্রকাশ্য দিনের আলোয় বেশ বড় সংখ্যক একটি সৈন্যদল যখন পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে, তখন যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলে সাধারণ মানুষের কাছে তা পরিণত হয় একটি আনন্দের দিনে। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এই ধারাটি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে দুই পক্ষ। তবে পরবর্তীতে যুদ্ধের সহিংসতা বাড়তে থাকায় দিন দিন সম্পর্কের তিক্ততাও বাড়তে থাকে তাদের মধ্যে। যার কারণে প্রথম বছরের মতো অন্তরঙ্গতা আর দেখা যায় না।

বড়দিন উপলক্ষে প্রীতি সকার ম্যাচের আয়োজন করে দুই পক্ষ; Source: independent.co.uk

১৯১৪ সালের ক্রিসমাস ট্রুস সম্পর্কে ঐতিহাসিক অ্যালেন ওয়েকফিল্ড বলেন, “যদি আসলেই এই যুদ্ধবিরতি ঘটে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সহযোগিতার মুখোশের আড়ালে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো পক্ষ কোনো চাল চালছিল”। সে যা-ই হোক, জার্মানরা যে এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারে, সেটিই অনেকের কাছে অবিশ্বাসের প্রধান কারণ। ব্রিটিশ এবং জার্মান দল মিলে প্রায় এক লক্ষ সৈন্য সেদিন ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় বলে জানা যায়। তাদের সে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের দেশগুলোর যুদ্ধাহত কিংবা নিরপরাধ, সাধারণ মানুষদের কাছেও। ‘ওপেন ক্রিসমাস লেটার’ নামে সবার উদ্দেশে একটি শান্তির বার্তাবাহী চিঠি লেখে ১০১ জন ব্রিটিশ নারী। সেখানে প্রাপকের নামের জায়গায় লেখা ছিল- ‘জার্মানি আর অস্ট্রিয়ার সকল নারী’র কথা। পোপ পঞ্চম বেনেডিক্ট ১৯১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর যুদ্ধরত দেশগুলোর সরকারের কাছে চিঠি লিখে বলেন, অন্তত বড়দিনের রাতে যেন স্বর্গের দূতদের গানের ভিড়ে গোলাগুলির অশুভ আওয়াজ থেমে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে সে আবেদন গ্রাহ্য করা না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে সে ঘটনাই ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম বড়দিনে।

বড়দিনের এই যুদ্ধবিরতিতে দু’পক্ষের আর্মি কিছুটা সময় পায় যুদ্ধের ময়দান থেকে মৃত আর আহত সৈন্যদের ক্ষতবিক্ষত শরীরগুলো সংগ্রহ করে আনার। মৃত সৈনিকদের পরিবারের জন্য নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় একটি খুশির খবর ছিল। যুদ্ধের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে প্রিয়জনের লাশের দেখা পাবেন, এমনটাও আশা করেননি তারা। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে সৈন্যদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারা। অবশ্য জেনারেল এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকে এই শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রথায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। বেশিরভাগ এলাকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকে ১৯১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, বেশ কিছু এলাকায় শান্তির সাদা পতাকা ওড়ে ১৯১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে একটি গুলিও চলেনি মিত্রপক্ষ ও অক্ষশক্তির ব্যারাক থেকে। সামরিক আইন অনুযায়ী এটি কোনোভাবেই যুদ্ধের রীতিনীতির পর্যায়ে পড়ে না। এর আগে এমন কোনো ছুটির দিন বা উৎসব কেন্দ্রিক যুদ্ধবিরতির নজির পাওয়া যায়নি।

ক্রিসমাস ট্রুস ভাস্কর্য; Source: telegraph.co.uk

তবে সব জায়গার পরিস্থিতি কিন্তু একইরকম ছিল না। গুলি চলেছিল বেশ কিছু ব্যারাকে, যুদ্ধের নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল সান্তা ক্লজকেও। এইচ কোম্পানি হার্টফোর্ডশায়ার রেজিমেন্টের কর্পোরাল ক্লিফর্ড লেইন জানান ব্যারাক থেকে জার্মান সৈন্যরা লণ্ঠন হাতে বের হয়ে আসছে দেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন তারা। এমন সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না ভেবে সৈন্যদের আদেশ দেয়া হয় ব্রাশফায়ার করে ঝাঁঝরা করে দেয়া হোক জার্মানদের। তবে সৈন্যরা শুরুতেই ব্রাশফায়ার না করে খুচরা কিছু গুলি ছোঁড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। “আমাদের ছোঁড়া গুলির প্রতি উত্তরে পাল্টা কোনো গুলি ছোঁড়েনি জার্মানরা। ওরা ওদের মতো উদযাপন করে যাচ্ছিল, তাতে যোগ দিতে আহ্বানও জানায় আমাদের”, সে দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন কর্পোরাল লেইন। “আমাদের বিদ্রূপাত্মক মনোভাবকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে পানীয় আর সিগারেট নিয়েই আনন্দ করতে থাকে ওরা। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো বসে থেকে শেষ পর্যন্ত বড়দিনের কথা বিবেচনা করে ওদের সাথে যোগ দেয় আমার দলের সাধারণ সেনারাও”। সেদিন জার্মানদের আনন্দ মিছিলে অংশ না নেয়ায় পরে বেশ আফসোস করেন তিনি। “ওদের সাথে থাকলে হয়তো খুব ভালো একটা অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়াতে পারতাম আজীবন”, বলেন তিনি।

নিজেদের বিলাসিতাস্বরূপ ব্যবহার্য সিগারেট বিনিময় করে বড়দিন পালন করে সৈন্যরা; Source: christmastruce.co.uk

লাগাতার পাঁচ মাস যুদ্ধের পর এই সাময়িক বিরতি সৈন্যদের কাছে কতটা আকাঙ্ক্ষিত হতে পারে, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা বেশিরভাগ সৈন্যই ছিল বয়সে তরুণ, ঘরমুখো। যুদ্ধ যে এত দীর্ঘমেয়াদি হবে, তা বুঝতেও পারেনি অনেকে। কম বয়সে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন তাদের ঝুলিতে ঢুকেছে, ঠিক তেমনি প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের ছাঁকনিতে বাদ পড়ে যাওয়া কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সুখবরের ছোঁয়ায় জীবনকে নতুন করে চেনার সুযোগও পেয়েছিল তারা। সে সময়কার যুদ্ধবিরতিতে অংশ নিয়ে বড়দিন পালন করা যোদ্ধাদের বলা হয় ‘সময়ের সেরা ভদ্রলোক’। ঘোরতর শত্রুদের সামনে দাঁড়িয়ে যারা উৎসব পালনের জন্য একত্র হওয়ার আহ্বান জানাতে পারে, তাদের বুকের পাটা আছে মানতেই হবে। সামরিক আইনে তা যতই নির্বোধের মতো কাজ হোক না কেন, মানবতার কাছে তা আজীবন উদাহরণ হয়েই থাকবে।

ফিচার ইমেজ- thesun.co.uk

Related Articles