Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভায়োলেট জেসোপ: টাইটানিকসহ তিন জাহাজডুবিতে বেঁচে ছিলেন যিনি

ধরণীতে অবতীর্ণ হওয়ার আগ থেকেই টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল ভায়োলেট কনস্ট্যান্স জেসোপকে। বাবা-মা’র নয় সন্তানের মধ্যে মাত্র ছয়জন ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার সুযোগ পেয়েছেন। এই ছয়জনের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি ভায়োলেট। আরেকটু বড় হতেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত ভায়োলেটের বেঁচে থাকার আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা, সে অবস্থা থেকেও বেঁচে ফিরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। সারা জীবনব্যাপী এভাবে বেঁচে থাকাকেই যেন এক চমকপ্রদ ঘটনায় পরিণত করেছেন তিনি। সময়ের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক জাহাজ ‘টাইটানিক’ থেকে শুরু করে একই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্মিত টাইটানিকের দুটি সিস্টার শিপ ‘ব্রিটানিকা’ ও ‘অলিম্পিক’ ডুবির একমাত্র জীবিত সাক্ষী ভায়োলেটের নামই হয়ে যায় ‘মিস আনসিংকেবল’ বা যাকে ডুবানো সম্ভব নয়। চলুন তবে জেনে আসা মিস আনসিংকেবলের কাহিনী।

সৌভাগ্যকে সঙ্গী করে পৃথিবীর মুখ দেখা ভায়োলেট জেসোপের জন্ম ১৮৮৭ সালে আর্জেন্টিনায়। চিকিৎসকরা যখন বলেছিলেন, যক্ষ্মারোগী ভায়োলেটের আয়ু আর মাত্র কয়েক মাস, তার আইরিশ বংশোদ্ভূত বাবা-মা তখন খুব চিন্তায় পড়ে যান। তিন সন্তানের মৃত মুখ দেখা এই দম্পতির চতুর্থবার একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহসটুকুও আর অবশিষ্ট ছিল না। ভায়োলেটকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার বোধহয় অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল। তাই সে সময় দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে পরিচিত যক্ষ্মা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে দিব্যি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন কাটান তিনি। বাবার মৃত্যুর পর, মা তাদের ছয় ভাইবোনকে নিয়ে চলে আসেন ব্রিটেনে। এখানে এসে ভায়োলেটের মা এক জাহাজে স্টুয়ার্ডেস বা সেবিকা হিসেবে চাকরি নেন।

মিস আনসিংকেবল ভায়োলেট কনস্ট্যান্স জেসোপ; Source: spydersden.com

মা যখন জাহাজে চাকরিরত ছিলেন, ভায়োলেটকে তখন ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় এক মিশনারি স্কুলে। দুর্ভাগ্যবশত, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তার মা। ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা ও মা’র চিকিৎসা চালিয়ে যেতে মায়ের পদচিহ্ন অনুসরণ করে জাহাজে সেবিকার চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন ভায়োলেট। কিন্তু অল্পবয়স্ক, অনভিজ্ঞ ভায়োলেটকে চাকরি দিতে চাচ্ছিল না কোনো জাহাজ। মাত্র ২১ বছর বয়সী ভায়োলেটের সমসাময়িক স্টুয়ার্ডেসদের বয়স ছিল চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। মধ্যবয়সী না হলে কেউ স্টুয়ার্ডেস হতে পারবে না, এমন একটি অলিখিত নিয়ম জারি ছিল সর্বত্র। কাজেই ভায়োলেট জাহাজে চাকরির আবেদন করলে তাকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়, তার কম বয়স আর সুন্দর চেহারা জাহাজের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে! কর্মচারী থেকে শুরু করে যাত্রী পর্যন্ত সবার কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয় কতিপয় জাহাজ কর্তৃপক্ষ। তাদের সে কথা অবশ্য পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। বিভিন্ন জাহাজে কাজ করতে করতে তিনটি বিয়ের প্রস্তাব পান তিনি, যার মধ্যে একটি ছিল অস্বাভাবিক রকমের বিত্তশালী এক প্রথম শ্রেণীর যাত্রীর পক্ষ থেকে।

সে যা-ই হোক, অল্পবয়সের সমাধান নিজেই খুঁজে নেন ভায়োলেট। কোনো রকমের মেকআপ ব্যবহার না করে, পুরনো ঢিলেঢালা পোশাক পরে ইন্টারভিউ পর্ব উতরে যান তিনি। কোম্পানির নাম ‘রয়্যাল মেইল লাইন স্টিমার’। ১৯০৮ সালে তাকে নিয়োগ দেয়া হয় ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ কোম্পানিতে। ১৯১০ সালে তিনি চলে আসেন ‘অলিম্পিক’ জাহাজ কর্তৃপক্ষের কাছে। সারাদিনের ক্লান্তিকর কর্মজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে যৎসামান্য পারিশ্রমিক (মাসে ২.১০ ডলার মাত্র!) নিয়েও খুশি ছিলেন তিনি। দেশে দেশে জাহাজে করে ঘুরে বেড়াতে, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে ভালো লাগত তার। আটলান্টিকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বৈরি আবহাওয়া নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন তিনি, তবে আমেরিকানরা তাকে ‘মানুষ’ হিসেবে মর্যাদা দেয়ায় আবহাওয়ার মতো ঠুনকো ব্যাপারগুলো ভুলে থাকতেন অবলীলায়।

সৌভাগ্যকে সঙ্গী করে পৃথিবীর মুখ দেখা ভায়োলেট জেসোপ; Source: lifedaily.com

মাত্র এক বছর পরেই শুরু হয় আসল ঝামেলা। ১৯১১ সালে, ‘দ্য অলিম্পিক’ ধাক্কা খায় এইচএমএস হকের সাথে। হোক নির্মাণ করাই হয়েছিল এমনভাবে যাতে তার সাথে কেউ ধাক্কা খেলে অপর জাহাজটি ডুবে যায়। দুটি জাহাজেরই মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। পানিতে নিমজ্জিত অলিম্পিকের বাইরের কাঠামোতে ফাটল ধরে যায়, কিন্তু অলৌকিক উপায়ে জাহাজটি সে যাত্রা পানিতে ডুবে যায়নি। কোনোমতে বন্দর পর্যন্ত ঠিকমতো পৌঁছে যায় তারা। ভায়োলেট মাটিতে পা রাখেন একেবারে অক্ষত অবস্থায়, তাকে দেখে কেউ বলবে না পানিতে এত বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল অলিম্পিক! এর ঠিক দু’বছর পরে, হোয়াইট স্টার লাইন কর্তৃপক্ষ লোক খুঁজছিলেন ‘দ্য আনসিংকেবল শিপ টাইটানিক’ জাহাজের ভিআইপি অতিথিদের দেখভালের জন্য। বন্ধুমহল ও পরিবারের লোকজন তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলেন, এটি হতে পারে ভায়োলেটের ক্যারিয়ারের সেরা সুযোগ। সুনামের পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের জন্যও এমন সুযোগ দ্বিতীয়বার পাওয়া যাবে না। অগত্যা সে কথা মেনে টাইটানিকের সওয়ারি হলেন তিনি।

বাকিটুকু তো ইতিহাস। ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাওয়ার পথে প্রথম সমুদ্রযাত্রাতেই আইসবার্গ বা বিশাল বড় বরফের টুকরোর সাথে ধাক্কা খেয়ে তলিয়ে যায় টাইটানিক। সাথে নিয়ে যায় প্রায় ১৫০০ যাত্রীকে। সে যাত্রা ১৬ নম্বর লাইফবোটে চড়ে দুর্ঘটনার মোকাবিলা করে সুস্থ অবস্থায় মাটিতে অবতরণ করেন তিনি। নিজের স্মৃতিকথায় এই ঘটনাটিকে তিনি উদ্ধৃত করেছেন এভাবে,

“আমাকে বলা হলো জাহাজের ডেকে গিয়ে দাঁড়াতে। সেখানে ধীর-স্থির ভঙ্গীতে পায়চারি করছিলেন যাত্রীরা। অন্যান্য স্টুয়ার্ডেসদের সাথে নিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে বললাম পরিস্থিতি, লাইফবোটে উঠে জীবন বাঁচানোর জন্য তখন আর ভাববার সময়টুকুও হাতে নেই। চোখের সামনে দেখতে পেলাম, বাচ্চাদের নিয়ে নৌকায় ওঠার আগে স্বামীদের জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছেন নারীরা। কিছুক্ষণের মধ্যে এক অফিসারের নির্দেশে আমি ১৬ নম্বর লাইফবোটে উঠে বসি যাতে অন্যরাও বুঝতে পারেন এভাবে যাওয়াটা নিরাপদ।”

স্টুয়ার্ডেসের বেশে ভায়োলেট; Source: lifedaily.com

লাইফবোটে লাফিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে তার হাতে একটি শিশুর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়। কার্প্যাথিয়া নামক একটি জাহাজ এসে তাদের উদ্ধার করার পরপরই শিশুটির মা (অন্তত ভায়োলেটের তাই মনে হয়েছিল) তার কোল থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে যায় বাচ্চাটিকে। টাইটানিক জাহাজডুবি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, পাড়ে নেমে সবার আগে টুথব্রাশের কথা মনে পড়েছিল তার! আপনি হয়তো ভাবছেন, এত বড় দুর্ঘটনার সাক্ষী ভায়োলেট নিশ্চয়ই স্টুয়ার্ডেসের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তা না হলেও অন্তত অলিম্পিক কোম্পানির হয়ে কাজ করা তো বন্ধ করেছে। জ্বী না, এখানেই তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। টাইটানিক দুর্ঘটনার পর অল্প কিছুদিন বাড়িতে থেকে আবারও অলিম্পিক কোম্পানিরই এক জাহাজে পাল তুলে নতুন কোনো গন্তব্যের পথে পাড়ি জমান তিনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা, টাইটানিকের একটি সিস্টার শিপ বা একই কোম্পানির অপর একটি জাহাজ ‘ব্রিটানিকা’য় চড়ে নার্সের দায়িত্ব পালন করার সিদ্ধান্ত নেন ভায়োলেট। তার অতীত ইতিহাসই বলে দিচ্ছে, এরপর কী ঘটতে পারে। জার্মান এক ইউ-বোটের পুঁতে রাখা গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় ব্রিটানিকা। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটি দ্রুত ডুবতে শুরু করে। এবার আর লাফিয়ে লাইফবোটে উঠে জীবন বাঁচানোর মতো সৌভাগ্য হয়নি ভায়োলেটের। জাহাজ এত দ্রুত ডুবে যাচ্ছিল যে কে কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। মাত্র ৫৭ মিনিটে তলিয়ে যাওয়া ব্রিটানিকার সাথে প্রাণ হারান কমপক্ষে ৩০ জন। কোনোমতে জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়েন তিনি। তার নিজের ভাষ্যমতে,

“আমি পানিতে লাফিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু আটকে গেলাম জাহাজের তলায়। আমি না বলে বলা ভালো আমার মাথা আটকে গেল। সে যাত্রা কোনোমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে তীরে উঠলেও মাথাব্যথা হয়ে গেল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। এই ঘটনার বহুবছর পর মাথাব্যথা আরও তীব্র আকার ধারণ করলে আমার চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখলেন, খুলিতে বেশ রকমের একটা ফ্র্যাকচার রয়েছে!”

১৯২৩ সালে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ভায়োলেট (সর্বডানে); Source: encyclopedia-titanica.org

মজা করে তিনি বলতেন, ঘন ও দীঘল চুলের জন্যই নাকি ১৯১৬ সালের এই দুর্ঘটনায় জানে বেঁচে গিয়েছিলেন। কুশনের মতো করে চুলই নাকি তাকে আঘাত থেকে বাঁচিয়েছিল! তবে এবার জাহাজ থেকে লাফ দেয়ার আগে তিনি টুথব্রাশ সাথে নিতে একদম ভুল করেননি। টাইটানিক ডুবি থেকে একবার শিক্ষা নিয়ে ব্রিটানিকা ডুবির পরে তার প্রিয় টুথব্রাশ হাতে নিয়ে পাড়ে উঠেছিলেন তিনি। কত যে আজব খেয়াল আছে মানুষের! এই বিশাল আকারের দুর্ঘটনাও দমাতে পারেনি ভায়োলেটকে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে পরিবহনের জন্য তুমুল জনপ্রিয় যানে পরিণত হয় জাহাজ। ক্রুজ শিপের যাত্রাও শুরু হয় সে সময় থেকে। ‘রেড স্টার লাইন’ কোম্পানিতে যোগ দেয়ার জন্য ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ ছেড়ে দেন ভায়োলেট। এখানে বহু বছর কাজ করেছেন তিনি।

ভায়োলেটসহ জাহাজে ভ্রমণরত প্রতিটি যাত্রীর সৌভাগ্য জাহাজে থাকা অবস্থায় আর কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি তাদের। এরপরে আর কোনো জাহাজ এমন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এক অফিসে কেরাণীর চাকরি নিয়ে থিতু হওয়ার চিন্তাভাবনা করেন তিনি। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার যার নেশা আর বিপদকে সৌভাগ্যে পরিণত করার যার নেশা, তিনি কেন অমন বাবুসাহেবের মতো চাকরি করতে যাবেন? কাজেই আবারও রয়্যাল মেইল শিপসে যোগ দেন তিনি। ৬১ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন সেখান থেকে। বাকি জীবন বাগানে কাজ করে, হাঁস-মুরগির দেখাশোনা করেই কাটিয়ে দেন। ১৯৭১ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ৮৪ বছর বয়সী ভায়োলেট জেসোপ। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে মাত্র ছয় মাসের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। কোনো সন্তান ছিল না তার। কাজেই একাকী পৃথিবী থেকে বিদায় নেন মিরাকলের এক বাস্তব উদাহরণ ভায়োলেট।

টাইটানিক থেকে ১৬ নম্বর লাইফবোটে করে বেঁচে ফেরা ভায়োলেট; Source: paraloscuriosos.com

বিয়াল্লিশ বছর সমুদ্রে কাটানো জীবনের স্মারকচিহ্ন দিয়ে ঘর সাজান ভায়োলেট। ১৯৫৮ সালে ‘উইমেন ম্যাগাজিন’ কর্তৃক ‘এ নাইট টু রিমেম্বার’ শীর্ষক একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয় তার।  ‘টাইটানিক’ চলচ্চিত্রে ভায়োলেট জেসোপের চরিত্রে অভিনয় করেন অ্যামি জয়েস হ্যাস্টিংস।

ফিচার ইমেজ: paraloscuriosos.com

Related Articles