দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অসংখ্য স্মরণীয় ট্যাংক যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। এসব যুদ্ধ নিয়ে দারুণ কিছু মুভিও সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমেই মনে করিয়ে দেয়া যায় ব্রাড পিট অভিনীত বিখ্যাত Fury মুভির একটি দৃশ্যের কথা। মিত্রবাহিনীর একজন ট্যাংক গানার হিসেবে আপনার জন্য ব্যাপারটা কেমন হবে যখন আপনি শেলের পর শেল ফায়ার করেই যাচ্ছেন অথচ জার্মানদের দানব ট্যাংক কিছুতেই ধ্বংস হয় না! ইতিহাসভিত্তিক চিত্রনাট্য না হলেও Fury মুভিতে যে ব্যাপারটি দেখানো হয়েছিল তা বাস্তবে সত্যিই ভয়ংকর। নিজেদের ট্যাংকের ভেতর সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়- এই বুঝি শত্রু ট্যাংকের গোলা উড়ে এসে নিজেদের ট্যাংক ধ্বংস করে দিলো! জ্বি হ্যাঁ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান দানব টাইগার ট্যাংকের কথাই বলা হচ্ছে।
জার্মান ভাষায় টাইগার ট্যাংকের নামটি খুবই বিদঘুটে। 'টাইগার ১' ট্যাংকের জার্মান উচ্চারণ 'Panzerkampfwagen VI Tiger Ausf.E'। আশা করি নাম পড়ে আপনার দাঁত নড়বড়ে হয়ে যায়নি! এটি মূলত প্যানজার সিরিজের ষষ্ঠ ট্যাংক, জার্মান আর্মিতে প্যানজার মার্ক থ্রি, ফোর ও ফাইভ সিরিজের ট্যাংকের সংখ্যা বেশি ছিল। ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথে এটি রাজত্ব করে আফ্রিকা ও ইউরোপের ফ্রন্টলাইনগুলোতে। এর সমকক্ষ কোনো ট্যাংক মিত্রবাহিনীর ছিল না, এমনকি সমসাময়িক ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রের দ্বারা এর আর্মার ভেদ করাও সম্ভব ছিল না। ফলে টাইগার ট্যাংক ছিল মিত্রবাহিনীর ট্যাংক ক্রুদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম। একে ধ্বংস করতে খুবই বেগ পেতে হত। নোরম্যান্ডির যুদ্ধে একটি টাইগার ট্যাংকের কয়েক মিটার সামনে দাঁড়িয়ে ফায়ার করেও এর ক্ষতি করতে পারেনি কানাডিয়ান শেরম্যান।
টাইগার ট্যাংকের দুটো ভ্যারিয়েন্ট ছিল। 'টাইগার ১' ট্যাংকের ওজন ছিল ৫৪ টন। এটি চালাতে কমান্ডার, ড্রাইভার, গানার, লোডার এবং রেডিও অপারেটর কাম মেশিনগানার- এই পাঁচজন ক্রু দরকার ছিল। এর দুটো মেশিনগানে সাড়ে চার হাজার বুলেট থাকতো, যা শত্রুপক্ষের সৈনিকদের রীতিমত কচুকাটা করতে পারতো। এর মূল শক্তি ছিল তার বিধ্বংসী কামান। এতে ছিল ৯২টি হাই এক্সপ্লোসিভ ও আর্মার পিয়ারসিং শেল ধারণক্ষমতা সহ 8.8 cm KwK 36 L/56 নামের ৮৮ মিলিমিটার ব্যাসের মেইনগান যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রোডাকশনে যাওয়া ট্যাংকের মধ্যে সর্বাধিক সক্ষমতার কামান! এমন শক্তিশালী কামান আর কোনো ট্যাংকের ছিল না। মূলত এমন ভারী কামান অন্য ট্যাংকে লাগানো সম্ভব ছিল না বলেই টাইগারের জন্ম!
উল্লেখ্য, তৎকালীন রাশিয়ান IS-2 ও KV-2 ট্যাংকে যথাক্রমে ১২২ মিলিমিটার ও ১৫২ মিলিমিটার কামান ছিল। তবে ওগুলোকে ট্যাংক না বলে আর্টিলারি বলা হত। ফলে টাইগার ট্যাংক ছিল ফায়ার পাওয়ারের দিক দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী ট্যাংক। এটি ৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত হামলা চালাতে পারতো!
এই দানবের সামনের আর্মার ছিল ১২০ মিলিমিটার, যা ঐ যুগের কোনো এন্টি ট্যাংক ওয়েপন দিয়ে ভেদ সম্ভব ছিল না! এসব কারণে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে ভারি ট্যাংক ছিল এটি। আর এ কারণেই এর গতি ছিল সর্বোচ্চ ৪৫ কি.মি./ঘন্টা যা সমসাময়িক অন্যান্য ট্যাংকের থেকে অনেক কম। ভারী বডি ছাড়াও এর গতি কম হওয়ার কারণ ছিল এর ৬৯৫ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন, যা এরকম ট্যাংকের তুলনায় খুবই দুর্বল। এই ইঞ্জিন মারাত্মক রকমের ফুয়েল খরচ করতো বিধায় টাইগার ১ ট্যাংকের অপারেশনাল রেঞ্জ প্রচলিত রাস্তায় ১৯৫ কি.মি. ও অফরোডে ১১০ কি.মি.। তবে টাইগার ট্যাংক কমান্ডারদের বৈশিষ্ট্য ছিল তারা শিকারের জন্য ওঁত পেতে থাকতেন, শত্রুকে ধাওয়া করতেন না। শত্রু ট্যাংক নিজেদের গান রেঞ্জে এলেই হামলা শুরু করতেন। এসব কারণে দুর্বল ইঞ্জিন নিয়েও ফায়ার পাওয়ারের জোরে টাইগার ট্যাংক ছিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য।
Image Source : warhistoryonline.com
এই সিরিজের প্রথম ভ্যারিয়েন্ট 'টাইগার ১' বানানোর পর 8.8 cm KwK 43 L/71 কামান সমৃদ্ধ আরো শক্তিশালী এন্টি ট্যাংক শেল ফায়ার করতে সক্ষম 'টাইগার ২' নামের আপগ্রেড ভ্যারিয়েন্ট সার্ভিসে আনে জার্মানি। এই মডেলের ট্যাংকের জার্মান ডাকনাম ছিল Königstiger যা মূলত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে বোঝাত। মিত্রবাহিনীর কাছে এটি 'King Tiger' নামে পরিচিত ছিল। এটি কাজের দিক দিয়ে বেঙ্গল টাইগারের মতোই ভয়ংকর ছিল। এর আর্মার ১২০ মিলিমিটার থেকে বাড়িয়ে ১৮৫ মিলিমিটার করা হয়! ফলে এটি ওজনে আরো ভারী হয়ে যায় এবং মিত্রবাহিনীর ট্যাংকগুলো কাছে অভেদ্য হয়ে ওঠে।
৬৮.৫ টনি কিং টাইগার ট্যাংক ৪১.৫ কি.মি. বেগে চলতে পারত। অর্থাৎ আমরা বর্তমান যুগে যেসব অত্যাধুনিক হেভি মেইন ব্যাটল ট্যাংক দেখি তার সমান ওজনের ট্যাংক তখনকার যুগে কেবলমাত্র জার্মানিরই ছিল। এটি ৮৬ রাউন্ড শেল ধারণ করত, দুটো মেশিনগানে ছিল ৫৮৫০ রাউন্ড বুলেট। ইঞ্জিন আপগ্রেড না করে এর সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, তবে তা তেমন সফল হয়নি। ৮৬০ লিটার ফুয়েল নিয়ে এটি প্রথাগত রাস্তায় ১৭০ কি.মি. ও অফরোডে ১২০ কি.মি. পাড়ি দিতে পারত। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এটি চলার পথে কী রকম জ্বালানি তেল নিঃশেষ করতো। এর ফুয়েল খরচ জার্মানদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল।
মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত ছিল এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ। খুবই অ্যাডভান্সড টেকনোলজি হওয়ায় প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া এটি মেরামত করা যেত না। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে একটা যুদ্ধবিমান থেকেও বেশি অর্থ ব্যয় করা লাগত এরকম একটি ট্যাংক তৈরি করতে। টাইগার ২ ট্যাংকের ইউনিট কস্ট বর্তমানের ডলার রেট অনুযায়ী প্রায় তিন লাখ ডলার! মূলত ভারী চেসিসের তুলনায় এর দুর্বল ইঞ্জিনের কারণে ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেক ফ্রন্টে এটি অপরাজেয় হলেও সর্বত্র মোতায়েনযোগ্য ছিল না। সব মিলিয়ে মাত্র ১,৩৪৭টি 'টাইগার ১' এবং ৪৯২টি 'টাইগার ২' ট্যাংক সার্ভিসে এনেছিল জার্মানি।
মাত্র ১,৮৩৯টি টাইগার ট্যাংকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মিত্রবাহিনীর ১২ হাজারের বেশি ট্যাংক ধ্বংস হয়েছিলো! মুখোমুখি যুদ্ধে টাইগারের সাথে তেমন কেউ সুবিধা করতে পারত না বিধায় এন্টি ট্যাংক মাইনের ফাঁদে ফেলে অথবা আর্টিলারি বা বিমান হামলা চালিয়ে একে ধ্বংস করতো মিত্রবাহিনী। রাতের আঁধারে কমান্ডো হামলা চালিয়ে এর ইঞ্জিন, চেইন বেল্ট ও চাকা এবং বিশেষ করে এর বিধ্বংসী ৮৮ এমএম মেইনগানটি এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ধ্বংস করে দেয়ার বেশ কিছু ঘটনাও ঘটেছিল। যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত টাইগার ট্যাংকের খুব কমই শত্রু ট্যাংকের গোলা বা তাদের এন্টি ট্যাংক কামানের হাতে ধ্বংস হয়েছে। বর্তমানে ৭টি টাইগার ট্যাংক অক্ষত ও সচল আছে। এগুলো বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে সংরক্ষিত। Fury ও White Tiger মুভিতে সত্যিকারের টাইগার ট্যাংক দিয়ে শ্যুটিং করা হয়েছিল।
টাইগার ট্যাংক আসলে কেমন ভয়ংকর ছিল উদাহরণ হিসেবে একটি পরিসংখ্যান দেয়া যায়। ১২ আগস্ট ১৯৪৪ সালে সংঘটিত এক ট্যাংক যুদ্ধে মাত্র ৩টি কিং টাইগার ট্যাংক প্রায় ২২টি টি-৩৪/৮৫ ট্যাংক ধ্বংস করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাশান কিংবদন্তি টি-৩৪ এর সবচেয়ে আপডেট ভার্সন (৮৫ এমএম কামান থাকায় এর নাম টি-৩৪/৮৫)। রাশিয়ানরা ছিল টাইগার ট্যাংকের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। তারা এর নাম দিয়েছিলো হোয়াইট টাইগার। মুভি থেকে সংগ্রহ করা উপরের ভিডিওতে দেখতে পাবেন সোভিয়েত টি-৩৪ ট্যাংকগুলো কীভাবে পরাস্ত হচ্ছে একটি মাত্র টাইগারের হাতে।
মাইকেল উইটম্যান নামে একজন টাইগার ট্যাংক কমান্ডার ১৯৪৪ সালের জুন মাসে এক যুদ্ধে তিনি মাত্র ১৫ মিনিটে মিত্রবাহিনীর ১৪টি ট্যাংক ধ্বংস করেন। কার্ট নিস্পেল নামে আরেকজন টাইগার ট্যাংক কমান্ডার তিন কিলোমিটার দূর থেকে একটি সোভিয়েত টি-৩৪ ট্যাংক ধ্বংস করেন যা তখনকার দিনে রেকর্ড! এছাড়া তিনি 'ব্যাটল অফ কুরস্ক'-এ একদিনে ২৭টি টি-৩৪ ট্যাংক ধ্বংস করেন তার টাইগার ট্যাংক দিয়ে।
অটো ক্যারিয়াস নামের আরেকজন তো উড়ন্ত যুদ্ধবিমান ফেলে দিয়েছিলেন টাইগার ট্যাংক দিয়ে! যুদ্ধের শেষদিকে সার্ভিসে আসায় ও অতিরিক্ত তেলখোর হওয়ার ফলে জার্মানরা এই ট্যাংকগুলোকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারেনি। তাছাড়া অতিরিক্ত ওজনের কারণে এই ট্যাংক দিয়ে ইউরোপ, আফ্রিকার কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধা করা সম্ভব ছিলো না। সব মিলিয়ে টাইগার ট্যাংক ছিলো এমন এক কিংবদন্তি যার জন্ম আর কখনও হবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তোলা ছবিতে দেখুন টাইগার ট্যাংকের দুর্লভ কিছু মুহূর্ত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা হামলার ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে আজই সংগ্রহ করুন রোর বাংলার এই বইটি:
১) সাচিকো : নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য কাহিনী
This is bengali article discussing about the Tiger Tanks of WWII.
Reference:
2. Panzerkampfwagen VI Tiger Ausf.E (Sd.Kfz.181) Tiger I
3. The Tiger I & Tiger II Tank in 42 Top Images
4. Nazi Germany's King Tiger Tank : Super Weapon or Super Myth?
5. Panzerkampfwagen Tiger Ausf.B (Sd.Kfz.182) Tiger II
Feature Image: Sia Magazin