Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রানী ভিক্টোরিয়ার নিউ ইয়ার গিফট এবং একজন নির্বাসিত রাজা

বন্দী রাজাদের দূর দেশে নির্বাসনে পাঠানোর রেওয়াজ বেশ পুরাতন। শ্রীলঙ্কা বা সিংহলের শেষ রাজা বিক্রম রাজসিংহকে পাঠানো হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের ভেলোরে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী-কন্যা আর খালা ঘষেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদের প্রাসাদ থেকে পাঠানো হয়েছিল ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা প্রাসাদে।

সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের পরিণতি ইতিহাসে বেশ আলোচিত। সিপাহি বিদ্রোহের পর তাকে বন্দি হিসেবে রেঙ্গুনে পাঠিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। ওখানেই ১৮৬২ সালে প্রয়াত হন শক্তিহীন এই ভারত সম্রাট। কিন্তু অনেকেরই অজানা যে, একই পরিণতি হয়েছিল সে দেশেরও এক রাজার। ভারতের সম্রাটকে নির্বাসনে পাঠানো হলো বর্মায় আর বর্মার রাজাকে পাঠানো হলো ভারতে।

বর্মার শেষ রাজা থিবোকেও সিংহাসনচ্যুত করেছিল ইংরেজরা। যুদ্ধবন্দী হিসেবে তার জীবনের শেষ সময়গুলো কেটেছিল ভারতের মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে। ১৯১৬ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত রত্নগিরিই ছিল সিংহাসন হারানো বন্দি রাজা থিবোর শেষ ঠিকানা।

বর্মা বা বর্মী (মায়ানমার) দেশ ছিল রাজতন্ত্রের দেশ। সেখানে ছিল আভা রাজবংশের শাসন। সে বংশের উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন মিনডন মিন। তার বাবার মৃত্যুর পর সৎ ভাই পাগান সিংহাসনে বসেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ইংরেজ-বর্মা যুদ্ধে রাজা পাগানকে পরাজিত করে ১৮৫২ সালে লোয়ার বর্মায় বৃটিশরা নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করে।

kinng mindaw
রাজা মিনডন; Image: Wikimedia

তার এক বছর পর মিডন তার ছোট ভাই কনং এর সহায়তায় চাচা পাগানকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতায় বসেন। প্রজাদের চোখে সম্মানীয় ও অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজা মিনডন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপার বর্মাকে ইংরেজদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে আগলে রাখেন। তার সময়ই বার্মার রাজধানী মান্দালয়ে স্থাপন করা হয়। স্থাপন করা হয় অনন্য সুন্দর রয়েল গোল্ডেন প্যালেস, যেটি ১৯৪২ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি বাহিনী মূল অংশ ধ্বংস করে ফেলে এবং বাকি অংশ বৃটিশ বাহিনী পরে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করে।

রাজা মিনডনের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত ৬২ রাণীর গর্ভে ১১০ সন্তান ছাড়াও অগণিত রক্ষিতা আর দাসীর গর্ভেও অগণিত সন্তান জন্মলাভ করে। এমনই এক রক্ষিতার ঘরে জন্ম নিয়েছিল রাজপুত্র থিবো।

mandalay palace
গোল্ডেন প্যালেস; Image: Expedia

পরবর্তীতে রাণী সিনব্যুমাশিনের চার কন্যাকেই বিয়ে করেন থিবো। তাই রাণী ষড়যন্ত্র করতে থাকেন তার জামাতাকে সিংহাসনে বসাবার জন্যে। তার উদ্দেশ্য সফলের এই খেলায় প্রাণ দিতে হয় অনেককে। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের পহেলা অক্টোবর রাজা মিনডনের মৃত্যু হলে থিবো একুশ বছর বয়সে অগণিত মানুষের রক্তে ভেসে যাওয়া সিংহাসনে বসেন।

thibaw min
রাজা থিবো; Image: Wikimedia

অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের স্বর্ণযুগ। ভারতীয় উপমহাদেশের একের পর এক রাজ্য তাদের হস্তগত হয়ে চলেছে। বর্মার উপকূলীয় অংশ আগেই দখল করেছিল ব্রিটিশরা। আপার বার্মা বা ব্রহ্মদেশের উচ্চ অংশ ছিল স্বাধীন। এই রাজ্যেরই শেষ শাসক ছিলেন থিবো। মাত্র সাত বছর স্থায়ী হয়েছিল তার রাজত্ব। ১৮৮৫ সালে থিবো বৃটিশ বাহিনীর কাছে পরাজিত হলে সমগ্র বর্মার অধিপতি হয় তারা। এই রাজ্য বা নতুন দেশটি রাণী ভিক্টোরিয়াকে উপহার দেওয়া হয় নিউ ইয়ার গিফট হিসেবে।

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পেছনে যেমন ছিল খালা ঘষেটি বেগমের ষড়যন্ত্র। তার পতনের জন্য অনেকটাই দায়ী রাণী সুপায়ালাত। সিংহাসনের বাকি উত্তরাধিকারীদের নির্মমভাবে হত্যা করিয়েছিলেন তিনি। নিজেদের ক্ষমতা কায়েম রাখতে রাণী নিজের ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। হাত মেলালেন ব্রিটিশ বিরোধী শক্তি ফরাসিদের সঙ্গে। বর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য উপলক্ষ খুঁজছিল ব্রিটিশরা। সেটা দিয়ে দিল আভা রাজবংশই। ব্রিটিশ মালিকানাধীন বম্বে বার্মা ট্রেডিং কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে আয়কর জনিত মামলা ঠুকে দেওয়া হল। বর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ইংরেজরা। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে পতন হলো আপার বর্মার এবং রাজধানী মান্দালয়ের অধিকার নিলো ব্রিটিশরা।

রাজা থিবোকে নির্বাসনে পাঠানো হলো রত্নগিরি। ভারত মহাসাগরের উপকূলের রাজাকে পাঠানো হলো আরব সাগরের তীরে। কোঙ্কন উপকূলে সে শহর তখন ছিল অগম্য। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রত্নগিরি সবচেয়ে বিখ্যাত তার আলফানসো আমের জন্য। তবে বার্মিজ রাজ পরিবারকে ভারতের রত্নগিরিতে নির্বাসনের আগে মুর্শিদাবাদে আনা হয়েছিল কিছুদিনের জন্য এবং তখন বহরমপুরের পুরনো জেলা পরিষদ বিল্ডিংটি ছিল তাদের ঠিকানা, যা ছিল তখন নীল কুঠি।

রত্নগিরিতে ত্রিশ ঘরের একটি বিশাল বাড়ি তৈরি হয়েছিল রাজা থিবো, রাণী সুপায়ালাত ও তাদের চার মেয়ের বসবাসের জন্যে। তবে যে অট্টালিকায় থাকতেন তারা বর্মায়, তার তুলনায় নতুন ঠিকানা ছিল নগণ্য। সেই বাড়িতেই থিবো সপরিবারে থাকতেন অত্যন্ত অর্থকষ্টে। বৃটিশ সরকার থেকে কিছু অর্থ সাহায্য দেওয়া হতো কিন্তু সেটা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। শোনা যায়, অভাবে পড়ে রাজা থিবো বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন একের পর এক বর্মীয় রুবি।

রত্নগিরির বাড়ি
রত্নগিরির বাড়ি; Image: Trip Advisor

রাজ্য হারিয়ে নির্বাসনে থাকার শোক বেশি দিন সামালাতে পারেননি রাজা থিবো। ভগ্ন মনোরথ রাজা প্রয়াত হন ১৯১৬ সালে আটান্ন বছর বয়সে। রত্নগিরিতে খ্রিস্টানদের সমাধিক্ষেত্রের পাশে সমাধিস্থ করা হয় প্রাক্তন সম্রাটকে। এরপর ১৯১৯ সালে রানী সুপায়ালাত ও তিন মেয়ে ফিরে আসেন বর্মা। এক মেয়ে বিয়ে করে থেকে যান রত্নগিরিতেই। ভারতের ওয়াদিয়া শিল্পগোষ্ঠী এখনও বহন করে চলেছে সেই বর্মা রাজবংশের ইতিহাস।

সমাধি
সমাধি; Wikimedia

তবে বর্মার সামরিক জান্তা সরকার দীর্ঘদিন স্বীকৃতি দেয়নি সম্রাট থিবোকে। মায়ানমারের মানুষের কিছুই মনে নেই সেই রাজবংশের কথা। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই জানে না থিবো কে ছিলেন। কারণ সেখানকার পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়নি এসব ইতিহাস। পরে মায়ানমারে গণতন্ত্র স্থাপিত হয়। ২০১২ সালে বর্মার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থেইন শেইন রত্নগিরিতে এসে রাজা থিবোর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান। 

Related Articles