(আগের পর্বে ফরাসিদের হাত থেকে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা অর্জন, ভিয়েতনামের কিংবদন্তি গোয়েন্দা ফ্যাম জুয়ান অ্যানের পেশাগত জীবনের সূচনা, উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের দ্বন্দ্ব ও পরবর্তীতে সামরিক সংঘর্ষ বেধে যাওয়া, ফ্যামকে নিয়ে উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির পরিকল্পনা ইত্যাদি সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই পর্বে দেখানো হবে দক্ষিণ ভিয়েতনামে ফ্যামের নতুন কর্মসংস্থান, সুকৌশলে উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কাছে তথ্য সরবরাহ করার প্রক্রিয়া, দক্ষিণ ভিয়েতনামের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহ ও যুদ্ধের পর অখন্ড কমিউনিস্ট ভিয়েতনামে ফ্যামের স্বাভাবিক জীবন।)
আমেরিকায় পড়াশোনা ও সাংবাদিকতার পাঠ চুকিয়ে যখন ফ্যাম জুয়ান অ্যান দক্ষিণ ভিয়েতনামে পা রাখেন, তখন তার মনে শঙ্কা জেগেছিল, হয়তো দক্ষিণ ভিয়েতনামের কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টিতে তার সদস্যপদ থাকার কারণে গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু এক মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন দেখা গেল তেমন কিছুই হয়নি, তখন তিনি নির্ভার হলেন। এ সময়ে তিনি দক্ষিণ ভিয়েতনামের তৎকালীন রাজধানী সায়গনে বেশ কিছু মার্কিন বন্ধু জুটিয়ে ফেলেন, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও ছিল। এরপর সুযোগমতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সে যোগ দেন তিনি। কিছুদিন পর চলে আসেন বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে। তিনি ছিলেন ভিয়েতনামের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ভিয়েতনামে টাইম ম্যাগাজিনের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার চমৎকার ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকতায় তার দক্ষতা, মার্কিনিদের বিশ্বস্ততা অর্জন– সবকিছু মিলিয়ে তিনি টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ কিংবা দক্ষিণ ভিয়েতনাম সেনাবাহিনী, সবার কাছে পছন্দের ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন।
image source: wikiwand.com
এবার জানা যাক কী সুকৌশলে 'ডাবল এজেন্ট' অ্যান উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির কাছে তথ্য পাচার করতেন। বিশ্বস্ত সাংবাদিক হিসেবে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার হাতো আসতো। অনেক সময় দু'পক্ষের ভাষাগত জটিলতার কারণে তিনি দক্ষিণ ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনী ও মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। এভাবে তিনি অনেক গোপন তথ্য অনায়াসে জেনে ফেলতেন। সাধারণত সারাদিন সংগ্রহ করা তথ্য ও নিজস্ব পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে রাতের বেলা তিনি রিপোর্টের খসড়া তৈরি করতেন। তবে এর পাশাপাশি আরেকটি কাজ করতেন। তার কাছে যেসব ফাইল আসতো, তিনি নিজস্ব ক্যামেরার মাধ্যমে সেসব ফাইলের ছবি তুলে রাখতেন। এসব ছবি উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে পাঠানো ছিল বেশ ঝুঁকির কাজ।
এখানেই মূলত 'ডাবল এজেন্ট' ফ্যাম জুয়ান অ্যান নিজের সর্বোচ্চ দক্ষতা প্রদর্শন করতেন। তিনি যেসব ছবি তুলতেন, সেগুলো পরবর্তীতে একটি টিফিন বাক্সে রাখতেন, যেটাতে তার দুপুরের খাবার থাকতো। ফ্যাম নিজের দুপুরের খাবারের সাথে এসব ছবি নিয়ে আসতেন কর্মক্ষেত্রে, এরপর কাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে নির্দিষ্ট স্থানে সাথে থাকা টিফিন বাক্সটি ফেলে দিতেন, যে টিফিন বাক্সে শুধু ছবিগুলো থাকত। এই কৌশলকে ইন্টেলিজেন্সের ভাষায় বলা হয় 'ডেড-লেটার বক্স' কৌশল। এই কৌশলের মাধ্যমে একপক্ষ আগে থেকেই নির্ধারিত কোন জায়গায় চিঠি বা স্পর্শকাতর তথ্য কোনো বাক্স বা অন্য বস্তুর ভেতরে ফেলে রাখে। অপরপক্ষ সেই নির্ধারিত জায়গা থেকে সেই বাক্স বা বস্তু সংগ্রহ করে। তবে দুই পক্ষেরই আগে থেকে 'ড্রপিং প্লেস' নির্ধারিত করে রাখতে হয়। ধারণা করা হয়, অ্যান যে জায়গায় ছবিভর্তি টিফিন বাক্স ফেলে রাখতেন, সেটি উত্তর ভিয়েতনামের গোয়েন্দা সংস্থা কোনো এজেন্ট কিংবা গোয়েন্দা অফিসারের মাধ্যমে সংগ্রহ করে উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে নিয়ে আসতো। এভাবেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য উত্তর ভিয়েতনামে পাচার করা হতো।
দক্ষিণ ভিয়েতনামে সবচেয়ে বড় আক্রমণ করা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ৩০ জুন। এই দিনে আক্রমণের যে পরিকল্পনা, তা প্রণয়নে বহুলাংশে অবদান রেখেছিলেন সাংবাদিক ও গুপ্তচর অ্যান। মূলত সায়গনের বিভিন্ন স্থাপনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছিলেন, তার উপর ভিত্তি করেই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় এই আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল। যখন উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী এই আক্রমণ চালায়, তখন সায়গনে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা ছিল একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায়। কিন্তু আক্রমণ শুরু হওয়ার পর মার্কিন সেনারা খুব দ্রুত নিজেদের সামলে নিয়ে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের প্রতিহত ও পাল্টা আক্রমণ করত শুরু করে। দেখা গিয়েছিল, আক্রমণ করতে আসা চুরাশি হাজার উত্তর ভিয়েতনামি কমিউনিস্ট মারা গিয়েছে, মার্কিনিদের হতাহতের হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু তারপরও অ্যান পরের দিন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, উত্তর ভিয়েতনামিদের আক্রমণে মার্কিন সেনারা বিশাল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
এটা ছিল ডাবল এজেন্ট অ্যানের একটা কৌশল। তিনি চেয়েছিলেন আমেরিকায় এই ধরনের কিঞ্চিৎ মিথ্যা অথচ কার্যকরী খবর প্রকাশিত হলে দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনীর উপর একধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। মার্কিনিরা এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যরা অন্য আরেকটি দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু এটাই হয়েছিল। আমেরিকান গণমাধ্যম যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে শুধু মার্কিন সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা প্রকাশে গুরুত্ব আরোপ করেছিল, মার্কিন জনগণ এই যুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করার জন্য রাস্তায় নেমে আসে। এটি যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের আরেকটি বড় কারণ ছিল। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রতিদিন বিশাল অংকের অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছিল, অথচ কোনো ফলাফল আসছিলো না। এই বিষয় বিবেচনা করেও শেষ পর্যন্ত আমেরিকা যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হয়, আমেরিকা ভিয়েতনামের মাটি থেকে তল্পিতল্পাসহ পালিয়ে যায়, ঠিক যেভাবে বিশ বছর আগে ফ্রান্স পালিয়েছিল।
সহকর্মীদের সাথে অ্যান বরাবরই ভালো ছিলেন। আড়ালে তিনি তথ্য পাচার করলেও কখনও তার সহকর্মীদের সেটা বুঝতে দেননি। সবসময় হাসিখুশি থাকতেন, আশেপাশের মানুষদের মাতিয়ে রাখতেন। সহকর্মীদের বিপদেও তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। যুদ্ধ যখন শেষের দিকে, তখন তার সহকর্মী রবার্ট স্যাম অ্যানসনকে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্টরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। নিরূপায় হয়ে রবার্ট স্যাম অ্যানসনের স্ত্রী 'ডাবল এজেন্ট' অ্যানের কাছে তার স্বামীর প্রাণভিক্ষা প্রার্থনা করেন। শেষ পর্যন্ত উত্তর ভিয়েতনামে নিজের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে ফ্যাম তার সহকর্মীকে উদ্ধার করেন, কমিউনিস্টরা ফ্যামের অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয়। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমেরিকার পরাজয় যখন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তখন যে যার মতো প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত ছিল। তখন ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনে টাইম ম্যাগাজিনের কার্যালয়ে কেউই ছিল না। সেই সময়েও ভন টাইম ম্যাগাজিনের কার্যালয়ে অবস্থান করেছিলেন। অথচ চাইলেই তিনি আমেরিকায় গিয়ে বাকি জীবন আরামে কাটিয়ে দিতে পারতেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদেরকে তিনি তার মার্কিন সহকর্মীদের সাথে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ক'বছরের মাথায় ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির আদেশে তার পরিবার আবার ভিয়েতনামে ফিরে আসে। অবশ্য পরে তিনি তার মার্কিন সহকর্মীদের সহযোগিতায় তার ছেলেকে আমেরিকায় পড়ান। স্বাধীন ও অখন্ড ভিয়েতনামে বাকি জীবনে তিনি কখনও আর্থিক কোন টানাপোড়েনের সম্মুখীন হননি, তাকে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত পেনশন ও ভাতা দেয়া হতো। তবে তাকে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট সরকার কঠোর নজরদারিতে রেখেছিল। ২০০৬ সালে ভিয়েতনামের হো চি মিন শহরে তিনি ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে যেমন মার্কিন গণমাধ্যম শোক প্রকাশ করেছিল, তেমনই ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টিও শোক প্রকাশ করেছিল।
Language: Bangla
Topic: The Vietnamese spy who tricked the Americans
Reference:
১) The Surprising Story of the Spy who Worked for TIME - TIME
২) PHAM XUAN AN: THE SPY WHO TRICKED AMERICA - OZY
৩) Pham Xuan An, 79; Journalist Who Was Later Revealed to Be Viet Cong Spy - LA Times