দ্য ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে কর্মরত পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। প্রথম দেখায় আপনার আপনার মনে হতে পারে, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমান সুযোগ দিতে হয়তো বিখ্যাত কোম্পানিটি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু আপনার ভুল ভেঙে যাবে আপনার। তৈরি পোশাকনির্মাতা এই কোম্পানির কারখানায় এত বেশি সংখ্যক নারী নিয়োগের মূল কারণ অল্প পারিশ্রমিকে বেগার খাটানো। সেসময় আমেরিকায় পুরুষদের তুলনায় নারীরা অনেক কম সংগঠিত ছিলেন, এবং পারিশ্রমিক নিয়ে তাদের সাথে কোম্পানি মালিকদের ঝামেলার নজিরও কম ছিল। এটাও ছিল কারখানায় নারীদের প্রাধান্য দেয়ার আরেকটি বড় কারণ। কারখানার মালিকদের সাথে শ্রমিকদের ঝামেলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া একেবারে নতুন কিছু নয়, আর মালিকেরা চাইতেনই সর্বাধিক মুনাফা লাভে যেন কোনো ব্যঘাত না ঘটে।
কারখানায় চাকরিরত নারীদের মাঝে অল্পবয়সীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। ইতালি ও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে অভিবাসী হিসেবে আসা ইহুদি ধর্মাবলম্বী তরুণীদের এই কারখানায় চাকরি দেয়া হয়। দারিদ্র্যের মাঝে বড় হওয়া এই তরুণীরা ভেবেছিল, কারখানায় কাজের মাধ্যমে পরিবারের হাল ধরা যাবে, নিজের না বলা আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেয়া যাবে। এই ভেবেই কারখানায় কাজ করতে এসেছিল তারা। হাড়ভাঙা খাটুনি, কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবেশ, মালিকপক্ষের দুর্ব্যবহার, শ্রমের তুলনায় অল্প পারিশ্রমিক– এসব আমলে নেয়ার চিন্তা করেনি তারা।
দ্য শার্টওয়েস্ট ট্রায়াঙ্গেল কোম্পানিও কখনও তার নারীশ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি, পাছে তাদের মুনাফা কমে যায়! মালিকেরা মনে করতেন, শ্রমিকদের একটি দাবি মেনে নেয়া হলে পরবর্তীতে আরেকটি অধিকারের জন্য দাবি তুলবে তারা। পুঁজিবাদ যে কতটা নির্মম হতে পারে, তা সেসময়ের আমেরিকান কারখানাগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যেত।
১৯০৯ সালে পুরো আমেরিকায় কারখানায় কর্মরত নারীরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য ধর্মঘট ডাকে। সপ্তাহে ৫২ কর্মঘন্টা, পারিশ্রমিক ২০% বৃদ্ধি, অযৌক্তিক জরিমানা বন্ধ ইত্যাদির দাবিতে ইহুদি নারীরা কর্মক্ষেত্র ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং দাবি না আদায় হওয়া পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে ফিরে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালিকেরা পড়ে বেশ বিপাকে, কারণ প্রতি কর্মঘন্টায় তাদের বড় অংকের মুনাফা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। এজন্য প্রায় সব পোশাক কারখানার মালিকই শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে আহ্বান জানায়।
কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল দ্য শার্টওয়েস্ট ট্রায়াঙ্গেল কোম্পানি। তারা দাবি তো মেনে নেয়ইনি, উল্টো নারীশ্রমিকদের হয়রানি করতে শুরু করে। পুলিশকে ঘুষ দেয়ার মাধ্যমে অনেক নারীশ্রমিককে গ্রেফতার করানো হয়। এছাড়া আন্দোলন ত্যাগ করে কারখানায় ফেরত না গেলে চাকরি থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেয়। ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই কোম্পানির নারীশ্রমিকেরা কোনো সমঝোতা ছাড়াই কারখানায় ফিরে যায়।
নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের ওয়াশিংটন স্কয়ারের পাশে গ্রিনউইচ নামের গ্রামে একটি দশতলা বিল্ডিংয়ের একেবারে উপরের তিনটি তলায় নারীশ্রমিকেরা কাজ করতেন। ১৯১১ সালের ১৫ মার্চে বিকেলবেলা শ্রমিকেরা কাজ শেষে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেসময়, আনুমানিক চারটার একটু পরে, আটতলায় ধোঁয়া দেখা যায়। নারীশ্রমিকেরা বুঝতে পারেন, আগুন লেগেছে। তারা বের হওয়ার জন্য প্রচন্ড তাড়াহুড়ো করতে থাকেন, কিন্তু মানুষের সংখ্যার তুলনায় বের হওয়ার সিড়ি ছিল একদম কম। মাত্র দুটি সিড়ি ও একটি এলিভেটর দিয়ে প্রায় পাঁচশো নারীশ্রমিকের নিচে নেমে আসা অসম্ভবই ছিল। তাই বেশিরভাগ অল্পবয়সী নারীশ্রমিক ভয়ে ছোটাছুটি করছিলেন, কেউ কেউ আবার জানালা দিয়ে লাফিয়েও প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেছিলেন। এলিভেটরের ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ১২ জন। চারবার নিচে যাওয়ার পর পঞ্চমবারের বেলা লিফট আর উপরে উঠতে পারেনি, আগুনের তাপে গলে গিয়েছিল।
ফ্যাক্টরির নারীশ্রমিকেরা যেন বাইরে বেরোতে না পারে, সেজন্য দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়া হতো। কারণ বের হতে দিলেই মালিকপক্ষের আশঙ্কা ছিল যে উৎপাদন কমে যেতে পারে! এছাড়া নারীদের একে অপরের সাথে কথা বলাও বন্ধ ছিল। সেসময়ে আমেরিকার প্রায় সব কারখানার মতো এখানেও লাল রং করা বালতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে আগুন লাগলে বালতিগুলোর মাধ্যমে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু একটি বালতিতেও পানি ছিল না। ১৯৬০ সালের দিকে সেই কারখানার একজন প্রাক্তন কর্মী, মেরি ডোমস্কি-আব্রামস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "সেই দুর্ঘটনার দিন আমি আমার একজন সহকর্মীকে বলেছিলাম, বালতিগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। দুর্ঘটনায় সময় এগুলো কোনো কাজে আসবে না।"
নিউ ইয়র্ক শহরের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন ঘটনাস্থলে আসেন, ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আর সেসময়ে ছয়তলার উপরে আগুন নেভানোর ক্ষমতা ছিল না ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। কারখানার ম্যানেজার নিজে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের সাহায্যে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আগুনের ব্যাপকতা এত বেশি ছিল যে তিনি একা তেমন কিছুই করতে পারেননি। যে মেয়েরা সিড়ির মাধ্যমে পালাতে চেয়েছিল, তাদেরকে আরও বেশি ভয়াবহতার শিকার হতে হয়, কারণ সিড়ির শেষের দরজা বাইরে বন্ধ করা ছিল। তারা অধিকাংশই আগুনে পুড়ে মারা যান। কোম্পানির মালিক ও অন্য শ্রমিকেরা ছাদের উপর অবস্থান নেন এবং পরবর্তীতে লাফিয়ে অন্য ভবনের ছাদে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। একেবারে উপরের তলার নারীশ্রমিকেরা ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে সক্ষম হন।
দ্য ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট কোম্পানির এই দুর্ঘটনায় আমেরিকার নাগরিকসমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মেট্রোপলিটন অপেরা হাউজে জরুরি সম্মেলন ডাকা হয়। দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরেই শেষকৃত্যানুষ্ঠানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ নাগরিক জড়ো হন। এরপর ঘটনার তদন্ত ও এর পেছনে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে নাগরিকসমাজের পক্ষ থেকে বারবার দাবি আসতে থাকে। কোম্পানির মালিক ম্যাক্স ব্ল্যাংক ও আইজ্যাক হ্যারিসকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে আদালতে হাজির করা হয়, কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে বিচারক তাদের দেননি। তীব্র জনরোষ থেকে বাঁচতে আদালতের পেছনের দরজা দিয়ে তাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে মালিকপক্ষ থেকে নিহতদের প্রতিটি পরিবারকে ৭৫ ডলার জরিমানা প্রদান করা হয়।
নিউ ইয়র্কের অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব এই দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী করে সেখানকার প্রশাসনকে। কারণ কারখানাগুলোর সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিউ ইয়র্কের আইনপ্রণেতারা 'দ্য ফ্যাক্টরি ইনভেস্টিগেটিং কমিশন' নামের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে যারা পরবর্তী বছরগুলোতে নিউ ইয়র্কের হাজার হাজার কারখানার রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করে। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের 'নিউ ডিল' পরিকল্পনায় শ্রমিকদের অনেক অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়।
দ্য ট্রায়াঙ্গেল ট্রাজেডি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর টেক্সটাইল দুর্ঘটনাগুলোর একটি। মাত্র আঠার মিনিটের এই দুর্ঘটনায় ১৪৬ জন মানুষের মৃত্যু বুঝিয়ে দেয় কত মর্মান্তিক ছিল এটি। এই ঘটনার পর আমেরিকান কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। শ্রমিকদের রক্ত যাওয়া ছাড়া যে অধিকার আদায় হয় না, এই ঘটনা আমাদের সামনে সেই সত্যই তুলে ধরে। ৯/১১ এর আগপর্যন্ত এটি ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া শ্রমিকেরা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যান।
This Bengali article discusses the tragic history of the Triangle Shirtwaist Factory.
Reference:
১) How the Horrific Tragedy of the Triangle Shirtwaist Fire Led to Workplace Safety Laws - History
২) Uncovering the History of the Triangle Shirtwaist Fire - Smithsonian Magazine
৩) The Triangle Shirtwaist Factory Fire: An American Tragedy - ASSP
৪) How a tragedy transformed protections for American workers - National Geographic
Feature Image: Click America