Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টুয়ামের ভয়ংকর গণকবরে হারিয়ে যাওয়া আটশত শিশুর আখ্যান

১৯৭৫ সাল, আয়ারল্যান্ডের টুয়াম শহরে আসে এক বিবর্ণ বিকাল, ষাটের দশকে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া এক শিশুসদনের মাঠে খেলায় নিমগ্ন কিছু শিশু সম্মুখীন হয় এক ভয়াবহ ঘটনার, আবিষ্কার করে মাঠের এক প্রান্তে পড়ে থাকা কংক্রিট স্ল্যাবের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদেরই মত শিশুদের কংকাল। মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে আতংক। স্থানীয় মানুষের ধারণা ছিলো হয়তো ১৮৪৫ সাল থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডে ঘটে যাওয়া মহাদুর্ভিক্ষের সময় মারা যাওয়া শিশুদের দেহাবশেষ সেগুলো। পাশাপাশি শিশুদের আত্মার অমঙ্গল হবে এই চিন্তা করে খোঁড়াখুঁড়ি না করে স্থানটিকে রেখে দেওয়া হয় আগের মতই। ঠিক কী পরিমাণ মৃতদেহ ছিলো তা নিয়েও মাথাব্যথা ছিলো না সাধারণ মানুষের। স্থানীয় চার্চ কতৃপক্ষ সেখানে প্রার্থনার ব্যবস্থা করে। কোমলমতি শিশুদের শান্তি কামনায় সাধারণ মানুষ মাঝেমধ্যেই সেখানে নিজে থেকেই প্রার্থনা করে আসতেন। কিন্তু  এত বিশাল পরিমাণ শিশুদের কংকালের উৎস নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সবাই ভুলে বসেছিলো ক্ষুধার্ত সময়ের করাল গ্রাসে লুকিয়ে আছে কী মর্মান্তিক এক রহস্য, পৃথিবীর ভয়ংকরতম এক গণকবরের নীরব আর্তনাদ শোনার কি কেউ নেই? ৮০০ শিশুর গণকবরের খোঁজ কি পৃথিবী কখনই পাবে না ?

কী রহস্য লুকিয়ে আছে এই গণকবরে?; ছবিসূত্র: irishtimes.com

এবার গল্পটা ঠিক অন্য জায়গা থেকে শুরু করা যাক। ১৯২৫ সাল, সেই একই জায়গা আয়ারল্যান্ডের টুয়াম শহর, ‘বেন সিকোরস মাদার এন্ড বেবি হোম’, কেউ কেউ ‘সেন্ট মেরিস মাদার এন্ড বেবি হোম’ নামেও চিনে। সমাজের অনাথ শিশুদের দায়িত্ব নেওয়া থেকে শুরু করে যে সকল বাচ্চার জন্ম হতো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে, তাদেরও দায়িত্ব নিত এই শিশু সদন। সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া অনেক শিশু আর মায়ের জায়গা হতো এই সদনে। সমাজের বিত্তবান আর সরকার প্রদত্ত সহায়তায় চলতো এই প্রতিষ্ঠানগুলো। আর দশটা সদনের মত এখানের ভাগ্যবান শিশুদেরও জায়গা হতো নিঃসন্তান অনেক দম্পত্তির দত্তক নেওয়া সন্তান হিসেবে।

বেন সিকোরস মাদার এন্ড বেবি হোম; ছবিসূত্র: nytimes.com

টুয়ামের এই অনাথ শিশুদের লালন পালনের জন্য সরকার কিংবা বিত্তবান থেকে আসা সহায়তার এক বড় অংশই উধাও হয়ে যেত। শিশুদের ভাগ্যে জুটতো না কানাকড়িও। চরম অপুষ্টি আর রোগের শিকার হয়ে শৈশবটা যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠতো এই অনাথাশ্রমে। ১৯৫৩ সালে স্থানীয় দৈনিক ‘The Tuam Herald’ এমনটাই দাবী করে। পাশাপাশি শিল্প বিপ্লবের তুঙ্গে থাকা সেই সময়টাতে ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত এই শিশুসদন থেকে আশেপাশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিশু শ্রমিকের সরবরাহ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিলো।

পত্রিকাগুলোতে এই ঘটনাকে তুলনা করা হয়েছে গণহত্যার সাথেই; ছবিসূত্র: wsm.ie

১৯৪৭ সালে এক পরিদর্শকের রিপোর্ট অনুযায়ী শিশুসদন তার ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশী শিশুকে জায়গা দিয়েছে। শিশুমৃত্যুর হারও অন্য যেকোনো শিশুসদনের চেয়ে বেশী। অনেকের মনেই সন্দেহ জাগে বেশী অনুদান পাবার আশায় বেশী শিশুকে আশ্রয় দেওয়া শুরু করে এই মাতৃসদনটি। শিশুর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে অভিযোগ উঠে এই সদনের শিশুদেরকে জোর করে তাদের মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে রাখার।

বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জন্ম নেওয়া শিশুদের অনেককেই তাদের মা নিজেদের চোখে চোখে রাখতে চাইতেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই মায়েদেরকে তাদের সন্তানদের সাথে দেখা করতে দেওয়া ছিলো ক্যাথলিক চার্চের নিয়মের বাইরে। এই ধরনের ছেলেমেয়েদেরকে তাদের অতীত সম্পর্কে অন্ধকারে রেখেই দায়িত্বের স্টিম রোলার চালায় চার্চ। জেপি রজার্স নামে এক শিশুকেও চার্চ কর্তৃপক্ষ তার মায়ের কাছ থেকে বলতে গেলে জোর করেই আলাদা করে।

শিশু জেপি রজার্স; ছবিসূত্র: bbc.com

তবে রজার্সের ভাগ্য হয়তো একটু বেশিই ভালো ছিলো। তাকে দত্তক নেয় এক ধনী পরিবার। সেখানে থেকেই রজার্স খুঁজে বের করেন তার আসল মাকে।

বহু বছর পর মায়ের সাথে জেপি রজার্স; ছবিসূত্র: bbc.com

তবে সবার ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন হয়নি। মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত, অপুষ্টি আর কর্তৃপক্ষের অবহেলার শিকার শিশুদের অনেকের গণকবর রচিত হতে থাকে শিশুসদনের প্রাঙ্গনে। কিন্তু সেই গল্প চাপা পড়ে যায় অন্য এক ভয়াবহ গল্পে।

সেপ্টেম্বর ১৯৬১, আয়ারল্যান্ডে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড়। তেমন প্রাণহানি না হলেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় টুয়াম শহর। বাদ যায়নি শিশুসদনের প্রধান ভবনটিও।

১৯৬১ ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুসদনটি; ছবিসূত্র: nytimes.com

অনেক বছর ধরে কোমলমতি শিশুদের কান্নায় অভিশপ্ত এই শিশুসদন এগোতে থাকে বন্ধ হয়ে যাবার পথে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে মেরামত না করেই বন্ধ হয়ে যায় কুখ্যাত এই শিশুসদনটি। অবশ্য তখনো শিশুদের গণকবরের গোমড় ফাস হয়নি। হয়তো কোনদিন কেউ জানতোও না।

সত্যটা কি চাপা পড়ে থাকবে কংক্রিট স্ল্যাবের নীচে?

ক্যাথেরিন করলেস, টুয়াম শহরে বাবা মায়ের কোলে বড় হয়ে উঠা এক শিশু। এমন এক সময়ে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন যখন সেই কুখ্যাত শিশুসদনটি চলছিলো। স্কুলে একইসাথে পড়াশোনা করতেন সেইসব শিশুদের সাথে। ক্ষীণকায়, অপুষ্টি আর নির্মল শৈশব থেকে বঞ্চিত হওয়ার ছাপ যেন আঠার মত লেগে থাকতো এই শিশুদের চোখমুখে। স্কুলে সবাই এদের ডাকতো ‘Home babies’ নামে। স্কুলে দেরী করে আসা সেই ছেলেমেয়ের দেখা মিলতো টুয়ামের স্কুলগুলোর পিছনের বেঞ্চগুলোতে। সমাজের ছাঁকনিতে তলানিতে পড়ে থাকা এই শিশুদের প্রতি বৈষম্যের প্রথম ধাপটা শুরু হয়ে যেতো স্কুলে। খেলার মাঠ কিংবা পড়াশোনা সব জায়গায় সহপাঠিদের বৈষম্যের শিকার হওয়া এই শিশুদেরকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করতেন ক্যাথেরিন। এদের অনেকেই স্কুলে সহপাঠীদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে স্কুলেই আসা ছেড়ে দিতো। ছোট্ট ক্যাথেরিন তার বাবা-মায়ের কাছে জানতে চাইতেন এই শিশুদের অপরাধ কী।

টুয়ামের হারিয়ে যাওয়া সেই শিশুর দল; ছবিসূত্র: nytimes.com

তখনকার আয়ারল্যান্ডে ধর্মীয় বিধিনিষেধ একটু কড়াকড়িই ছিলো। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এই শিশু কিংবা তাদের অধিকারের ব্যাপ্যারে আলোচনা করাও এক ধরনের ট্যাবুর পর্যায়ে পড়তো তখনকার সমাজে। ক্যাথেরিনও ধীরে ধীরে ভুলে যান এই শিশুদের কথা।

ক্যাথেরিনের মনেই দানা বাধে সন্দেহ

১৯৭৫ সালে কংক্রিট স্ল্যাবের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিশুদের কংকাল ক্যাথেরিনের মনে জন্ম দেয় একরাশ কৌতুহলের। সবাই যখন একে আয়ারল্যান্ডের মহাদুর্ভিক্ষের সময় মারা যাওয়া শিশুদের দেহাবশেষ বলে চালিয়ে দিচ্ছে, তখন ক্যাথেরিনের মনে সন্দেহ দানা বাধছে একটু একটু করে। স্থানীয় দৈনিকেও ততদিনে সাংবাদিকের কাজ শুরু করলেন ক্যাথেরিন। ইতিহাসের সাথে শৈশবের দেখা শিশুসদনের চেহারাকে মিলাতে চেষ্টা করলেন। এই নিয়ে অল্প বিস্তর গবেষণা করে বুঝতে পারলেন টুয়ামের সেই কংক্রিট স্ল্যাবের নীচে শিশুদের দেহাবশেষে জড়িয়ে আছে অনেক রহস্য।

১৯৯২ সালে ক্যাথেরিনের মা ক্যাথলিন মারা যান। ক্যাথলিনের সমাধিসৌধে তার বাবা মায়ের নাম লেখার জন্যে ক্যাথেরিন তার নানা-নানীর নাম খোঁজা শুরু করলেন। বার্থ সার্টিফিকেট, চার্চের ডকুমেন্ট কোথাও ক্যাথেরিন তার নানার নাম কোথাও খুঁজে পেলেন না। মায়ের কাছেও কোনোদিন শোনেননি নানার নাম। এমনকি তার মায়ের কাছে যখনই তিনি শিশুসদনের বাচ্চাদের কথা জানতে চাইতেন, উদাস হয়ে যেতেন তিনি। এই ঘটনা থেকে তাড়িত হয়ে ক্যাথেরিন এই শিশুসদনের ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। তার মায়ের সমবয়সী যারা শিশুসদনে বেড়ে উঠেছে তাদের খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন। অন্যদিকে সেই গণকবরের ব্যাপ্যারেও অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে লাগলেন।

অনাথাশ্রমের আঙ্গিনায় ক্যাথেরিন; ছবিসূত্র: cdn.extra.iecdn.extra.ie

শুরুটা করলেন শিশু সদনে মারা যাওয়া ২০০ শিশুর ডেথ সার্টিফিকেট বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে।  পাশাপাশি টুয়ামের সমাধিসৌধের রেকর্ডগুলোতে খুঁজতে লাগলেন ঠিক কত শিশুকে টুয়ামের সমাধিসৌধগুলোতে সমাহিত করা হয়েছে। হিসেবে ব্যাপক গড়মিল খুঁজে পেলেন। যতই গভীরে অনুসন্ধান করতে লাগলেন সংখ্যাটাও বাড়তে লাগলো। নাম, মাস কিংবা বয়সের ভিত্তিতে সাজাতে সাজাতে সংখ্যাটা গিয়ে ঠেকলো ৭৯৬ জনে। বেশীরভাগই ইনফ্লুয়েঞ্জা, মেনিনজাইটিস, হুপিং কাশি, যক্ষ্মা আর অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেছে। সরকারী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়াতে আর নিজেদের গাফিলতি চাপা দিতে গণকবরের মত ঘৃণ্য উপায় বেছে নেয় শিশুসদনের দায়িত্ব থাকা মানুষগুলো।

তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে ক্যাথেরিনের তথ্যের সত্যতা; ছবিসূত্র: cdn.extra.ie

এই ঘটনা আয়ারল্যান্ডে বেশ সাড়া ফেলে। সরকার এই বিষয়ে তদন্ত করার জন্যে কমিটি গঠন করে। যার রিপোর্টে ক্যাথেরিনের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হয়। পাশাপাশি ঐতিহাসিক এই সত্যকে উদঘাটন করার জন্যে ক্যাথেরিন করলেস ভূষিত হয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরষ্কারেও।

শেষ চাওয়া

নির্মমতার শিকার হয়ে হারিয়ে যাওয়া সেই শিশুদের আঙ্গিনা আজ ফুলে ভর্তি; ছবিসূত্র: bbc.com

এই ঘটনায় দোষীদের হয়তো শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। ক্যাথেরিন করলেসের মতে, এই অনাথাশ্রমের আঙ্গিনায় যে আটশ শিশুর মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল তারা হয়তো সবচেয়ে ভাগ্যবান ছিলো। কারণ এই আশ্রমে বেড়ে উঠা শিশুদের অনেকেই বেড়ে উঠেছেন মানসিক আর শারীরিক বৈকল্য নিয়ে। সমাজে এই শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী তাদের উপর যে অবর্ণনীয় মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে তা বলাই বাহুল্য। তাই ইতিহাসের বাকে হারিয়ে যাওয়া এই শিশুদের যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে স্মরণ করাও নৈতিক দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করেন। কালের পরিক্রমায় আয়ারল্যান্ড জুড়ে শিশুসদন আর অনাথাশ্রমগুলোর পরিবেশে এসেছে পরিবর্তন, বেড়েছে সরকারি সহায়তা আর নজরদারীও। তবে একুশ শতকে এসেও যারা শিশুসদন কিংবা অনাথাশ্রমের শিশুদের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন তাদের জন্যে এই ঘটনা হয়তো পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসবে।

ফিচার ইমেজ- nytimes.com

Related Articles