Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য মিরিয়াড ইয়ার ক্লক: জটিলতম যে ঘড়ি

বর্তমান উন্নত পৃথিবীর মানুষের কাছে সময় এবং সময়জ্ঞানের গুরুত্ব কতটা, সেটা ভাষায় বর্ণনা করাই দুষ্কর। সৃষ্টির শুরু হতেই প্রতিমুহূর্তে সময় চলে যাচ্ছে কালের অতল গহ্বরে। কিন্তু সময় সম্পর্কে মানুষ সৃষ্টির প্রথম থেকেই কতটা সচেতন ছিলো সেটা অনুসন্ধানের বিষয় হলেও, অন্যদিক থেকে সেই অনুসন্ধান করাটাই সময়ের অপচয়। এই যে আমরা এত সময় এবং সময়জ্ঞানের কথা বলি, এসব নিয়ে মানুষ আদতে তখনই সচেতন হতে শিখেছে যখন সময় গণনা করতে শিখলো। আর এভাবেই একসময় সময় গণনার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে যান্ত্রিক ব্যবস্থা, অর্থাৎ আজকের ঘড়ি।

কিন্তু যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কারের পূর্বেই মানুষ সময় গণনার নানা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলো। যেমন, প্রাচীন মানুষেরা দিনের বেলায় সূর্যের অবস্থান এবং রাতে নক্ষত্রদের গতিবিধি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে সময় গণনা করতো। এরপর এলো সৌরঘড়ি বা সূর্যঘড়ি। সৌরঘড়ি মূলত দিনের বেলাতেই কার্যকর ছিলো। এই পদ্ধতিতে সূর্যের অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে সাথে নির্দিষ্ট বস্তুর ছায়ার পরিবর্তনকে বিভিন্ন সময়ে ভাগ করে সময় গণনা করা হতো। এরপর একসময় সময় গণনার জন্য আর সূর্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হলো না। আবিষ্কার হলো যান্ত্রিক ঘড়ির।

প্রাচীন সূর্যঘড়ি; Image Source: shutterstock.com

এই লেখায় যদিও যান্ত্রিক ঘড়ির ইতিহাস নিয়ে বলা হবে না। বলা হবে একটি বিশেষ যান্ত্রিক ঘড়িকে নিয়ে, যেটিকে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ঘড়িসমূহের মধ্যে সবথেকে জটিল হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। এই ঘড়িটির নাম ‘মিরিয়াড ইয়ার ক্লক’ (Myriad Year Clock) বা অযুতবর্ষী ঘড়ি। মূলত যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কারের কয়েক দশক পরে ছয়মুখো এই ঘড়িটি তৈরি হয়েছিলো জাপানে। আবিষ্কর্তা ছিলেন জাপানের ‘টমাস আলভা এডিসন’ খ্যাত হিসাশিগে তানাকা। ঘড়িটি সম্পর্কে জানার আগে এর আবিষ্কর্তা অর্থাৎ তানাকার সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

মিরিয়াড ইয়ার ক্লকের আবিষ্কারক হিসাশিগে তানাকা; Image Source: watchesbysjx.com

হিসাশিগে তানাকা ছিলেন জাপানের একজন বিশিষ্ট আবিষ্কারক, বোধহয় এই পর্যন্ত জাপানে জন্ম নেয়া আবিষ্কারকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অন্যতম। জাপানের দক্ষিণাংশে বর্তমান ফুকুওকা এলাকায় কুরুমি শহরে ১৭৯৯ সালে তানাকা জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তানাকা এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যেটি কাপড় বুননে সক্ষম ছিলো। আর নিজের শহরের নামে এই তাঁতযন্ত্রে তৈরি কাপড়ের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘কুরুমি’ কাপড়। তরুণ বয়সে নিজের পেশা শুরু করেছিলেন একজন পাপেট নির্মাতা হিসেবে।

তানাকার বিখ্যাত কাজগুলোর অন্যতম ‘লিটল আর্চারার’ নামক পাপেট; Image Source: watchesbysjx.com

তার বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ‘লিটল আর্চারার’ নামক একটি পাপেট, যেখানে একটি যান্ত্রিক পুতুল কিছু সময় পরপর তীর নিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তীর ছুঁড়তে সক্ষম। এছাড়াও আছে ‘ক্যালিগ্রাফার বয়’ নামক পাপেট। এসব আবিষ্কারের কারণে তানাকাকে জাপানের ‘মেকানিক্যাল জিনিয়াস’ বা ‘মি: মেকানিক’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। তানাকাই প্রথম জাপানের বাষ্পীয় ইঞ্জিন, বাষ্পীয় জাহাজ, টেলিগ্রাফ তৈরি করেন। মজার ব্যাপার হলো, আজকের পৃথিবীতে ইলেক্ট্রনিকস জায়ান্ট টোশিবা কোম্পানির জনক ছিলেন তিনি। তবে তানাকার এতসব আশ্চর্য কৃতকর্মের মাঝে যে জিনিসটি বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে, সেটি মিরিয়াড ইয়ার ক্লক বা অযুতবর্ষী ঘড়ি। ১৮৪৮ থেকে শুরু করে ১৮৫১ সালে তানাকা এই ঘড়ির কাজ শেষ করেছিলেন।

এই সেই বিখ্যাত মিরিয়াড ইয়ার ক্লক; Image Source: watchesbysjx.com

মূলত জাপানের ‘এদো’ (Edo period) পরবর্তী আমলের অন্যতম সময় গণনাকারী যন্ত্র হিসেবে মিরিয়াড ইয়ার ক্লক বিশেষভাবে স্মরণীয়। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে এই বিশেষ ধরনের ঘড়িটি জাপানের ‘ওয়াদোকেই(Wadokei) ঘড়ি গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। এই জটিল যান্ত্রিকতায় ভরপুর বিশেষ ধরনের ঘড়িটির ছয়টি মুখ আছে। এই ছয়টি মুখ মূলত ছয় ধরনের সময় প্রদর্শন করতে পারে- সাধারণ ব্যবহারিক সময়, সপ্তাহের দিন, মাসের নাম, জাপানের নিজস্ব সময়, সৌর সময় এবং চাঁদের বিভিন্ন দশা। ঘড়িটি চলে সাধারণত যান্ত্রিক স্প্রিং কার্যপ্রণালীর সাহায্যে এবং এই স্প্রিংয়ে প্রতি বছরে একবার প্যাঁচ দিলেই সারাবছর সময় দিতে সক্ষম ঘড়িটি। ঘড়িটির জটিল ও সূক্ষ্ম কার্যপ্রণালীর পেছনে আছে চারটি মূল স্প্রিং, যেগুলো তানাকা নিজে হাতেই ঘড়ির ভিত্তিতে স্থাপন করেছিলেন। একটি ক্রাংকের সাহায্যে এতে প্যাঁচ দেয়া হয়।

৬৩ সে.মি. উচ্চতা এবং ৩৮ কেজি ওজনের এই ঘড়িটিতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ১০০০টি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ। বলা হয়ে থাকে, সাধারণ মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতির (যেমন করাত বা রেতি) সাহায্যে তানাকা নিজের হাতেই এসব যন্ত্রাংশ (যেমন গিয়ার বা স্প্রিং) তৈরি করেছিলেন। নিজের হাতে আস্তে আস্তে এই ঘড়ি তৈরির কাজটি শেষ করা মোটেও সহজ ছিলো না। প্রায় তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেই তিনি ঘড়িটির কাজ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হন।

বাস্তবে ২০০৪ সালে জাপান সরকার তানাকার এই ঘড়ির প্রতিরূপ তৈরির উদ্যোগ নেয়। উদ্দেশ্য ছিলো ২০০৫ সালে জাপানের বিশ্ব মেলায় সেটা প্রদর্শন করা। কিন্তু সেই প্রতিরূপ তৈরিতে প্রায় ১০০ জন ইঞ্জিনিয়ারের সময় লেগেছিলো ছয় মাস। এমনকি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েও তানাকার ঘড়ির প্রতিরূপ তৈরি করা হয়ে পড়েছিলো বেশ কঠিন। ইঞ্জিনিয়ারগণ ঘড়িটির প্রতিটি অংশ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে তারপরই এর প্রতিরূপ তৈরির কাজে হাত দেন।

এরপরও মূল ঘড়ির বেশ কিছু অংশ, যেমন মূল স্প্রিং হুবহু তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মূল স্প্রিং ছিলো পিতলের তৈরি। কিন্তু প্রতিরূপের জন্য পিতলের পরিবর্তে স্টিল ব্যবহার করা হয়, কারণ পিতলের স্প্রিংয়ের প্রতিরূপ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এগুলো বর্তমানে তোশিবা কোম্পানির স্বত্বাধিকারে জাপানের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

এবার চলুন জানা যাক এই বিশেষ ধরনের ঘড়ির ছয়টি মুখ সম্বন্ধে।

ঘড়ির প্রথম মুখটি মূলত জাপানের ব্যবহারিক সময় নির্দেশ করে। জাপানের সময় মূলত ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। যেমন গ্রীষ্মে দিনের দৈর্ঘ্য বড় এবং রাতের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায়। তখন ঘড়ির প্রথম মুখটিতে যুক্ত কাঁটাগুলোও সেভাবে পরিবর্তিত হয়ে সময় দিয়ে থাকে। ঘড়ির উপরের অর্ধাংশে দিনের সময় এবং নিচের অংশে রাতের সময় নির্দেশিত হয়। প্রতিটি অংশই ছয়টি ভাগে ভাগ করা থাকে। প্রতি অর্ধেক অংশের এই ছয়টি ভাগই ঋতু অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। কাজেই তানাকার এই ঘড়িটি অবশ্যই বিস্ময়ের দাবিদার। কারণ এটি নিজে নিজেই দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে যায়। সাধারণ ওয়াদোকেই ঘড়িতে সাধারণত ওজন বসিয়ে বা বাইরে থেকে এই স্কেল পরিবর্তন করে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।

ঘড়ির প্রথম মুখ (ওয়াদোকেই ডায়াল); Image Source: watchesbysjx.com

প্রথম মুখটির পরেই আসে দ্বিতীয় মুখটি। ঘড়ির দ্বিতীয় মুখটি মূলত জাপানের চিরাচরিত সৌর বছরের ২৪টি মৌসুমী সময়কে নির্দেশ করে। এই ডিসপ্লেটি সাধারণত বাইরে থেকে হাত দিয়ে নাড়িয়ে দেয়া হয় এবং এর ফলেই ঘড়ির ভেতরে এর কার্যক্রম শুরু হয়।

ঘড়ির দ্বিতীয় মুখ; Image Source: watchesbysjx.com 

সপ্তাহের দিনগুলোকে নির্দেশ করার জন্য আছে তৃতীয় মুখটি। এর ছোট কাঁটাটি সপ্তাহের ঐ নির্দিষ্ট দিন নির্দেশ করে। এছাড়াও এতে বড় কাঁটাটি ঘণ্টা নির্দেশ করে, যা প্রথম মুখটি অর্থাৎ ওয়াদোকেই ঘড়ির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এখানে ঘণ্টার কাঁটাটি আবার ঘড়ির ভেতরের ঘণ্টার সাথে যুক্ত, যা প্রতি ঘণ্টা অন্তর অন্তর ঘণ্টাধ্বনি দেয়।

ঘড়ির তৃতীয় মুখ; Image Source: watchesbysjx.com

পরবর্তী ডায়াল, অর্থাৎ চতুর্থ মুখটি চীনের নিজস্ব সময়কে নির্দেশ করে। এই সময় গণনাকে বলা হয় ‘ষাট চক্র’ (Chinese Sexagenary Cycle)। এটি মূলত ষাট পদবিশিষ্ট ক্যালেন্ডার, যা চান্দ্রিক ক্যালেন্ডারের দশটি চিহ্নের ভিত্তিতে দিনের নির্দেশ করে। সেইসাথে চতুর্থ মুখটি চীনের ১২টি রাশিচক্রের চিহ্নও প্রদর্শন করে।

চতুর্থ মুখ (সেক্সাগ্নারি সাইকেল ডিস্প্লে); Image Source: watchesbysjx.com

ঘড়ির পঞ্চম মুখটিতে মাস নির্দেশ করার জন্য একটি বলয় আছে। মাসের হিসেব করা হয় মূলত চান্দ্রিক ক্যালেন্ডার হিসেবে। একইসাথে কেন্দ্রে অবস্থিত একটি গোলক চাঁদের বিভিন্ন দশা প্রদর্শন করতে সক্ষম। চাঁদের বিভিন্ন দশা বলতে বোঝায় অমাবস্যা, পূর্ণিমা ইত্যাদি সময়ে চাঁদের আকার ও অবস্থা।

পঞ্চম মুখ (চাঁদের দশা ও মাসের দিন নির্দেশ করে); Image Source: watchesbysjx.com

ঘড়ির সর্বশেষ মুখটি অর্থাৎ ষষ্ঠ মুখটি মূলত ফ্রান্স অথবা সুইডেনের সময় দেয়, দেখতে অনেকটা পকেট ঘড়ির মতই। মূলত এটি পুরো ঘড়িটির নিয়ন্ত্রণকারী অংশ হিসেবে কাজ করে। ঘড়িটির একেবারে উপরে আছে কাচের গ্লোব। এই গ্লোবের মধ্যে দুটি গোলক অবস্থিত, যার একটি সূর্য এবং অন্যটি চাঁদ নির্দেশ করে এবং সেই অনুযায়ী ঘুরতে থাকে।

ষষ্ঠ মুখ; Image Source: watchesbysjx.com

তো এই ছিলো জাপানের এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে সবথেকে জটিল যন্ত্র। শুধু জাপান বললে ভুল হবে, বরং বলা চলে এই বিশেষ ঘড়িটি পৃথিবীর জটিলতম যন্ত্রদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, যখন তানাকা এই ঘড়ি আবিষ্কার করেছিলেন, তখন জাপানে কোনো তড়িৎশক্তি ছিলো না। তাহলে এই ঘড়ি চলতো কীভাবে?

ঘড়ির উপরে দিকে কাচের গ্লোবের মধ্যে আছে সূর্য ও চন্দ্রের ক্ষুদ্র প্রতীকি চিহ্ন; Image Source: watchesbysjx.com

সারা বছর ঘড়িটিতে শক্তি সরবরাহের এই গোপন পদ্ধতিটি নিহিত আছে ঘড়ির ভেতরে অবস্থিত চারটি মূল স্প্রিংয়ের কার্যপ্রণালীর মধ্যে। স্প্রিংগুলো একটি ক্রাংকের সাহায্যে প্যাঁচ দেয়া হয়। সবথেকে অবাক করা ব্যাপার হলো, এই স্প্রিংগুলোর প্রত্যেকটিই হাতে তৈরি। এই চারটি স্প্রিং কাজ করে মূলত জোড়া হিসেবে। অর্থাৎ, একজোড়া স্প্রিং পুরো ঘড়িটির ছয়টি ডায়ালের সময় নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি একজোড়া স্প্রিং ঘড়িটির ঘণ্টাধ্বনিসহ বাকি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।

তানাকার আবিষ্কৃত এই ঘড়ি এতটাই জটিল ছিলো যে, সেটার প্রতিলিপি তৈরিও খুব একটা সহজ কাজ ছিলো না কখনো। এমনকি তানাকা মাত্র এই একটি ঘড়িই তৈরি করেছিলেন তিন বছরের পরিশ্রমে। এই ঘড়িটির সাথেই অমর হয়ে আছেন জাপানের এডিসন হিসাশিগে তানাকা।

Featured Image: watchesbysjx.com
References: The references are hyperlinked inside the article.
Description: This is a Bangla article about 'The Myriad Year Clock' which is considered as the most complex clock that have ever made in japan (infact in the world).

Related Articles