Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্রিটিশ রাজের শেষ দিনগুলো: অ্যান রাইটের সাক্ষাৎকার

ব্রিটিশ শাসনের প্রায় ২০০ বছরের সমাপ্তি ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। কিন্তু যে ব্রিটিশ শাসকগণ কাজের খাতিরে অনেকটা সময় ভারতে কাটিয়েছিলেন, তাদের পরিবারের কেউ কেউ ভারতেই থেকে গিয়েছিলেন বাকিটা জীবন। অ্যান রাইট তাদেরই একজন, যিনি বেড়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশ রাজের শেষ দিনগুলোতে, সেই স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো বর্ণনা করেছিলেন বিবিসির লুসি বার্নসের কাছে। পরবর্তীতে এই সাক্ষাৎকারটি বিবিসি বাংলার ‘ইতিহাসের সাক্ষী’  নামক পর্বে মোয়াজ্জেম হোসেন পরিবেশন করেন।

কিশোরী অ্যান রাইট; Image source: pinterest.com

অ্যান রাইট ১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডে জন্মলাভ করেন, মাত্র এক বছর বয়সে তিনি তার পরিবারসহ ভারতে আসেন। অ্যান তার নিজের ও তার ছোট বোনের শৈশবকালের কিছু চমকপ্রদ ঘটনার বরাত দিয়ে বলতে থাকেন

আমাদের ছেলেবেলাটা ছিলো খুবই মজার। আমরা যা চাইতাম,তা-ই পেতাম। আমরা যেন স্বর্গে বাস করতাম। আমার বাবা কাজ করতেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে, যা I.C.S (Indian Civil Service) নামে পরিচিত ছিল। এরাই তখন ভারতের প্রশাসন চালাতো। আমার এক বছর বয়সে আমরা প্রথম ভারতে আসি, জায়গাটা ছিল মধ্যভারতের জঙ্গলে।

বাবা তখন ছিলেন খুবই জুনিয়র একজন অফিসার, সম্ভবত এজন্যই তাকে দুর্গম অঞ্চলটিতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আমাদের গরুর গাড়ি, হাতির পিঠ এবং ঘোড়ায় করে যাতায়াত করতে হতো। আমাদের সাথে একজন পরিচারিকা এসেছিলো। কিন্তু সে ভারতে থাকলো না, চলে গেলো। ওর অভিযোগ ছিল, তাঁবুর ছিদ্র দিয়ে লোকজন নাকি তাকে লুকিয়ে দেখতো। আমার বাবা অবশ্য বলতো, ওর চেহারা এত উদ্ভট, ওর দিকে কে তাকাবে! তাকানোর প্রশ্নই আসে না।

যা-ই হোক, ও চলে গেলো। ওর বদলে একজন চমৎকার পরিচারিকা এলো। বহুদিন সে আমাদের সাথে ছিল। আসলে আমরা বেড়ে উঠেছি এই পরিচারিকাদের ছায়ায়। কারণ তখন আমরা স্কুলে যেতাম না। আমাদের সারাবেলা কাটতো বিছা-কেঁচো-মাকড়সা এসব ধরে; পরিচারিকার বালিশের নিচে আমরা এসব লুকিয়ে রাখতাম। পুরো ছেলেবেলা আমাদের কেটেছে এই কুকুর-ঘোড়া-হাতি এসবকে ঘিরে। তিনটে হাতি ছিলো আমাদের; আমার সবচেয়ে প্রিয় হাতির নাম ছিলো ‘রুখালি’। খুব ভদ্র হাতি ছিল। আমি একা একাই হাতির পিঠে চড়তে পারতাম।

ভারতে নিজেদের বাড়িতে অ্যান ও তার ছোটবোন; Image source: bbc.com
ভারতে  ব্রিটিশ শাসকদের শিকারে যাওয়ার দৃশ্য; Image source: pinterest.com

কিন্তু একজন ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্মকর্তার সন্তান হিসেবে স্থানীয়দের সাথে তারা কতটা মেলামেশা করতে পারতেন?

“ওহ! আমরা সারাক্ষণ ওদের সঙ্গে থাকতাম,ওরা আমাদের ঘিরে থাকতো। আমাদের এক বৃদ্ধ বেয়ারা ছিল, ওর নাম ছিলো ‘কালু খান’। বাবা যখন ভারতের বোম্বে যান, তখন বাবার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কালু খানের সাথে। তারপর সারাটা জীবন ও আমাদের সাথে ছিল। কালু খান ছিল খুব মোটা। সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে একসময়। বীরত্বের জন্যে ও অনেক পদক জিতেছিল। ও পদকগুলো রান্নাঘরে ঝুলিয়ে রাখতো। তা দেখে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম।”

অ্যানের বাবার ছিলো বদলির চাকরি, সেই সুবাদে তাদেরকে ব্রিটিশ ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে অ্যান বলেন-

“বাবাকে কোনো একটা জায়গায় বছর দুয়েক থাকতে হতো, তারপর আবার বদলি করা হতো। দুঃখের কথা হলো,আমরা এক জায়গায় খুব বেশিদিন থাকার সুযোগ পেতাম না। তবে যখন আমরা নতুন জায়গায় যেতাম, আমাদের সমস্ত কিছু সঙ্গে যেত। আমাদের আসবাবপত্র, কুকুর- সবকিছু। আমরা যেন চলছি একটা ক্যারাভ্যান নিয়ে।”

[অ্যানের কাছ থেকে জানা যায়, অনেক বছর প্রত্যন্ত এলাকায় থাকার পর অবশেষে তার বাবাকে বদলি করা হয় দিল্লিতে]

“বাবা প্রায় ৮ বছর দিল্লির ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। পুলিশবাহিনী ছিল তার অধীনে। সেটা ছিলো খুব কঠিন একটা সময়। তখন চলছিলো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। তবে আমাদের ছোটদের এসব কিছুর বাইরে রাখা হতো। আমার মনে পড়ে, একবারই আমরা বিপদে পড়েছিলাম; আমার মা তখন দিল্লির জয়পুর রোডের বাড়িতে, তখন জানা গেলো প্রায় ৮০,০০০ মানুষের মিছিল সেদিকে যাচ্ছে। আমার মা বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন, তিনি বললেন, “আমার কী করা উচিত! বাড়ির গেটটা কি বন্ধ করে দেবো!” তিনি গেটটা বন্ধ করে দিলেন, লোকজন মিছিল করে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেলো।”

তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছিলো, লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারত ছাড় আন্দোলনে (১৯৪২) যোগ দিতে লাগল; Image source: indiatoday.in

অ্যান বলতে লাগলেন-

“প্রথমদিন থেকেই বাবা বুঝতে পেরেছিলেন ভারত স্বাধীন হতে যাচ্ছে, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে তিনি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তখন যুদ্ধ চলছিল (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ), জাপানীরা ভারতের দোরগোড়ায়। কাজেই যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি মূলতবি রাখতে হলো। তবে ভারতের স্বাধীনতা তখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। একটা জাতির উপর তো দীর্ঘদিন চেপে থাকা যায় না। একসময় জনগণকে তার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে হয়।”

ভারত ছাড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মহাত্মা গান্ধী; Image source: vina.cc

সেসময় ভারত আর ব্রিটেনের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধাজনক ছিলো না, তাই ছুটি কাটানোর জন্য অ্যান ও তার বোনের ইংল্যান্ডে তেমন একটা যাওয়া হতো না। অ্যানের যখন ১২ বছর বয়স, তখন তাদের মা মারা যান। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে তাদের বাবা তাদেরকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। ইংল্যান্ডে সময়গুলো কেমন কাটছিলো? এতগুলো বছর ভারতে থাকার পর তারা কি সেখানে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন? এমন সব প্রশ্নের উত্তরে অ্যান বলেন-

“আমার মা মারা যাওয়ার আগে আমাদের জন্য একটা স্কুল পছন্দ করে রেখেছিলেন; তাতে বাবা আমাদের ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্কুলটি ছিলো চমৎকার। কিন্তু সেখানে আমরা খুবই কষ্টে ছিলাম। আমরা স্কুলটি পছন্দ করতাম না। আমাদের মনে হতো, ভারতের মতো একটা উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে আমাদেরকে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বৃষ্টি, ঠাণ্ডা- সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডকে আমাদের খুবই বাজে একটা জায়গা বলে মনে হতে লাগলো। আমার পালাতে মন চাইছিলো, কিন্তু পালিয়ে যাবোই বা কোথায়!”

ইংল্যান্ডে বসে ভারতের কোন জিনিসটার শূন্যতা অনুভব করতেন?

“ভারতের সবকিছুর জন্যই আমার মন খারাপ লাগছিল, আমাদের বন্ধুবান্ধব, হাতি, ঘোড়া, কুকুর। আমার মনে হচ্ছিল, আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম!”

কিন্তু অ্যান যখন ইংল্যান্ডে, তখন খুব দ্রুতই বদলে যেতে লাগল গোটা ভারতবর্ষ। একটা সময় অ্যান তার বাবার কাছে জানতে চাইলেন, তিনি ভারতে ফিরে আসতে পারবেন কি না!

“বাবা বলছিলেন যে, “তুমি চাইলে আসতে পারো, নইলে ইংল্যান্ডে থাকতে পারো। সেখানে পার্টি করতে পারবে, নাচ করতে পারবে। আমি বললাম, “না আমি ভারতেই যাবো।” আসলে সেখানে আরো বেশি পার্টি-নাচ চলছিল, কারণ ব্রিটিশ রাজ তখন শেষের পথে। মাউন্ট ব্যাটেন তখন দিল্লিতে; তার মেয়েদের সাথে আমার ভালো ভাব ছিলো। আমরা তখন নানা পার্টিতে বেশ মজা করছিলাম।”

লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কন্যাদ্বয়- প্যাট্রিসিয়া ও পামেলা; Image source : pinterest.com

অবশেষে ভারতে ব্রিটিশ রাজের অবসান ঘটলো। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে লাগল । ভারতে ব্রিটিশ রাজের অবসান ঘটলেও অ্যান ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

দেশভাগ ও ভারতে ব্রিটিশ-শাসন অবসান সংক্রান্ত বৈঠকে জওহরলাল নেহেরু, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও জিন্নাহ; Image source: bharatabharati.wordpress

“আসলে ছোটবেলায় আপনি যে জায়গায় বেড়ে ওঠেন, সে জায়গাটাকে আপন জায়গা বলে মনে হয়; সেখানকার ভাষা, আবহাওয়া, খাবার আপন হয়ে ওঠে। আমি ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছি। অবশ্য সেজন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, অনেকের সাহায্য নিতে হয়েছে। আমার পার্সপোর্টটা কিন্তু বেশ মজার! সেখানে লেখা আছে, আমার ব্রিটেনে বসবাস করারও অধিকার আছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, আমি এই দুই দেশের সব ভালো দিক উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি।”

অ্যান রাইট; Image source: kiplingcamp.wordpress

এরপর থেকে অ্যান রাইট ভারতে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের একজন খ্যাতিমান প্রকৃতি সংরক্ষণবাদী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি WWF-India এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ছিলেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবাদী হিসেবে তার কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয়।

ফিচার ইমেজ: source: bbc.com

Related Articles