Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গাদ্দাফীর জীবনের শেষ দিনগুলো

আফ্রিকার লৌহমানব হিসেবে পরিচিত লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফী ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৬৯ সালে, মাত্র ২৭ বছর বয়সে। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বের রক্তিম চক্ষু উপেক্ষা করে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেছেন দোর্দন্ড প্রতাপে। মার্কিন, ব্রিটিশ এবং ইতালিয়ান সেনা ঘাঁটি উচ্ছেদ করে এবং লিবিয়ার তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করে, লিবিয়াকে তিনি পরিণত করেছিলেন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী এবং শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রে।

কিন্তু ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ছোঁয়া লিবিয়াতে লাগার পরে গাদ্দাফীর নিজের কিছু ভুল ও অদূরদর্শিতার কারণে, আরব রাষ্ট্রগুলোর বিশ্বাসঘাতকতায় এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ষড়যন্ত্রে লিবিয়ার বিপ্লব রূপ নেয় সহিংস গৃহযুদ্ধে। দীর্ঘ আট মাসের এ গৃহযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে, যখন সাড়ে ১৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের লিবিয়ার মধ্যে শুধুমাত্র তার জন্মস্থান সিরত শহরের মাত্র ২ থেকে ৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিদ্রোহীদের হাতে পতনের বাকি ছিল, তখন চারিদিকে শত্রুবেষ্টিত সেই এলাকা থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় ন্যাটোর বিমান হামলা এবং বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হন গাদ্দাফী। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, বিদ্রোহীদের হাতে ধরা খাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অবর্ণনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়।

১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর গাদ্দাফী এবং তার সহযোগী অফিসাররা; Source: Getty Images

অনেক রাজনৈতিক সমালোচকই ধারণা করছিলেন, গাদ্দাফী হয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন, অন্য কোথাও আশ্রয় নিবেন। যুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাদ্দাফী ভেনেজুয়েলায় পালিয়ে গেছেন। কিন্তু তখনই গাদ্দাফী বলেছিলেন, তিনি কখনও লিবিয়া ছেড়ে যাবেন না। যে দেশে ইতালিয়ান উপনিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তার দাদার কবর আছে, যে দেশটিকে তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন, প্রয়োজনে তিনি যুদ্ধ করে মারা যাবেন, কিন্তু বহিঃশক্তির হাতে সে দেশের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে তিনি অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যাবেন না। গাদ্দাফী তার কথা রেখেছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিনি লিবিয়াতেই থেকে গিয়েছিলেন।

কেমন ছিল গাদ্দাফীর জীবনের শেষ দিনগুলো? চারদিক থেকে বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ শহরে এবং আকাশ থেকে ন্যাটোর বিরামহীন বোমা বর্ষণের নিচে কেমন ছিল তার মানসিক অবস্থা? বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসবিহীন অবস্থায় কীভাবে তিনি সময় কাটাতেন? কী করতেন সারাদিন? কী খেতেন? কী বলতেন? এসবের অনেক তথ্যই বিভিন্ন সময় পত্রিকার পাতায় উঠে এসেছে গ্রেপ্তার হওয়া গাদ্দাফীর কাছের মানুষদের জবানবন্দীতে, যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গাদ্দাফীর সঙ্গে ছিলেন।

বিদ্রোহ শুরুর পর ২২শে ফেব্রুয়ারি জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণে গাদ্দাফী; Source: You Tube

গাদ্দাফীর জীবনের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত বর্ণনা উঠে আসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এবং আল-জাজিরানিউ ইয়র্ক টাইমসের দুটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে আল-জাজিরা এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন দুটি মূলত গাদ্দাফীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী এবং চাচাতো ভাই মানসুর দাওয়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারের অনুলিখন।

মানসুর দাও দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ, পিপল’স গার্ডের প্রধান ছিলেন। শেষ দিনগুলোতে তিনি গাদ্দাফীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০ অক্টোবর, গাদ্দাফীর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি গাদ্দাফীর সাথে ছিলেন। যুদ্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তে মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর বিদ্রোহীরা তাকে গ্রেপ্তার করে মিসরাতায় নিয়ে যায়। সেখানে এক অস্থায়ী কারাগারে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সাংবাদিকরা।

ত্রিপলী থেকে প্রস্থান

আগস্ট মাস পর্যন্ত গাদ্দাফী লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলীতেই ছিলেন। আগস্টের ২০ তারিখে বিদ্রোহীদের হাতে ত্রিপলীর পতনের প্রাক্কালে তিনি সপরিবারে ত্রিপলী ত্যাগ করেন। তবে তাদের সবার গন্তব্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন। গাদ্দাফীর ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গিয়েছিলেন গাদ্দাফীর সমর্থকদের শক্তিশালী ঘাঁটি, পার্বত্য শহর বানি ওয়ালিদে। তার আরেক ছেলে খামিস, যিনি লিবিয়ান সেনবাহিনীর ৩২ নম্বর ব্রিগেড পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি ত্রিপলী ছেড়ে যাওয়ার পথে তারহুনায় ন্যাটোর বিমান হামলায় নিহত হয়েছিলেন। আর গাদ্দাফীর স্ত্রী সাফিয়া, কন্যা আয়েশা সহ পরিবারের বাকি ছেলেদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র আলজেরিয়ায়।

ত্রিপলীর পতনের পূর্ব মুহূর্তে ভক্তদের সাথে সাইফ আল-ইসলাম; Source: MSN

ত্রিপলী থেকে বেরিয়ে গাদ্দাফী রওনা হয়েছিলেন ৪৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উপকূলীয় শহর সিরতে। তার সাথে ছিল তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার এবং কিছু বডিগার্ড। সিরত গাদ্দাফীর জন্মস্থান এবং তার সমর্থকদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। সেখানে আগে থেকেই তার আরেক ছেলে মৌতাসেম বিল্লাহ পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। গাদ্দাফী সিরতে গিয়ে তার কাছে আশ্রয় নেন।

মানসুর দাও তখন পর্যন্ত গাদ্দাফীর সাথে ছিলেন না। তিনি পৃথকভাবে গাদ্দাফীর সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান এবং গাদ্দাফীর ভগ্নিপতী আব্দুল্লাহ সেনুসী এবং গাদ্দাফীর ছেলে সাইফ আল-ইসলামের সাথে প্রথমে বানি ওয়ালিদে যান, পরে সাইফকে সেখানে রেখে সিরতে গিয়ে গাদ্দাফীর সাথে যোগ দেন। আব্দুল্লাহ সেনুসী প্রথমে তাদের সাথে থাকলেও তার ছেলের মৃত্যুর সংবাদ দিতে দক্ষিণাঞ্চলের শহর বোরাক আশ্‌-শাতীতে যান এবং এরপর থেকে সেখানেই অবস্থান করেন।

সিরতে প্রথম দিকের দিনগুলো

সিরতে গিয়ে গাদ্দাফী এবং তার সঙ্গীসাথীরা প্রথমে শহরের কেন্দ্রে কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে অবস্থান নেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে বিদ্রোহীরা সিরত আক্রমণ শুরু করলে যখন মর্টার এবং গ্র্যাড মিসাইলগুলো তাদের আশেপাশে এসে পড়তে শুরু করে, তখন তারা ধীরে ধীরে শহরের কেন্দ্রস্থল ছেড়ে ভেতরের দিকে ‘রক্বম এতনীন’ তথা ডিসট্রিক্ট নাম্বার টুতে অবস্থান নিতে বাধ্য হন। গাদ্দাফীর ছেলে মৌতাসেম এ সময় তাদের সাথে থাকতেন না। তিনি সম্মুখভাগে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, যদিও প্রায়ই এসে গাদ্দাফীকে দেখে যেতেন।

মানসুর দাও জানান, তিনি এবং আব্দুল্লাহ সেনুসী সিরতে পৌঁছেই গাদ্দাফীকে ত্রিপলীর পতনের সংবাদ দিয়েছিলেন। তারা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে রাজধানীরই পতন হয়ে গেছে, সেখানে আর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। তারা তাকে ক্ষমতা ছেড়ে অন্য কোনো দেশে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু গাদ্দাফী এবং তার ছেলে মৌতাসেম তাদের কথা বিবেচনায়ই নেননি। গাদ্দাফীর বক্তব্য ছিল, অন্যরা চাইলে চলে যেতে পারে, কিন্তু তিনি অন্য কোনো দেশে পলাতক জীবন যাপন করা অথবা গ্রেপ্তার হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে নিজের দেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করাকেই বেশি পছন্দ করেন।

সাংবাদিকদের সামনে মানসুর দাও, গাদ্দাফীর মৃত্যুর পরদিন; Source: New York Times

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সিরত পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন একটি শহরে পরিণত হয়। বিদ্রোহীরা চতুর্দিক থেকে ধীরে ধীরে শহরটিকে ঘিরে ফেলতে থাকে। সিরতে গাদ্দাফীর কোনো সেফ হাউজ বা ভূ-গর্ভস্থ নিরাপদ আশ্রয় ছিল না। গাদ্দাফী এবং তার সঙ্গীসাথীরা ডিস্ট্রিক্ট টু-এর পুরানো আমলে তৈরি একতলা বাড়িগুলোতেই আশ্রয় নিতে থাকেন।

দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার কারণে তাদের তখন যথেষ্ট খাবারও ছিল না। তারা এলাকার মানুষের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোতে যেসব খাবার পেতেন, সেগুলো খেয়েই জীবন ধারণ করতেন। অধিকাংশ সময়ই তাদেরকে কোনো মাংস বা সব্জি ছাড়া শুধু ভাত এবং মাকরোনা (পাস্তা) খেয়ে দিন কাটাতে হতো। লিবিয়ানদের প্রধান খাবার রুটি বানানোর মতো ময়দাও তাদের সংগ্রহে ছিল না। গাদ্দাফীর জন্যও পৃথক খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মানসুর দাও সহ অন্য চার-পাঁচজনের সাথে একই পাত্রে একই খাবার খেতেন গাদ্দাফী।

মানসুর দাওয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, গাদ্দাফী দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন নামায এবং কুরআন শরিফ পড়ে। শহরে তখন বিদ্যুৎ সংযোগ, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সংযোগ- কিছুই ছিল না। পুরো পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় তিনি টেলিভিশন দেখে সংবাদও জানতে পারতেন না। মাঝে মাঝে তিনি তার স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করে খোঁজ-খবর জানার চেষ্টা করতেন। এর বাইরে তার আর কোনো কাজ ছিল না। গাদ্দাফী এবং তার ঘনিষ্ঠদের সময় কাটত শুয়ে-বসে।

১৪ই অক্টোবরে ডিসট্রিক্ট টুর পূর্ব প্রান্তে হাইডলার রোড; Source: Getty Images

সে সময় অবশ্য সিরতে বিদ্রোহীদের সাথে গাদ্দাফীর সমর্থকদের তুমুল যুদ্ধ চলছিল। লিবিয়ান সেনাবাহিনী নামে কোনো কিছু তখন আর অবশিষ্ট ছিল না। গাদ্দাফীর সাথে থাকা তার ঘনিষ্ঠদের ছেলেরা এবং সিরতের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী যুবকরাই মূলত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। আর তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মৌতাসেম। গাদ্দাফী যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো রকম খোঁজ খবরই রাখতেন না।

শুধু শেষ দিনগুলোতে না, মানসুর দাওর মতে বিদ্রোহের শুরু থেকেই যুদ্ধের উপর গাদ্দাফীর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। গাদ্দাফীর ছেলেরাই যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। প্রকৃত ক্ষমতা ছিল তাদের হাতেই; বিশেষ করে সাইফ, মৌতাসেম এবং খামিসের হাতে। গাদ্দাফীর বড় ছেলে মোহাম্মদ সব সময়ই রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। তার আরেক ছেলে সা’দী, যিনি ফুটবলার হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন, তিনি যুদ্ধের ব্যাপারে বাকি তিন ভাইয়ের সাথে একমত ছিলেন না। ফলে তিনি তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন। আর গাদ্দাফীর ছোট ছেলে সাইফ আল-আরব ছিলেন বিদ্রোহ দমনের পুরোপুরি বিরুদ্ধে, কিন্তু যুদ্ধের শুরুর দিকেই তিনি ন্যাটোর বিমান হামলায় নিহত হয়েছিলেন।

তীব্র যুদ্ধে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের সময়গুলো

ন্যাটোর বিমান হামলার ভয়ে গাদ্দাফী এবং সঙ্গীরা এক বাড়িতে বেশিদিন থাকার ঝুঁকি নিতেন না। তারা প্রতি চার-পাঁচ দিন পরপর বাসা পরিরর্তন করতেন। তারা অপেক্ষা করতেন, কোনো বাসার অধিবাসীরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই তাদের বাসায় গিয়ে উঠতেন। এলাকা মানুষ যদিও গাদ্দাফীর অবস্থানের কথা জানত না, কিন্তু তারা জানত, এলাকার গেরিলা যোদ্ধাদের বাসাগুলোতে প্রবেশের দরকার হতে পারে। তাই তারা অধিকাংশই শহর ছেড়ে যাওয়ার সময় দরজা খোলা রেখে যেত।

ন্যাটোর চোখে পড়ার ভয়ে গাদ্দাফীর সঙ্গীরা একসাথে বেশি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করত না। বাসা পরিবর্তন করার সময় তারা একটি-দুইটি গাড়ি ব্যবহার করত। সেগুলোই প্রতিবার তিন-চারজনকে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে যেত বাকিদেরকে নেয়ার জন্য। এর মধ্যে প্রায়ই বিদ্রোহী সেনাদের মর্টার বা গ্র্যাড মিসাইল তাদের বাসায় আঘাত করত। তখন তাদেরকে আবার বাসা পরিবর্তন করতে হতো।

এরকম একটি আঘাতে একবার তাদের সাথে সাথে থাকা তিন প্রহরী আহত হয়েছিল। কিন্তু তাদের চিকিৎসা করার মতো কোনো ডাক্তার বা কোনো ওষুধপত্রও তাদের কাছে ছিল না। বিদ্রোহীদের মিসাইলে গাদ্দাফীদের বাবুর্চিও আহত হয়েছিল। ফলে দলের সবাইকে পর্যায়ক্রমে রান্নায় অংশগ্রহণ করতে হতো। গাদ্দাফী নিজে অবশ্য রান্না করতেন না, কিন্তু তিনি প্রায় সময়ই নিজের এবং অন্যদের জন্য চা তৈরি করতেন।

১৯শে অক্টোবর তারিখে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ডিসট্রিক্ট টু; Source: Getty Images

শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। গ্যাস সিলিন্ডারের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্তত তিন মাস ধরেই মানুষকে মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে হতো। এ সময় বিদ্রোহীদের এলোপাথাড়ি গোলা নিক্ষেপে বাসার ছাদের উপরে থাকা পানির ট্যাংকগুলোও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। পানি, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিন কাটাতে কাটাতে গাদ্দাফী ধীরে ধীরে অধৈর্য্য হয়ে উঠতে থাকেন। বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তিনি প্রায়ই রেগে উঠতেন। মানসুর দাও জানান, তখন তারা তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য তার পাশে গিয়ে বসলে গাদ্দাফী প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন এই বলে যে, কেন বিদ্যুৎ নেই? কেন পানি নেই?

মানসুর দাও জানান, এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গাদ্দাফীর চেহারায় কখনোই ভয়ের ছাপ দেখা যায়নি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত শান্ত ছিলেন। মৃত্যুর জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তিনি সব সময় বলতেন, হয়তো সিরতে অথবা ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী যে গ্রামটিতে তার জন্ম হয়েছিল, সেই জারফে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। তবে গাদ্দাফী তার বন্ধু রাষ্ট্রনায়কদের উপর প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ ছিলেন। বিশেষ করে ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুস্কোনি, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগানের উপর তিনি প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। এদেরকে তিনি ব্যক্তিগত বন্ধু মনে করতেন, কিন্তু তার বিপদে এরা তার পাশে না দাঁড়িয়ে তাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে শামিল হওয়ায় তিনি হতাশ ছিলেন।

সিরত ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি

সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে বিদ্রোহীরা রক্বম এতনীন তথা ডিস্ট্রিক্ট টুয়ের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মাত্র দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ অবস্থায় উপর থেকে ন্যাটোর বিমান হামলা আর বিদ্রোহীদের মেশিনগান, রকেট আর মর্টারের আক্রমণে গাদ্দাফী এবং তার সঙ্গীদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অবশেষে মৌতাসেম সিদ্ধান্ত নেন, তারা বিদ্রোহীদের ব্যূহ ভেদ করে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর জারফে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। সেখানে হয়তো তারা গাদ্দাফীর আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রয়ে থাকতে পারবেন, অথবা পরবর্তীতে সেখান থেকে অন্য কোথাও যেতে পারবেন।

সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ২০ অক্টোবর, ভোর সাড়ে তিনটা বা চারটার দিকে ৪০টির মতো গাড়িতে করে তারা বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেউই প্রশিক্ষিত সেনা সদস্য ছিল না, তারা অধিকাংশই ছিল বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবী। তাদের কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছিল, কেউ ব্যাপারটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় নি; আর যারা গুরুত্ব দিয়েছিল, তারাও রাতের অন্ধকারে এতগুলো গাড়ি জোগাড় করতে গিয়ে এবং আহতদেরকে তুলতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছিল।

মৃত্যুর অভিমুখে যাত্রা

মানচিত্রে গাদ্দাফীর শেষ যাত্রা; Source: BBC

তাদের যাত্রা শুরু করতে করতে সকাল আটটা বেজে যায়। ততক্ষণে দিনের আলো ফুটে উঠেছে, বিদ্রোহীরাও রাস্তায় টহল দিতে শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৪০টি গাড়ির বহরে করে ১৬০ থেকে ১৮০ জনের মতো সদস্যের দলটি ডিস্ট্রিক্ট টু থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করে। এই বহরের একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার জীপে ছিলেন গাদ্দাফী। তার সাথে ঐ গাড়িতে ছিলেন মানসুর দাও, গাদ্দাফীর এক নিকটাত্মীয় এবং ড্রাইভার।

সে সময় তাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল, যেকোনো উপায়ে এই মৃত্যুপুরী থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কোন পথ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, কোন পথে বিদ্রোহীদের কয়টি চেকপয়েন্ট, বিদ্রোহীদের সৈন্যসংখ্যা সর্বমোট কত, তার কিছুই তাদের জানা ছিল না। যাত্রা শুরু করার আগে যে অনুসন্ধানী দল পাঠানো হবে, সে উপায়ও তাদের ছিল না।

গাদ্দাফীর গাড়ির বহরটি পরিত্যাক্ত এলাকার ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একটু সামনে গিয়েই তারা বিদ্রোহীদের একটি ছোট মিলিশিয়া গ্রুপের মুখোমুখি হয়। কিন্তু গ্রুপটি ছোট হওয়ায় গাদ্দাফীর সাথে থাকা স্বেচ্ছাসেবীরা সহজেই তাদেরকে পরাজিত করে ঐ এলাকা থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠে পড়তে সক্ষম হয়।

ন্যাটোর বিমান হামলায় বিদ্ধস্ত গাদ্দাফীর গাড়িবহর; Source: Reuters

কিন্তু মূল রাস্তায় উঠে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়া মাত্রই তাদের গাড়িবহর ন্যাটোর চোখে পড়ে যায়। ন্যাটোর যুদ্ধবিমান পরপর দুটো মিসাইল নিক্ষেপ করে, যার মধ্যে একটি সরাসরি গাদ্দাফীর সামনের গাড়িটিকে ধ্বংস করে দেয়। বিস্ফোরণের আঘাতে গাদ্দাফীর গাড়ির এয়ার ব্যাগ খুলে যায় এবং মিসাইলের টুকরো এসে মানসুর দাওর কপালে আঘাত করে। এ সময় গাদ্দাফীর পরনে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং মাথায় হেলমেট ছিল, কিন্তু তারপরেও তিনিও সামান্য আহত হন।

তারা গাড়ি পাল্টে অন্য গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু সবগুলো গাড়িই মানুষে ভর্তি ছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল আহত। তাছাড়া বিস্ফোরণের আঘাতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। গাড়ি না পাল্টেই তারা আবার যাত্রা শুরু করেন। ন্যাটোর হামলা থেকে বাঁচার জন্য মূল রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে আবারও পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের ঠিক সামনেই ছিল বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের একটি ঘাঁটি।

বিদ্রোহীদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ

যে কালভার্টের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিলেন গাদ্দাফী; Source: AFP

উপায় না দেখে মৌতাসেম এই ঘাঁটি ভেদ করেই এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তারা সোজা বিদ্রোহীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ শুরু করেন। কিন্তু সাথে সাথে মেশিনগান, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট আর মিসাইল দ্বারা পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়। সেই সাথে উপর থেকে বিমান হামলা শুরু করে ন্যাটো। গাদ্দাফী এবং তার দল নিরুপায় হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন এবং পাশে অবস্থিত একটি খামারের মধ্যে থাকা দুটি পুরানো বাড়ির দিকে অগ্রসর হন।

সেখানে তাদের সাথে মৌতাসেমের আবার দেখা হয়, যিনি গাড়ি বহরের একদম সামনে থাকার কারণে আহত হয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখেও মৌতাসেম ৮-১০ জন যোদ্ধাকে নিয়ে আবার বেরিয়ে যান এই বলে যে, তিনি পাল্টা আক্রমণ করে বিকল্প রাস্তা বের করার চেষ্টা করবেন। বিদ্রোহীদের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট আর মেশিনগানের ২৩ মিলিমিটার গুলি বাড়িটির দেয়াল ভেদ করে ঢুকতে শুরু করলে মানসুর দাও গাদ্দাফী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু বকর ইউনুস জাবেরকে নিয়ে রাস্তার পাশেই একটি নির্মাণাধীন কালভার্টের উদ্দেশ্যে ছুটে যান।

বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার পর রক্তাক্ত গাদ্দাফী; Source: You Tube

তাদের উদ্দেশ্য ছিল কালভার্টের ভেতর দিয়ে রাস্তার অন্যপাশে গিয়ে সেদিকে বিকল্প আশ্রয়ের সন্ধান করা। কিন্তু কালভার্টের ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র তারা বিদ্রোহীদের চোখে পড়ে যান। বিদ্রোহীরা এগিয়ে আসতে থাকলে গাদ্দাফীর সাথে থাকা এক যোদ্ধা বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। পরপর দুটি গ্রেনেড মারার পর তৃতীয়টি কনক্রীটের দেয়ালে বাধা পেয়ে ফিরে এসে গাদ্দাফী ও আবু বকর ইউনুসের মাঝামাঝি পড়ে যায়।

যোদ্ধাটি তাড়াতাড়ি গ্রেনেডটি তুলে আবার ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে সেটি বিস্ফোরিত হয়ে যায় এবং যোদ্ধাটির হাত উড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যায়। বিস্ফোরণের আঘাতে মানসুর দাও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আবু বকর ইউনুসও গুরুতর আঘাতে অজ্ঞান হয়ে যান এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন। গাদ্দাফী তার মাথার বাম পাশে আঘাত পান এবং তার মুখ রক্তে ভেসে যেতে থাকে।

গ্রেপ্তার এবং মৃত্যু

বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার পর গাদ্দাফী; Source: You Tube

বিদ্রোহীরা কালভার্টের দিকে এগিয়ে আসে এবং গাদ্দাফীকে চিনতে পেরে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তারা গাদ্দাফীকে কালভার্ট থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে এবং চড়-ঘুষি দিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন করতে থাকে। মোবাইল ফোনে তোলা গাদ্দাফীর উপর নির্যাতনের সেসব ভিডিও তথাকথিত আরব বসন্তের অমানবিক দিকটি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। আটক করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় ৬৯ বছর বয়সী বৃদ্ধ নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফীকে।

ওদিকে মৌতাসেমও কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়েন। আগেই তিনি বাহুতে এবং পায়ে গুলি খেয়েছিলেন। সেসব ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল। তার মধ্যেও মোবাইল ফোনে তোলা ভিডিওতে তার নির্ভীক আচরণ ফুটে ওঠে। বিন্দুমাত্র ভয়ের ছাপ না দেখিয়ে তিনি উল্টো উদ্ধত কন্ঠে তাকে গ্রেপ্তার করা সৈন্যের নাম জানতে চান। যখন তাকে বলা হয়, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে, তিনি বুলেটের ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলেন, এগুলো তার বীরত্বের নিদর্শন। বাস্তবে অবশ্য তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। গাদ্দাফীর মতো তাকেও বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়।

মৃত্যুর পূর্বে বিদ্রোহীদের হাতে বন্দী মৌতাসেম; Source: You Tube

মানসুর দাও জানান, মৌতাসেমের মতোই গাদ্দাফীও মৃত্যুর আগে বিন্দুমাত্র ভয় পাননি। যদিও তিনি জানতেন, মৃত্যু শতভাগ নিশ্চিত, তারপরেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অবিচল ছিলেন। মানসুর দাও স্বীকার করেন, গাদ্দাফীর ভুল ছিল। বিদ্রোহে যে লিবিয়ার সাধারণ জনগণও অংশ নিয়েছিল, এটা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও গাদ্দাফী মানতে চাইতেন না। তিনি বারবার বিদ্রোহীদেরকে ইঁদুর এবং আরশোলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, যা বিদ্রোহীদের ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি করেছিল।

তবে মানসুর দাও এখনও মনে করেন, এটি সম্পূর্ণ লিবিয়ানদের স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব ছিল না। গাদ্দাফীর মতোই তিনিও মনে করেন, এই বিদ্রোহের পেছনে আল-কায়েদার একটি বড় ভূমিকা ছিল। এবং তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে লিবিয়াতে আল-কায়েদা আরও বিস্তার লাভ করবে। আর যুদ্ধে গাদ্দাফীর পরাজয়ের কারণ হিসেবে তিনি সম্পূর্ণভাবে ন্যাটোকে দায়ী করেন। তার মতে, ন্যাটো না থাকলে এই যুদ্ধে গাদ্দাফীর পরাজয় হতো না।

ফিচার ইমেজ- Reuters

Related Articles