দাসপ্রথা এমন একটি শব্দ যা শুনলে বর্বরতা ও নির্যাতিত মানুষের হাহাকারের প্রতিচ্ছবিই ভেসে ওঠে মানবমনে। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় গড়ে ওঠা এই পৃথিবীর ওপর রয়েছে সবার সমান অধিকার, তথাপি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষই সেখানে মানুষের মর্যাদা রাখতে পারেনি। তবে একদিকে যেমন মানুষ স্বীয় মর্যাদা খর্ব করেছে, তেমনি শান্তিকামী মানুষের কল্যাণে গভীর তিমিরেও দেখা গেছে প্রগতির আলো। মানুষের নির্মমতার নজির দাসপ্রথার চল বিলুপ্ত হয়েছে মানুষেরই হাতে। আর সেই ঐতিহাসিক যাত্রার এক অন্যতম মাইলফলক ‘দ্য মিসৌরি কম্প্রোমাইজ’ নামক আপসমূলক আইন, যা একটি উল্লেখযোগ্য সময় জুড়ে দাসপ্রথা নিয়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্তিমিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
দ্য মিসৌরি কম্প্রোমাইজ কী?
দাসত্বপ্রথা সম্পর্কিত যে অঞ্চলভিত্তিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, তা লাঘব করার উদ্দেশ্যে উনবিংশ শতাব্দীতে যে ক'টা মুখ্য আপসমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় ‘দ্য মিসৌরি কম্প্রোমাইজ’ তার একটি। যদিও ক্যাপিটল হিলে এটি চমৎকারভাবে কাজ করে অভীষ্ট উদ্দেশ্য সাধনে সমর্থ হয়েছিল, আদতে এটি অবশ্যম্ভাবী এমন এক সঙ্কটকেই কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছিল মাত্র, যার ফলাফল জাতিগত বিভেদ ও গৃহযুদ্ধ।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিভেদ সৃষ্টিকারী বিষয়টি ছিল দাসত্ব। আমেরিকান বিপ্লবের পর থেকে মেরিল্যান্ডের উত্তরের বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যসমূহ ধীরে ধীরে দাসত্বপ্রথা তুলে দিতে থাকে এবং তাই উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশকের মধ্যে দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোই মূলত মুখ্যভাবে দাসত্বপ্রথাময় এলাকা হিসেবে বজায় থাকে। এদিকে উত্তরে, দাসত্ববিরোধী সমর্থন দিনে দিনে আরো জোরালো হতে থাকে, কাজেই সময়ের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সৃষ্ট দাসপ্রথাজনিত বিভেদ বারংবার তাদের জোটবদ্ধতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।
১৮২০ সালে প্রণীত দ্য মিসৌরি কম্প্রোমাইজ নামক আপসগত নিয়মটির মাধ্যমে এই প্রশ্নটিই সমাধানের চেষ্টা করা হয় যে, নব্যভাবে অঙ্গরাজ্য হিসেবে যোগ হওয়া এলাকাগুলোতে দাসপ্রথা মান্যতা পাবে কি না। চুক্তির একাংশ অনুসারে, মেইন নামক অঙ্গরাজ্যটিকে একটি দাসত্বপ্রথামুক্ত ও মিসৌরিকে একটি দাসত্বপ্রথাধারী অঙ্গরাজ্য হিসেবে ধরা হবে, যাতে কি না দাসপ্রথাময় ও বিহীন এলাকাভিত্তিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও মিসৌরি কম্প্রোমাইজের মাধ্যমে ৩৬°৩০′ দ্রাঘিমাংশের উত্তরের এলাকাগুলোতে দাসপ্রথা বাতিল করা হয় (ব্যতিক্রম হিসেবে মিসৌরি ব্যতিরেকে)। জটিল ও উত্তপ্ত বিতর্কের পরে সৃষ্ট এই আইনটি কার্যকর হবার পর কিছু সময়ের জন্য এই বিষয়জনিত অস্থিতিশীলতা হ্রাস পেয়েছিল।
মিসৌরি কম্প্রোমাইজের পাশ হওয়া একটি খুবই তাৎপর্যবাহী ঘটনা, কেননা, দাসত্বপ্রথাজনিত সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে নেয়া প্রথম পদক্ষেপ ছিল এটি। যদিও এটি, অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোকে সমাধানে সফল হয়নি এবং তখনও দাসপ্রথাময় ও তা বিহীন অঙ্গরাজ্যসমূহ বিরাজমান ছিল। তাই, দাসপ্রথাজনিত যে বিভেদ ছিল তা আরো কয়েক দশকের যাত্রাপথে অগ্রসর হয়েছিল, যার চূড়ান্ত সমাধান হয় এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে।
সঙ্কটাপন্ন অবস্থা- দ্য মিসৌরি ক্রাইসিস
যে সঙ্কটাপন্ন অবস্থার দরুণ মিসৌরি কম্প্রোমাইজের উৎপত্তি তা শুরু হয় ১৮১৭ সালে মিসৌরির অঙ্গরাজ্যের স্বীকৃতি চেয়ে করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। লুইজিয়ানার পর, লুইজিয়ানা পারচেজ স্বীকৃত এলাকার অন্তর্ভুক্ত মিসৌরিই প্রথম অঙ্গরাজ্যরূপে স্বীকৃতি পাবার জন্য আবেদন করে। মিসৌরির নেতারা চেয়েছিলেন এটি হবে এমন একটি অঙ্গরাজ্য যেখানে দাসপ্রথার ওপর কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। এর ফলে, উত্তরাঞ্চলীয় নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
মিসৌরিকে ঘিরে যে প্রশ্নাত্মক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল তা এই নতুন জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি থমাস জেফারসনের কাছে এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি লেখেন, “এই অত্যন্ত গুরুত্ববহ প্রশ্নটি যেন রাতের বেলা আগুনের সতর্কবার্তার মতো, যা আমাকে জাগ্রত করবার পাশাপাশি ভীতিগ্রস্ততায় নিমজ্জিত করেছে।”
ইতিহাস
পশ্চিমা অভিপ্রয়াণের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাদির মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের ভোটাধিকার বৃদ্ধিসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব একটি। নব্যগঠিত পশ্চিমা অঙ্গরাজ্যসমূহ শ্বেতাঙ্গদের জন্য ভোট দেবার ক্ষেত্রে অধিকারসমূহ বৃদ্ধির ব্যাপারে বেশ অগ্রগণ্যতার সাথে সমর্থন দিয়ে থাকলেও তাদের উন্নয়নের সাথে সাথে স্থানীয় আমেরিকান মানবগোষ্ঠীগুলোর অধিকারে ভাটা পড়তে থাকে। স্থানীয় আমেরিকানদের অধিকার নিয়ে খুব কমক্ষেত্রেই জনসাধারণের মাথাব্যথা দেখা গেছে। তবে দাসপ্রথার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এরকম ছিল না, কেননা, পশ্চিমে এর সঠিক ভূমিকা সম্পর্কে উত্তর ও দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ মানুষজনের অভিমতের ভিন্নতা তীব্র ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন পশ্চিমা এলাকাগুলোর সংযুক্তি দাসপ্রথাকে জাতীয় রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৭৮৭ সালের সাংবিধানিক সম্মেলনে ফেডারেল সরকারের নীলনকশাকরণের প্রারম্ভিক সময় থেকেই দাসপ্রথাপন্থী ও বিরোধী অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে সমতা বিধান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে একতা বজায় রাখার লক্ষ্যে আফ্রিকান-আমেরিকানদের অধিকার কমিয়ে যে আপস করা হয়, তারই বিচ্ছুরণ ঘটে ১৮১৯ সালে, যখন মিসৌরি একটি দাসপ্রথাযুক্ত অঙ্গরাজ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত হবার জন্য আইনি লড়াইয়ে নামে।
১৮১৯ সালে, ১১টি দাসপ্রথামুক্ত ও ১১টি দাসপ্রথাযুক্ত অঙ্গরাজ্য বিরাজমান ছিল, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সিনেটে সমতা বজায় ছিল। মিসৌরির এই দাবী মঞ্জুর হলে দাসপ্রথা সমর্থক অঙ্গরাজ্যের পাল্লা ভারী হয়ে যেতো। মিসৌরির সংযুক্তি সংক্রান্ত যে বিতর্ক কংগ্রেসে শুরু হয়েছিল তা প্রচণ্ড তিক্ততা ধারণ করে যখন নিউ ইয়র্কের কংগ্রেস সদস্য জেমস টলম্যাজ প্রস্তাবনা দেন, এ নতুন অঙ্গরাজ্যটিতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ।
এই বিতর্ক আরো গুরুত্ব লাভ করে, কেননা, দাসপ্রথার সমর্থকগণ সুবিচারপরায়ণ কেন্দ্রীয় নীতির উপর নির্ভরশীল ছিল। কাজেই, কংগ্রেস কীভাবে একটি অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব এলাকায় দাসপ্রথা রাখবে কি না শীর্ষক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে?- এ প্রশ্নটি দেখা দেয়। যদি কংগ্রেস এই সিদ্ধান্তটি নিজে নিয়ন্ত্রণ করতো, তাহলে নতুন অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্বে গঠিত অঙ্গরাজ্যগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রীয় অধিকার কম হতো।
হেনরী ক্লে নামক এক স্বনামধন্য কংগ্রেস নেতা ‘মিসৌরি কম্প্রোমাইজ’ নামক দুই শর্তের সমাধানটির অবতারণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সেটি হচ্ছে:
প্রথমত, মিসৌরি দাসপ্রথাপন্থী অঙ্গরাজ্য হিসেবেই জোটে যুক্ত হবে তবে সমতা রক্ষার্থে একটি দাসপ্রথামুক্ত অঙ্গরাজ্য হিসেবে ‘মেইন’ (Maine) যুক্ত হবে, যা কি না ইতোপূর্বেই ম্যাসাচুসেটস থেকে আলাদা হবা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।
দ্বিতীয়ত, মিসৌরির দক্ষিণ সীমান্তের উত্তরে অবস্থিত লুইজিয়ানা পারচেজের এলাকার অধীন সকল নতুন অঙ্গরাজ্য থেকে দাসপ্রথা বাদ দিতে হবে।
দাসপ্রথার সমর্থক ও বিরোধী উভয়পক্ষীয় মানুষের কাছেই এই আপসচুক্তিটি গভীরভাবে ত্রুটিযুক্ত বলে মনে হয়। তারপরও এর স্থায়িত্ব ছিল ত্রিশ বছরেরও বেশি, যতদিন না ১৮৫৪ সালে পাশকৃত কানসাস-নেব্রাসকা আইন অনুসারে, সীমান্তের উত্তরবর্তী অঙ্গরাজ্যসমূহ, দাসপ্রথার সমর্থনে নিজেদের স্বতন্ত্র অভিমত অনুযায়ী চলার প্রাপ্য ক্ষমতা লাভ করে।
মিসৌরি সঙ্কটাবস্থা আমেরিকান রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বহুল সমস্যাপূর্ণ সময় হিসেবে অভিহিত, যা পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত হয়। সে সময়ের প্রকৃত অবস্থার আঁচ কিছুটা হলেও থমাস জেফারসনের পূর্বোল্লিখিত উক্তিটি থেকে পাওয়া যায়।
অবশ্যই আফ্রিকান-আমেরিকানরা দাসত্বপ্রথা বিরোধী ছিল এবং এর প্রসারের প্রতি কংগ্রেসের একাংশের বিরোধিতার খবর দাস সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লসটনের অধিবাসী ডেনমার্ক ভেসি নামক একজন মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ, পশ্চিমে দাসত্বপ্রথার ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত বিষয়ে শ্বেতাঙ্গদের মতভেদকে সবচেয়ে চমকপ্রদভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। ভেসি একদিকে বাইবেলের বাণী ও অন্যদিকে মিসৌরি সমস্যা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের কথা তুলে ধরে ‘আফ্রিকান মেথডিস্ট এপিস্কোপাল চার্চ’ এর ক্ষেত্রস্থল থেকে দাসত্বপ্রথার প্রকাশ্য নিন্দাজ্ঞাপন করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সেই গির্জার একজন লে মিনিস্টার (এমন একজন যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যাজকধর্ম প্রাপ্ত নন ও সম্পূর্ণভাবে অর্থায়িত নন)। গুল্লাহ জ্যাক নামক একজন মুখ্য সহযোগীর সাথে মিলে ভেসি ১৮২২ সালে এক দাসবিদ্রোহের ডাক দেন, যার উদ্দেশ্যই ছিল চার্লসটনের অস্ত্রাগার দখল করে শহরটিকে ততদিন অবরোধ করে রাখা, যতদিন না সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী পালিয়ে হাইতির মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে যেতে পারে।
দুঃখজনকভাবে বিদ্রোহটি এর নির্ধারিত দিনের কিছুদিন আগেই বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়, যার ফলস্বরূপ এর ৩৫ জন উদ্যোক্তার ফাঁসি হয়ে যায় ও ভেসি কৃষ্ণাঙ্গদের যে গির্জায় ধর্ম প্রচারক ছিলেন তা ধ্বংস করে দেয়া হয়। দাসধারী ব্যক্তিরা স্পষ্টতই, উত্তরের বর্ধিষ্ণু দাসপ্রথা বিরোধী ভাবাবেগ এবং দক্ষিণের আফ্রিকান আমেরিকানদের দ্বারা করা অনস্বীকার্য বিরোধিতার বিপরীতে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ছিল। একজন শ্বেতাঙ্গ চার্লসটনের নাগরিকের মতে, “মিসৌরি সংক্রান্ত প্রশ্নাদি উৎক্ষেপনের সূচনায় আমাদের ক্রীতদাসেরা ভাবতে শুরু করেছিল যে, অসংখ্য রকম স্বাধীনতায় পূর্ণ এক দলিলনামা যেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাদের দেয়া হয়েছে।”
আফ্রিকান আমেরিকানরা অবগত ছিল যে, তারা দাসত্বপ্রথার অবসান ঘটাবার জন্য শ্বেতাঙ্গদের ওপর নির্ভর করতে পারবে না। কিন্তু তারা এটাও বুঝতে পারে, উত্তর ও দক্ষিণে সৃষ্ট মতবিরোধ এবং নব্যপ্রসারিত পশ্চিমাঞ্চলে এর ভূমিকা নিয়ে তাদের এ দ্বন্দ্ব কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ফলপ্রসূ কিছু করার দুয়ার খুলে দিতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে ঘটা কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বিষ্ফোরক ঘটনাটি হবে ১৮৩১ সালে সংঘটিত ‘ন্যাট টার্নার্স ভার্জিনিয়া স্লেভ রিভল্ট’।
আপস ও দ্বন্দ্বগাঁথা
মিসৌরি কম্প্রোমাইজ নামে পরিচিত আপসমূলক সিদ্ধান্তটি মূলত মিসৌরির করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং রেষারেষি কাটাতে প্রণীত হয়েছিল। সেসময়ের ২২টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক অনুপাতে দাসত্বপ্রথাযুক্ত ও মুক্ত অঙ্গরাজ্য ছিল। দাসপ্রথা সমর্থিত অঞ্চল হিসেবে মিসৌরির অন্তর্ভুক্তি এই সাম্যাবস্থাকে বিগড়ে দিতে পারতো। আর তা দাসত্বপ্রথার প্রসারে কংগ্রেসের নীরব সম্মতির একটি উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হতো।
ইতোপূর্বে ১৮১৯ সালে যখন মিসৌরি যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঞ্চল হিসেবে তৈরি হয়ে উঠছিল, নিউ ইয়র্কের প্রতিনিধি জেমস টলম্যাজ এমন এক চুক্তির প্রস্তাবনা করেন, যা সেখানে দাসপ্রথার অবসান ঘটাতে পারতো। কিন্তু তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এছাড়াও নিউ ইয়র্কের জন টেইলর নামক আরেকজন প্রতিনিধি আরকানসাস অঞ্চলের ব্যাপারে একইরকম প্রচেষ্টা চালান। জেমস টলম্যাজের প্রস্তাবনা ছিল যে, মিসৌরিতে নতুন কোনো দাস আনা হবে না এবং মিসৌরিতে তৎকালে অবস্থানরত দাসদের শিশুসন্তানদের (প্রায় ২০,০০০) ২৫ বছর বয়স হলে তাদের মুক্ত করে দিতে হবে- এবং এই দুটি শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে মিসৌরিকে দাসপ্রথার চলযুক্ত অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি দেয়া।
মিসৌরির এই অন্তর্ভুক্তিকে ঘিরে জন্ম নেয়া প্রচণ্ড তিক্ততার হাওয়া বজায় ছিল ১৮১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৮২৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। নিউ ইয়র্কের সিনেটর রুফাস কিং ও তার নেতৃত্বে থাকা উত্তরাঞ্চলীয় ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য দেন, নতুন অঙ্গরাজ্যে কংগ্রেস দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে দক্ষিণী নেতাগণ, যেমন- মেরিল্যান্ডের সিনেটর উইলিয়াম পিঙ্কনি দাবী করেন, নব্যগঠিত অঙ্গরাজ্যসমূহের তাদের পূর্বসূরিদের ন্যায় একই কার্যক্ষমতাগত স্বাধীনতা থাকবে। তাই তারা যদি নিজস্ব এলাকায় দাসপ্রথার চল চায় তবে তাদের সেই স্বাধীনতা থাকা উচিত। সিনেট (যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষুদ্র উর্ধ্বতন সংসদীয় ব্যবস্থা) ও হাউজ (বৃহত্তর উর্ধ্বতন সংসদীয় ব্যবস্থা) এ ব্যাপারে আলাদা আলাদা আইন পাশ করে এবং এর ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টিটিভস, টলম্যাজ প্রস্তাবিত সংশোধনীর পক্ষে সায় দিলেও সিনেট এর বিরোধিতা করে মিসৌরির দাসপ্রথার ওপর কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা না থাকার দাবী করে।
আবার, দাসত্বমুক্ত অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘মেইন'কে আরো প্রতীক্ষা করতে হচ্ছিলো দক্ষিণের সিনেটরদের জোটবদ্ধ দলের কারণে, যারা এর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা সৃষ্টি করছিল। এর ফলেই এসব সমস্যা সমাধানকল্পে ১৮১৯ সালে উদ্ভব ঘটে মিসৌরি আপসচুক্তি বা মিসৌরি কম্প্রোমাইজের। কেন্টাকির হেনরি ক্লে মিসৌরি কম্প্রোমাইজ সংক্রান্ত বিতর্ক চলাকালীন হাউজের স্পিকার ছিলেন এবং এই ব্যবস্থাপনা প্রণয়নে গভীর ভূমিকা রাখেন। তাই অনেক বছর পর তাকে “দ্য গ্রেট কম্প্রোমাইজার” ও “দ্য গ্রেট প্যাসিফিকেটর” নামে অভিহিত করা হয়।
তবে সমস্যার জলোচ্ছ্বাস স্থিমিত হলেও ফুরিয়ে যায়নি। দক্ষিণের অনেকেই মিসৌরি কম্প্রোমাইজের সমালোচনা করেন, কেননা, এটিই এমনই এক দৃষ্টান্ত কায়েম করে যার মর্ম হলো- ‘কংগ্রেস দাসপ্রথাসংক্রান্ত আইন বানানোর ক্ষমতাধারী'। অপরপক্ষে উত্তরাঞ্চলীয় নেতৃবৃন্দ এই মতবাদকে দাসপ্রথার প্রসারের পক্ষে মৌন সম্মতি হিসেবে ধরে এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তথাপি, এই আপস আইনটি ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জোট বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
১৮৫৪ সালের কানসাস-নেব্রাস্কা আইন এলে এটি বাতিল হয়ে যায়। কানসাস-নেব্রাস্কা আইনানুসারে, কানসাস ও নেব্রাস্কায় দাসপ্রথাজনিত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আঞ্চলিক স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও অঞ্চল দুটিই ‘কম্প্রোমাইজ লাইন' তথা আপসচুক্তি অনুসারে নির্ধারিত সীমানার উত্তরে অবস্থিত ছিল। তিন বছর পর, ড্রেড স্কট কেসের সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মিসৌরি কম্প্রোমাইজ অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষিত হয়। যেহেতু, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যথার্থ আইনানুগ ব্যবস্থা অনুসরণ না করে কংগ্রেসের নিজস্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ হতে তাদের বঞ্চিত করার ক্ষমতা নিষিদ্ধ করা হয়, সেই ভিত্তিতে কংগ্রেসের নিজস্ব ক্ষমতাবলে চালুকৃত মিসৌরি কম্প্রোমাইজও অসাংবিধানিক হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।
মিসৌরি কম্প্রোমাইজের ফলাফল
সম্ভবত, মিসৌরি কম্প্রোমাইজের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মিসৌরির দক্ষিণ সীমানার উত্তরদিকে (৩৬°৩০' দ্রাঘিমাংশের উত্তরে) অবস্থিত কোনো এলাকাই দাসপ্রথাসমর্থক হিসেবে রাষ্ট্রীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। চুক্তির এই অংশটি লুইজিয়ানা পারচেজ হতে প্রাপ্ত অন্য অঞ্চলগুলোতে কার্যকরীভাবে দাসপ্রথার প্রসার রোধ করে।
দাসত্বপ্রথার ওপর সাধিত ফেডারেল সরকারের প্রথম চুক্তি ছিল মিসৌরি কম্প্রোমাইজ। এর মাধ্যমে এই নজিরই স্থাপিত হয়েছিল যে, নতুন অঞ্চল বা অঙ্গরাজ্যগুলোতে ফেডারেল সরকারই দাসপ্রথার ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে ফেডারেল সরকারের আদৌ তা নিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে কি না সেই প্রশ্নটি নিয়ে বেশ উত্তাপিত বিতর্ক দেখা দেবে এরও কয়েক দশক পর, ১৮৫০ এর দশকে।
কানসাস-নেব্রাস্কা আইন
মিসৌরি কম্প্রোমাইজ অকার্যকর হয়ে যায় ১৮৫৪ সালে প্রণীত কানসাস-নেব্রাস্কা আইনের সাথে। এই আইন কার্যকরীভাবে ত্রিশতম দ্রাঘিমাংশের উত্তরে দাসপ্রথার বিস্তার না হবার সিদ্ধান্তকে অকেজো করে দেয়। এই আইনানুযায়ী, কানসাস ও নেব্রাস্কা নাম্নী দুটি অঞ্চলের সৃষ্টি হয় এবং এলাকাগুলোতে দাসপ্রথার চল থাকবে কি না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা ঐ দুই অঞ্চলের মানুষকে দেয়া হয়। এর ফলশ্রুতিতে, কয়েক দফা যুদ্ধ দেখা দেয় যা ব্লিডিং কানসাস কিংবা দ্য বর্ডার ওয়ার হিসেবে পরিচিত। এসকল যুদ্ধে দাসপ্রথা-বিরোধী যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন জন ব্রাউন, যিনি পরবর্তীতে হার্পার্স ফেরিতে চালানো তার আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য বিখ্যাত হবেন।
ড্রেড স্কটের রায় ও মিসৌরি কম্প্রোমাইজের বিলুপ্তি
এভাবে দাসপ্রথামূলক দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ ১৮৫০ সাল অবধি চলতে থাকে। ১৮৫৭ সালে সুপ্রীম কোর্ট এক মাইলফলকসম বিচারকার্যের সাক্ষী হয়, যা ছিল ড্রেড স্কট ও স্ট্যানফোর্ডের মধ্যে। সেখানে, ড্রেড স্কট নামক একজন আফ্রিকান-আমেরিকান দাস নিজের মুক্তির আবেদন করেন, কেননা, তার মতে, তিনি ইলিনয়ের বাসিন্দা ছিলেন, যেখানে দাসপ্রথা অবৈধ। সুপ্রীম কোর্ট তার এই আবেদন নাকচ করে দিয়ে ঘোষণা করে, যেহেতু যেকোনো আফ্রিকান-আমেরিকান, হোক সে দাস কিংবা স্বাধীন, তাদের পূর্বপুরুষ যদি ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রীত হয়ে থাকে, তাহলে তারা আমেরিকান নাগরিক নন। তাই, যেহেতু স্কট আমেরিকান নাগরিক নন, তাই তার আদালতে আবেদন করার অধিকার নেই। সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে এটাও জানানো হয়, ফেডারেল এলাকাগুলোতে দাসপ্রথা নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার ফেডারেল সরকারের নেই। এই সিদ্ধান্তক্রমেই, মিসৌরি কম্প্রোমাইজ অসাংবিধানিক হিসেবে গণ্য করা হয়।
একনজরে মিসৌরি কম্প্রোমাইজের ঘটনাপ্রবাহ
১৭৭৪ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে কংগ্রেস প্রকাশিত বিতর্করচনা, বিল, আইন ও সাময়িকীপত্রসহ অন্যান্য প্রকাশনানুসারে, মিসৌরি কম্প্রোমাইজের কিছু প্রধান প্রধান সময়গুলোর ঘটনাপ্রবাহ নিম্নরূপ-
- ৮ই ফেব্রুয়ারি - ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৮২০- মেইন ও মিসৌরির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সিনেটের বিতর্ক।
- ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৮২০ – মেইন ও মিসৌরির বিলদুটি একীভূতকরণের পক্ষে সিনেট সদস্যগণ সম্মত হন।
- ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৮২০ – মিসৌরি ব্যতীত ৩৬°৩০´ দ্রাঘিমাংশের উত্তরে অবস্থিত লুইজিয়ানা এলাকার সর্বত্র দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সিনেটের একমত হওয়া এবং ২৪-২০ ভোট ব্যবধানে সেই বিলের সর্বশেষ সংস্করণে সম্মত হওয়া।
- ১লা মার্চ, ১৮২০ – হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস তাদের নিজস্ব বিল পাশ করে, যা দাসপ্রথাবিহীন মিসৌরিকে অন্তর্ভুক্ত করে। ৯১-৮২ ভোটে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
- ২রা মার্চ, ১৮২০ – একটি হাউজ-সিনেট সম্মেলনে সিনেটের বিলটির পক্ষে সম্মতি জ্ঞাপন করা হয়।
- ২রা মার্চ, ১৮২০ – হাউজের ৯০-৮৭ ভোটে মিসৌরিতে দাসপ্রথা গৃহীত হয়।
- ২রা মার্চ, ১৮২০ – ৩৬°৩০´ দ্রাঘিমাংশের উত্তরে লুইজিয়ানা অঞ্চলে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করাত লক্ষ্যে হাউজ ১৩৪-৪২ ভোটদান করে।
- ৬ই মার্চ, ১৮২০ – রাষ্ট্রপতি জেমস মনরো মিসৌরি কম্প্রোমাইজ নামক চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন।
১৭৮৯-১৮৩৮ সালে ভেতর তৈরি কংগ্রেসের ব্যবস্থাপনা ও কার্যনির্বাহী দলিলসমূহ আমেরিকান স্টেট পেপার্স এর নিকট সঞ্চিত আছে।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কার্যকরণ, অকার্যকরণ ও পরবর্তীতে বিলুপ্তির মুখ দেখা মিসৌরি কম্প্রোমাইজ আমেরিকান ও বিশ্ব ইতিহাসে এক ভাস্বর নাম। উত্থিত সমস্যাদি ও সঙ্কট সমাধানে পুরোপুরিভাবে সক্ষম না হলেও এই আপসমূলক চুক্তিটি যে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কিছু সময়ের জন্য দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিল ও সমতা বিধান করেছিল তা অস্বীকার করা যায় না। দাসপ্রথার বিলোপের পথে মিসৌরি কম্প্রোমাইজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ রাজনৈতিক পদক্ষেপ।
This article is in Bangla Language. Its about the 'Missouri Compromise'. For references please check the hyperlinks inside the article
Feature Image: sloveniahotel.info