দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একটি নির্দিষ্ট জাতিসত্ত্বার মানুষকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পুরো ইউরোপে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নয়, তার আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে যে এন্টি-সেমিটিজমের (ইহুদি-বিদ্বেষ) চর্চা শুরু হয়েছিল, তাতে সেদেশের ইহুদিদের জীবনে নেমে আসে আঁধারের ঘনঘটা। তাদের সামাজিকভাবে বয়কটের ডাক দেয়া হয়, গণমাধ্যমে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রচার করা হতো, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তাদের একঘরে করে ফেলা হয়, ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নামে ঘৃণা ছড়িয়ে জনসমর্থন তৈরি করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এমনিতেই তারা সংখ্যালঘু হওয়ায় জার্মানিতে বেশ কিছু নাগরিক-অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, উপরন্তু চারদিকে যখন ইহুদিবিদ্বেষের চর্চা শুরু হয়, তখন তাদের পালিয়ে বাঁচার পথও খোলা ছিল না। স্রেফ নির্দিষ্ট জাতিসত্ত্বার অন্তর্গত হওয়ার জন্য তাদের মুখ বুজে সমস্ত বর্ণবাদী আচরণ মেনে নিতে হয়েছিল।
জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতায় আরোহনের প্রেক্ষাপট যদি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে- তার রাজনৈতিক দল ইহুদি ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে বিশাল জনসমর্থন তৈরি করতে সক্ষম হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান সমাজের ভয় ছিল- হয়তো অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে কমিউনিস্টরা দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ফেলতে পারে। এজন্য হিটলার যখন কমিউনিস্টদের উপর নিপীড়ন শুরু করেন, তখন দেশের স্থানীয় প্রায় সমস্ত মানুষ তার অন্যায় কর্মকান্ডে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন প্রদান করে। তাদের আশঙ্কা ছিল- যদি কমিউনিস্টরা জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, তাহলে কারও কোনো ব্যক্তিগত পুঁজি থাকবে না, থাকতে দেয়া হবে না। আবার কমিউনিস্টদের এক বড় অংশ ছিল জাতিতে ইহুদি– যে বিষয়টি জার্মানিতে ইহুদিবিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। মোটামুটি ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালানোর জন্য যে ধরনের প্রেক্ষাপট দরকার হয়, তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দরকার ছিল একটা অজুহাত, যা নাৎসিদের গণহত্যাকে বৈধতা প্রদান করবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে এর প্রথম শিকার ছিল ইহুদিরা। অস্ট্রিয়া কিংবা পোল্যান্ড– নাৎসিরা যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই ইহুদিদের কচুকাটা করেছে। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়গুলোর একটি– কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয় ইউরোপজুড়ে। এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে একেবারে অমানবিক অবস্থায় হাজার হাজার ইহুদিকে বন্দী করে রাখা হয়। তাদের পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হতো না, ভেতরের পরিবেশ এতটাই খারাপ ছিল যে বন্দীরা অসুস্থ হয়ে পড়লেও ওষুধ দেয়া হতো না। বাইরে থেকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কতটুকু খাদ্য প্রবেশ করবে– এটি খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। হাজার হাজার ইহুদিকে মেরে ফেলতে অনেক বেশি বুলেট খরচ হচ্ছিল, এজন্য একসময় গ্যাস চেম্বার তৈরি করা হয়। এই গ্যাস চেম্বারগুলোর মাধ্যমে একসাথে অনেক মানুষকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বিষাক্ত গ্যাসের সহায়তায় মেরে ফেলা হতো। নাৎসিরা এতটাই বীভৎস রূপ ধারণ করে যে, মৃত ব্যক্তিদের শরীর থেকে চর্বি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে সাবান তৈরি করে জীবিত বন্দীদের ব্যবহার করতে বাধ্য করা হতো!
তবে সব ইহুদি ধর্মাবলম্বীই কি নাৎসিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন কিংবা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন? অবশ্যই না। অনেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই জার্মানি ও তার আশেপাশের দেশগুলো থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছিল, যু্দ্ধ শুরু হলেই তাদের উপর গণহত্যা শুরু হবে। তবে যুদ্ধের সময়ও অসংখ্য ইহুদি নাৎসিদের দখলকৃত অঞ্চল থেকে পালাতে সক্ষম হন। আমেরিকা যুদ্ধের আগে থেকেই ইহুদিদের জন্য নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। নিউ ইয়র্কে পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় ইহুদি ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল বেশি। তাই পালাতে চাওয়া ইহুদিরা চেষ্টা করেছিল যেন কোনোভাবে আমেরিকায় চলে যাওয়া যায়। দেখা গিয়েছে, অনেকের আত্মীয় যুদ্ধের আগে থেকেই নিউ ইয়র্কে থাকেন। এভাবে আত্মীয়ের সহায়তায় অনেকে আমেরিকায় যান। তবে অর্থনৈতিক ও আইনগত কারণে একটি পরিবার থেকে একজনের বেশি যাওয়ার ঘটনা ছিল খুবই কম।
অনেক ইহুদি আমেরিকায় গিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করা। তারা জানত তাদের পরিবারের সদস্যরা নাৎসিদের হাতে হত্যার শিকার হচ্ছে, নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে ভিন্ন একটি দেশে গিয়ে আরামের জীবনযাপন করা তাদের কাছে নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য ছিল না। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন প্রথমদিকে তাদের কাউকে মার্কিন সেনাবাহিনীতে নিতে আগ্রহী ছিল না। কারণ নাৎসিদের নেতৃত্বে পরিচালিত অক্ষশক্তির বিপক্ষে লড়াই করার জন্য প্রয়োজন ছিল সামরিক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা, যা এই মানুষগুলোর ছিল না। তারা মূলত নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের নেশায় বুঁদ হয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে মার্কিন সেনাবাহিনী অসংখ্য অভিবাসীকে উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। যারা আমেরিকার নাগরিকই নয়, তাদেরকে কেন আমেরিকা নিজেদের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মতো স্পর্শকাতর ইউনিটে নিয়োগ দিয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল দুটি পক্ষ ছিল অক্ষশক্তি ও মিত্রপক্ষ। মিত্রপক্ষে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকার মতো দেশগুলো। অপরদিকে অক্ষশক্তিতে ছিল জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো। যুদ্ধের মূল জায়গা ছিল ইউরোপ। আমেরিকার সাথে ইউরোপের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক অমিল ছিল অনেক। যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ সঠিকভাবে গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে প্রতিপক্ষের গোপন তথ্য বের করে আনা এবং সেই তথ্যগুলো যদি সাংকেতিক ভাষায় লেখা হয়ে থাকে, তাহলে সেগুলোর সঠিক অর্থ খুঁজে বের করা। আমেরিকার গোয়েন্দারা অক্ষশক্তির বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখে- সেখানে তারা ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত কারণসহ আরও বেশ কিছু কারণে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বেশ ঝামেলায় পড়ছেন। তাই মার্কিন সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে এমন কিছু মানুষের দরকার ছিল, যারা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা রাখেন।
মার্কিন প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়, যেসব অভিবাসী ইউরোপ থেকে আমেরিকায় গমন করেছেন, তাদের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদানের পর উপযুক্ত প্রশিক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধে পাঠানো হবে। প্রথমে যাদের ভাষাগত দক্ষতা ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা ছিল, তাদের বাছাই করা হয়। এরপর বাছাইকৃত ব্যক্তিদের ওয়াশিংটনের ম্যারিল্যান্ডে ক্যাম্প রিচিতে পাঠানো হয় প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে এরপর তাদের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। ক্যাম্প রিচিতে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তাদের নাম দেয়া হয়েছিল 'দ্য রিচি বয়েজ' (The Ritchie Boys)। মূলত তাদের ফ্রন্টলাইনে অক্ষশক্তির বন্দীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর অক্ষশক্তির গোয়েন্দাদের কার্যক্রমের প্রতি নজরদারি চালানোর দায়িত্বও প্রদান করা হয়। প্রায় সত্তরটি দেশের উনিশ হাজার ব্যক্তিকে ওয়াশিংটনের ম্যারিল্যান্ডের ক্যাম্প রিচিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। এই মানুষদের এক বড় অংশ ছিল জার্মানি থেকে আগত ইহুদি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও অনেকে দোভাষী ও অন্যান্য পেশার মাধ্যমে মার্কিন সেনাবাহিনীর সাথে সংযুক্ত ছিলেন। সম্প্রতি মার্কিন সিনেটে তাদের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়েছে।
যুদ্ধের পর কয়েক দশক পার হয়ে গেলেও 'দ্য রিচি বয়েজ'-এর কার্যক্রম সম্পর্কিত ডকুমেন্টগুলো গোপন করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের অবদান সম্পর্কে মার্কিন গণমাধ্যমে বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকে। আমেরিকা অক্ষশক্তির হাত থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের চমৎকারভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করে। যারা অভিবাসী হওয়ার পরও ম্যারিল্যান্ডে ট্রেনিংয়ের পর মার্কিন সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে কাজ করেছিলেন, তারাও এতে খুশি ছিলেন। কারণ তারা নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পেরেছিলেন, আর যুদ্ধের সময়ে যেখানে কর্মসংস্থান হওয়া খুব কঠিন, সেখানে স্থায়ী নিয়োগ পেয়েছিলেন। লাভ হয়েছিল দুপক্ষেরই। 'দ্য রিচি বয়েজ' ছিল আক্ষরিক অর্থেই আমেরিকার গোপন অস্ত্র, যার মাধ্যমে আমেরিকা তার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গতি বাড়িয়েছিল বহুগুণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার বিজয়ের পেছনে 'দ্য রিচি বয়েজ'দের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই মোটেও।
Language: Bangla
Topic: The Ritchie Boys, the secret weapon of USA during the second world war
Reference:
২) The untold story of the Ritchie Boys - Macleans
৩) The ‘Ritchie Boys’: The Jewish U.S. Soldiers Who Helped Defeat the Nazis - USO