Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেভাবে পাওয়া গেল মিশরের প্রাচীনতম প্যাপিরাসের সন্ধান

অতীতের মিশর! ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধূধূ মরুভুমি আর চোখ ঝলসানো রোদের মাঝে উটের উপর বেদুঈনদের এগিয়ে চলা। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পিরামিডের ছায়াও হয়তো কল্পনায় চলে আসে হঠাৎ। কিন্তু কল্পনার সুতো ছিড়ে যায় সেখানেই। কারণ প্রাচীন মিশরের মানুষের জীবন আসলে কেমন ছিল সে বিষয়ে খুব বেশি জানা নেই আমাদের।

মিশরে পুরাকীর্তি আবিষ্কার হওয়া খুব একটা আহামরি বিষয়ের মধ্যে পড়ে না। কারণ যে সভ্যতার শুরু প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে, সেই জাতির দীর্ঘ ইতিহাসের চিহ্ন মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া স্বাভাবিকই বটে। কিন্তু এর মাঝেও কিছু আবিষ্কার প্রাচীন এই সভ্যতার এমন কিছু অংশ তুলে ধরে যে প্রত্নতাত্ত্বিক থেকে সাধারণ মানুষ সবাই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।

তেমনটাই ঘটেছিল ২০১৩ সালে, যখন ফরাসি আর মিসরীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের সমন্বিত একটি দল প্রাচীন এক গুহার ভেতরে বেশ কিছু প্যাপিরাসের খন্ড খুঁজে পায়। বয়সের হিসেবে এই প্যাপিরাসগুলোই মিশরে খুঁজে পাওয়া প্যাপিরাসের মাঝে সবচেয়ে পুরোনো। লোহিত সাগরের উপকুলের কাছে, প্রাচীন মিসরীয় বন্দর ওয়াদি এল-জার্ফ-এর প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রাচীনতম নথিগুলো। পাঠযোগ্য যেকোনো নথি থেকেই নতুন কিছু না কিছু জানা সম্ভব। সেই নথি যদি হয় কয়েক হাজার বছরের পুরোনো তাহলে ইতিহাসের হাতছানি যেকোনো প্রত্নতাত্ত্বিককে উত্তেজিত করতেই পারে।

Image Courtesy: Pierre Tallet

এই আবিষ্কারের বিষয়ে বিশদভাবে জানা যায় মিশর বিশেষজ্ঞ পিয়ের টালেট এবং গ্রেগরি মারুয়ার্ডের বিবরণী থেকে। তাদের দলই প্যাপিরাসের এই ভান্ডার খুঁজে বের করে। বিবরণী থেকে জানা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিকদের দল গুহাটি থেকে কয়েকশ খন্ড প্যাপিরাস উদ্ধার করে। সেখানের কয়েকটি প্যাপিরাস ছিল প্রায় অক্ষত অবস্থায়, এমনকি তাতে বাঁধা রশি পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ছিল! পরবর্তীতে কাচের ফ্রেমে বসিয়ে এই প্রাচীন নথিগুলো মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ব মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেয়া হয়। কী লেখা ছিল কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকা এই প্যাপিরাসগুলোতে? কীভাবে খোঁজ পাওয়া গেল প্রাচীন এই নথি ভান্ডারের? চলুন একে একে সেগুলোই জানার চেষ্টা করি।

পিয়ের টালেট এবং তার দল কাজ করছিল ওয়াদি এল-জার্ফ নামের প্রাচীন এক নৌঘাটির ধ্বংসাবশেষে। সুবিশাল মরুভুমির বুকে সত্যিই যেন শূন্যের মাঝে কাজ করছিলেন তারা। সবচেয়ে কাছের শহর জাফরানা সেখান থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার বা ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সেই খননের প্রথম পর্যায়ে দলটি বেশ কিছু নির্দেশনা আবিষ্কার করে যেখান থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে ওয়াদি এল-জার্ফ নৌঘাটি ব্যবহার হত এখন থেকে প্রায় ৪,৬০০ বছর আগে। প্রাচীন মিশরের চতুর্থ রাজবংশীয় শাসনামলে নির্মিত এই বন্দরের মাধ্যমে ঠিক কী কাজ করা হতো সে বিষয়ে তখনও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না টালেট বা তার দলের।

Image Courtesy: G. Marwad, Egyptian Archaeology 40

২০১৩ সালে খননের তৃতীয় পর্যায়ের টালেট এবং তার দলের লোকজন ওয়াদি এল-জার্ফের জলযান রাখবার গ্যালারি অংশে যাওয়ার একটি ছোট রাস্তা খুঁড়ে বের করছিলেন।  তখন তারা দুটি বিশালাকার পাথরের চাই দিয়ে আটকে রাখা একটি গুহামুখের সন্ধান পান। সেই গুহার ভেতর থেকেই উদ্ধার হয় প্রাচীন প্যাপিরাসের বিশাল সংকলনটি। প্রাচীন মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক্স এবং হাইরাটিক ভাষাতে লেখা এই প্যাপিরাসের খন্ডগুলো থেকে ওয়াদি এল-জার্ফ এবং গিজার পিরামিডের মধ্যকার সম্পর্ক জানতে পারা যায়। সেই সাথে চার হাজার বছর আগের শ্রমিকদের দৈনন্দিন কাজের বিবরণও খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন এই নথিগুলোতে।

টালেট এই অভূতপূর্ব আবিষ্কার পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসলেও তার আগেও এই অঞ্চলের ব্যখ্যা দিয়েছেন কয়েকজন। টালেটের এই অঞ্চল বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় সেরকম একটি লেখা থেকেই। সেই লেখাটি ছিল ব্রিটিশ অনুসন্ধানী জন গার্ডনার উইলকিনসনের। ১৮২৩ সালে তিনি এই অঞ্চলে এসেছিলেন এবং লোহিত সাগরের কাছাকাছি মরুভূমির এই অংশ পাড়ি দেবার সময় তিনি কিছু সময় এখানে কাটিয়েছিলেন।

উইলকিনসনের লেখা সেই বিবরণ ছিল কিছুটা এরকম, আশেপাশের কিছু পুরোনো স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের পাশে এখানে আছে ছোট একটি টিলার মতন উঁচু অংশ। মৌমাছির চাকের মতো আঠারো বা এর বেশি সুড়ঙ্গ সেখানে চোখে পড়ছে। কিন্তু ভেতরে যাবার কোনো প্রবেশদ্বার কোথাও চোখে পড়ছে না। তপ্ত বালি আর ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের রাজ্যে যদিও দরজা খুব একটা বড় বাধা নয়। সুড়ঙ্গগুলোর দেয়াল সুন্দরভাবে তৈরি করা। ৬-৮ ফুট উঁচু এই গুহাগুলো  দৈর্ঘ্যে ২৪-৮০ ফুট পর্যন্ত আর চওড়ায় ৫ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত।  

এরপর বহু বছর কোন ব্যাখ্যাতে এই অঞ্চলের বিশেষ খোঁজ পাওয়া যায় না। জনমানবশূন্য বিরান অঞ্চল বলেই হয়তো হাজার বছরেও ভেতরে রাখা প্যাপিরাসগুলো বেহাত হয়ে যায়নি বা কেউ ধ্বংস করতে পারেনি। ১৯৫০ এর দশকের কোনো একসময় দুজন ফরাসি পাইলট এই অঞ্চলের কিছু জায়গা চিহ্নিত করার একটি কাজ করেন। সেখানে অঞ্চলভিত্তিক ব্যাখ্যা থাকলেও প্রাচীন নৌবন্দর অথবা এই উঁচু ঢিবি বিষয়ে কিছু উল্লেক করা ছিল না। টালেট নিজ উদ্যোগে সেই দুই পাইলটের একজনকে খুঁজে বের করেন। তার কাছ থেকে এই জায়গার সঠিক অবস্থান জেনে নেন এবং উইলকিনসনের ব্যাখ্যার সাথে মিলিয়ে অত্যাধুনিক জিপিএস প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে খুঁজে বের করেন ওয়াদি এল-জার্ফের এই অঞ্চলটিকে।

Image Courtesy: Pierre Tallet / archaeology.org

উদ্ধার করা নথিগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যায়, সেগুলো তৎকালীন পিরামিড নির্মাণ এবং সেই কাজে নিযুক্তদের তথ্য আদান-প্রদানের উপরে লেখা। তেমনি একটি নথি হলো মেরারের লগবুক বা দিনলিপি। প্রায় ৪,৫০০ বছর আগের সেই লগবুকটি হায়ারোগ্লিফিক বর্ণ ব্যবহার করে লেখা হয়েছিল। সেখানে লেখা বর্ণনা থেকে জানা যায়, মেয়ার ছিলেন মাঝারি ক্ষমতার একজন পরিদর্শক বা শ্রমিক দলপতি। তার অধীনে প্রায় ২০০ লোকের একটি দল কাজ করত, যাদের মূল কাজ ছিল মিশরের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে জিনিস সংগ্রহ করা এবং অন্য অঞ্চলে সেগুলো পৌঁছে দেয়া।   

মেরারের এই লগবুকে ফারাও রাজা খুফুর রাজত্বের ২৭ তম বর্ষের বেশ কিছু বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে তাকে খুনুম খুফু বা রাজা খুফু বলে উপাধিত করা হয়েছে। খুফু মিশরের চতুর্থ রাজবংশীয় দ্বিতীয় ফারাও, যিনি ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে শাসক ছিলেন। খুফুর শাসনামলেই মিশরের অন্যতম বিখ্যাত গিজার পিরামিডের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় বলে ধারণা করা হয়। গিজার পিরামিড তৈরির শেষের দিকের বেশ কয়েকমাসের কাজের ব্যাখ্যা এই লগবুকে উল্লেখ পাওয়া যায়।

লগবুকটিতে দুটি আলাদা ভাগে দৈনন্দিন কাজের বিবরণ দেয়া রয়েছে। এক অংশে রয়েছে শ্রমিকদের কাজের সময়ের হিসাব ও প্রতিবেদন, অন্য অংশে রয়েছে চুনাপাথরের খন্ড উত্তোলনের হিসাব। এই চুনাপাথরের খন্ডগুলো তুরা নামের একটি জায়গা থেকে উত্তোলন করে মেরার এবং তার দল নৌপথে নীল নদের পাড়ে নিয়ে আসতো। সেখান থেকে বিশেষভাবে নির্মিত খালের ভেতর দিয়ে সেই পাথরগুলোকে নিয়ে আসা হত পিরামিডের নির্মাণ-অঞ্চলের একেবারে কাছে। চুনাপাথরের এই খণ্ডগুলো পিরামিডের বাহ্যিক সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রতিবার এই কাজ সম্পন্ন করতে মেরার এবং তার দলের দুই থেকে তিন দিন সময় লেগে যেত।

শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার বাইরে লগবুকটিতে উজির আনখায়েফের বিষয়েও উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন রাজা খুফুর সৎ ভাই। তিনিই রাজার সব কাজের দেখাশোনা করতেন। গিজা পিরামিডের তৈরির মূল কাজও আনখায়েফের তত্ত্বাবধানেই সম্পন্ন হয়েছিল। গিজার পিরামিডের কাজ সম্পন্ন হয় আনুমানিক ২৫৮০ থেকে ২৫৬০ খ্রিস্টপূর্বে। ইতিহাসের হিসাবে এই পিরামিড তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় ২৩ বছর। ৪৮১ ফুট উঁচু এই পিরামিড মিসরের সবচেয়ে বড় পিরামিড বলে স্বীকৃত। ২৩ লক্ষ ব্লক দিয়ে তৈরি করা এই বিশাল স্থাপনা বিশ্বের অন্যতম সপ্তাশ্চর্য হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।

উদ্ধার করা অন্য প্যাপিরাসগুলো থেকেও সে সময়ের নানা তথ্য জানা যায়। একটি নথিতে উল্লেখ পাওয়া যায়- সেই বছরই ভূমধ্যসাগর বরাবর একটি বন্দর নির্মাণের কাজে মেরার এবং তার দলকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। রাজস্ব কর আদায় এবং শ্রমিকদের মজুরি দেয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও  শ্রমিকদের মাঝে কীভাবে খাদ্য বিতরণ করা হত সেই বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায় অপর প্যাপিরাস থেকে। এমনকি একটি নথিতে উল্লেখ পাওয়া যায় এই প্রকল্পের জন্যে কী পরিমাণ ভেড়া আমদানি করা হয়েছে সেই বিষয়েও।

Image Courtesy: EFE

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে ওয়াদি এল-জার্ফ অঞ্চলটি গিজা থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সেখানে গিজার পিরামিড নির্মাণ বিষয়ের তথ্য পাওয়া গেলেও কাছাকাছি অঞ্চলে নির্মিত অন্য পিরামিডের বিষয়ে কোনো নথি পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, এই বন্দরের ব্যবস্থাপনার কাজও গিজা পিরামিড নির্মাণের কাজে নিযুক্ত লোকেরাই করতো। টালেটের মতে, ঠিক কী কারণে নথিগুলো ওয়াদি আল-জার্ফে এনে সংরক্ষণ করা হয়েছিল- এই বিষয়ে আসলে খুব বেশি যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। একজন শ্রমিকদের দলনেতা সাধারণত তার লেখা দিনপঞ্জি নিজের কাছেই সংরক্ষণ করার কথা এবং একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাবার সময় নিজের সাথেই নিয়ে যাওয়ার কথা। তার হিসেবে- প্যাপিরাসগুলো ওয়াদি এল-জার্ফে পাবার কারণ এই অভিযানই সম্ভবত ছিল মেরার এবং তার দলের শেষ অভিযান। যেহেতু এই কাজ শেষ হবার কাছাকাছি সময়ে রাজা খুফুর মৃত্যু হয় এবং সে কারণে হয়তো এই অঞ্চলের সকল নির্মাণকাজ থেমে যায়। এজন্যই কর্মস্থল ছেড়ে চলে যাবার আগে সব নথিপত্র তারা এখানকার পাথরের বদ্ধ গুহায় রেখে যায়।

প্রাচীন এই প্যাপিরাসের লেখা অংশগুলো হয়তো কোনো বিশাল রহস্যের সমাধান প্রকাশ করে না। কিন্তু সে সময়কার পিরামিড তৈরির কৌশলের কিছুটা আভাস আমাদেরকে দেয়। অতীতের সেই কাজের দিনলিপিগুলোই আজকের যুগে পরিণত হয়েছে মূল্যবান ইতিহাসে।

Related Articles