Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঐতিহ্যবাহী পিসার হেলানো টাওয়ার এবং গ্যালিলিওর যত পরীক্ষা

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী—
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেলো অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।”                       

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সত্যিই তো, বিপুল এই পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি খুবই স্বল্প। এই পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতই না অবাক করা বিষয়। কোথাও প্রকৃতির তৈরি করা বিস্ময়কর নানা উপাদান, আবার কোথাও মানুষের তৈরি অদ্ভুত সব বিষয়বস্তু। মানুষের তৈরি সব সৌন্দর্যই যে নিঁখুত তা কিন্তু নয়। প্রকৃতির এই রাজ্যে বিরাজ করছে নানা অসম্পূর্ণতা। অথচ সেই অসম্পূর্ণ প্রকৃতির মাঝেই ফুটে ওঠে তার উৎকর্ষতা ও অপার্থিব সৌন্দর্য।

পিসার টাওয়ার মানুষের তৈরি তেমনই এক আশ্চর্য অসম্পূর্ণতা। মূলত ভুল নির্মাণ কৌশলে তৈরি এই পিসার টাওয়ার, যা নির্মিত হয় আজ থেকে প্রায় কয়েক শতাব্দী আগে। পৃথিবীর আশ্চর্য স্থাপত্যের মধ্যে অনন্য এক স্থাপত্য হচ্ছে পিসার টাওয়ার। মানুষের ভুল থেকেই তৈরি এই হেলানো টাওয়ারটি যেন পিসার এই বেল-টাওয়ারকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। চলুন তাহলে ইতিহাসের খেরোখাতা খুলে অনুসন্ধান করে নেই পিসার টাওয়ারের নির্মাণ কৌশল এবং এর তৈরির ইতিহাস। জেনে নিই কীভাবে টাওয়ারটি হেলে পড়লো, কেনই বা টাওয়ারটি ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে এতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে অজানা সব কাহিনী।

পিসার হেলানো টাওয়ার। ছবিসূত্র: Wikimedia commons

পিসা ইতালির প্রাচীন এক গৌরবময় প্রসিদ্ধ নগরী। ঐশ্বর্যের দিক দিয়ে শহরটি ছিল খুবই সমৃদ্ধশালী। এটা সেই শহর যেখানে ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম নিয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই। সেই পিসা নগরীর ঐশ্বর্যময় জাঁকজমক ও উৎকর্ষতা পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য নির্মাণ করা হয় সূক্ষ্ম কারুকার্যে পূর্ণ অপূর্ব এক স্থাপনা। পিসা শহরের ক্যাথিড্রাল স্কয়ারের তৃতীয় প্রাচীনতম স্থাপনার একটি পিসার হেলানো টাওয়ার। এটি অবশ্যই পৃথিবীর অদ্ভুত দালানগুলোর একটি। আমাদের অনেকের কাছে যা ‘লিনিং টাওয়ার অব পিসা’ নামে পরিচিত। স্থাপত্যটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সার্চিও ও আর্নো নামের দুই নদী।

ক্যাথিড্রাল স্কয়ার ও পিসার হেলানো টাওয়ার। ছবিসূত্র: encircleworldphotos.photoshelter.com

মূলত রোমান ক্যাথলিকদের ঘণ্টা স্থাপনের উদ্দেশ্যেই এই টাওয়ারটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। সে লক্ষ্যেই ১৪ আগস্ট ১১৭৩ সালে এই টাওয়ার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। অভিজ্ঞ স্থাপত্যকর্মী এবং শত শত শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গড়ে উঠে আকাশচুম্বী এই টাওয়ার। শ্বেত মার্বেল পাথরের টাওয়ারটি একাদশ-দ্বাদশ শতকে ইউরোপে বহুল প্রচলিত রোম্যানিকিউ স্থাপত্য ও শিল্পকলা রীতিতে নির্মাণ করা হয়। মধ্যযুগীয় এই স্থাপত্যশৈলী নির্মাণের প্রকৃত কারিগর কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে গাগলিমো এবং বোনানো পিসানোকে এর নকশাকার হিসেবে ধারণা করা হয়। এই দুজন ছিলেন সেই সময়কার ইতালির পিসা নগরীর অধিবাসী ও নামজাদা শিল্পী। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যায়, দিওতিসালভি নামের একজন ব্যক্তি এই টাওয়ার নির্মাণের প্রকৃত স্থাপত্যবিদ। এছাড়াও স্যান নিকোলা নামের আরও একজন স্থাপত্যশিল্পী মিনারের ঘণ্টা স্থাপনের মূল কাজটি করেন। তবে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে জিওভান্যি পিসানো এবং জিওভান্যি ডি সিমোনের মতো আরো কয়েকজন স্থাপত্যশিল্পী এর নির্মাণ কাজে নিজেদের যুক্ত করেন। পরিকল্পনায় থাকা আটতলা বিশিষ্ট গোলাকার এই টাওয়ারের তৃতীয় তলার কাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ বছর।

প্রথম থেকেই কিন্তু এই টাওয়ারটিকে হেলানোভাবে তৈরি করা হয়নি। তিন তলা পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর থেকেই টাওয়ারটিকে ঘিরে ঘটে অদ্ভুত এক ঘটনা। হঠাৎই হেলতে শুরু করে টাওয়ারটি। বিশেষজ্ঞরা দেখতে পান, টাওয়ারটির নির্মাণ কৌশলে ভুল ছিল। টাওয়ারের নীচের নরম মাটি ও অগভীর ভিত এই অস্বাভাবিক হেলে পড়ার জন্যে দায়ী বলে ধারণা করা হয়। অদ্ভুত উপায়ে সেই হেলানো অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে রইল টাওয়ারটি, ভেঙেও পড়লো না। স্থপতিরাও হাল ছেড়ে না দিয়ে হেলে যাওয়ার মধ্যেই গড়তে থাকেন একের পর এক তলা।

টাওয়ারের ভিতরের দৃশ্য। ছবিসূত্র: Askideas.com

এই সময় পিসার রাজ্যের সাথে পাশ্ববর্তী স্থানীয় রাজ্যগুলো, যেমন: জেনোয়া, লুক্কা, এবং ফ্লোরেন্স এর সাথে নানা ছোটখাটো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে এক শতাব্দী সময় জুড়ে এই টাওয়ারের নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। যুদ্ধ শেষে শান্তি এলে আবার শুরু হলো টাওয়ার তৈরির কাজ। বহুদিন কাজ বন্ধ থাকার ফলে টাওয়ারটি মাটিতে ভালোভাবে গেঁথে যায়। তাই উপরের ফ্লোরগুলোও তৈরি হয়ে যায় ধীরে ধীরে এবং ১৩৭২ সালে সম্পন্ন হয় এই অনন্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ।

টাওয়ারের ভিতরের প্যাঁচানো সিঁড়ি। ছবিসূত্র: Capt Mondo’s Blog

নির্মাণ কাজ শেষ হলেও টাওয়ারের হেলে পড়া বন্ধ করতে পারেননি প্রকৌশলীরা। তার মধ্যে শত শত পর্যটকদের নিয়মিত স্থাপত্যটি পরিদর্শন, পরিবেশ দূষণ আর আবহাওয়ার তারতম্য টাওয়ারটিকে আরও হেলিয়ে দিতে শুরু করে। ১৯৯০ সালের দিকে এই টাওয়ার ১৫ ফুট পর্যন্ত হেলে পড়ে। শত চেষ্টার পরেও প্রতি বছর ১.২ মিলিমিটার করে হেলতে থাকে স্থাপনাটি। ফলে কিছু সময়ের জন্য টাওয়ারটি পরিদর্শন বন্ধ রাখা হয়।

টাওয়ারের মূল প্রবেশপথ। ছবিসূত্র: wikimedia commons

বিজ্ঞানীদের নানা চিন্তা-ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণার মধ্যে চেষ্টা চলতে লাগলো কীভাবে আশ্চর্য এই স্থাপত্যকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, ফিরিয়ে দেওয়া যায় তার প্রারম্ভিক অবস্থান। অবশেষে ১৯৯৮ সালে এসে একটি উপায় খুঁজে পেলেন প্রকৌশলীরা। ২০০১ সালে প্রকৌশলীরা এক বিশেষ কাঠামোর মধ্য দিয়ে এই স্থাপনার নিচের আলগা মাটি সরিয়ে নেন। পাশাপাশি বিশাল পরিমাণ ওজনদার বস্তু হেলে পড়ার উল্টো দিকে চাপিয়ে দেয়া হয়। এতে রক্ষা পায় টাওয়ারটি।

স্থাপনাটি রক্ষার লক্ষ্যে ওজনদার বস্তু টাওয়ারের উল্টোদিকে চাপানো হয়। ছবিসূত্র: wikimedia commons

বর্তমানে টাওয়ারটির হেলে পড়া বন্ধ হয়েছে এবং ৪০ সেন্টিমিটারেরও বেশি হেলানো অবস্থা থেকে সোজা অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে কয়েকশ বছর ধরে হেলে পড়তে পড়তে এখনো প্রায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৩.৯৯ ডিগ্রি কোণে হেলে আছে টাওয়ারটি। আর এটাই নাকি হেলানো টাওয়ারের স্বাভাবিক অবস্থা। ২০০৮ সালে ইঞ্জিনিয়াররা সর্বশেষ পরীক্ষা করে ঘোষণা দেন যে, ২০০ বছরের জন্য স্থাপত্যটি স্থিতিশীল রয়েছে এবং এখন থেকে  টাওয়ারটি পর্যটকদের জন্য নিরাপদ। ফলে পর্যটকদের আনাগোনা পুনরায় বাড়তে থাকে এখানে।

এবার ফিরে আসা যাক ইতিহাসের একটি বিশেষ মুহূর্তের দিকে। ধারণা করা হয়, বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের জন্য টাওয়ারটি ব্যবহার করেছিলেন। টাওয়ারের মাঝের ছাদ থেকে ঝুলে থাকা এক ঝাড়বাতি দেখে গ্যালিলিও তার বিখ্যাত দোলন সূত্রগুলোর কথা প্রথম চিন্তা করেন বলেও জানা যায় ।

বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি। ছবিসূত্র: Emaze

বলা হয়ে থাকে, গ্যালিলিও তার এক বিখ্যাত সূত্র ‘বায়ুশূন্য পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন ভরের পড়ন্ত বস্তুর গতিবেগ সমান‘ প্রমাণের জন্য এই টাওয়ারটি বেছে নিয়েছিলেন। গিনি ও পালকের পরীক্ষার একটি অংশ তিনি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভরের কামানের গোলার সাহায্যে হাতে কলমে পরীক্ষা করেছিলেন পিসার টাওয়ার থেকেই। কিন্তু এর কোনো বিশ্বস্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মূলত এই কাহিনীটি সূচনা করেছিলেন গ্যালিলিওর এক ছাত্র ও তার সহকারী ভিনসেনজিও ভিভিয়ানি। এই ভিভিয়ানী তার গুরু গ্যালিলিওর আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তিনি গ্যালিলিওর শেষ জীবনে গুরুর সাথে থাকতেন এবং তাকে পড়ে শোনাতেন।

ভিনসেনজিও ভিভিয়ানি। ছবিসূত্র: wikimedia commons

অনুমান করা হয়, ১৬৫৪ সালে ভিভিয়ানী গ্যালিলিওর জীবনী লেখার সময় বেশ কিছু কাল্পনিক কাহিনীর আশ্রয় নেন। গ্যালিলিওর জীবনীতে তিনি পিসার হেলানো টাওয়ারে পরীক্ষাটির কথা উল্লেখ করেন। গ্যালিলিও নিজে কখনোই এমন পরীক্ষা করেছেন বলে তার কোনো তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি।

কথিত গ্যালিলিও গ্যালিলির পরীক্ষাসমূহের স্মৃতির ফলক। ছবিসূত্র: wikimedia commons

প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি পিসার টাওয়ারের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখার আশায় ছুটে আসেন। সবুজ গালিচার মতো মখমল ঘাসের প্রাঙ্গণ এই টাওয়ার স্কয়ারকে পরিচিত করেছে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্কয়ারে। পর্যটকেরা টাওয়ার প্রাঙ্গণে স্থাপিত চার-চারটি অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী উপভোগ করেন।

টাওয়ার দেখতে আসা পর্যটকদের ভিড়। ছবিসূত্রঃ Gray Line Tours

সুক্ষ্ম কারুকার্যময় টাওয়ারের সারি সারি কলাম আর একের পর এক খিলান উঠে গেছে চক্রাকারে। ২৯৪টি সিঁড়ি রয়েছে টাওয়ারটিতে। দর্শকরা সেই খিলানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে ভাবতেই পারেন- “এই সেই স্থাপত্য, যেটা একদা বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর চরণস্পর্শ পেয়েছিল!” অথচ ব্যাপারটা সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে ইতিহাসেই।

টাওয়ারে স্থাপিত সবচেয়ে বড় আসসুন্তা বেল। ছবিসূত্র: Around the World

তবে সুসজ্জিত বিশাল গুপ্ত তোরণ-শোভিত পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে গর্বিত মনে হবে এই ভেবে, এ অনন্য স্থাপনা তো মানুষেরই সৃষ্টি। হয়তো কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে পর্যটকরা শুনতে পান টাওয়ারটির শীর্ষে অবস্থিত সাতটি ঘণ্টাধ্বনি থেকে নিঃসৃত সুর-ঝংকার। ১৮৩ ফুট উচ্চতার নয়নাভিরাম পিসার টাওয়ারটি হেলানো অবস্থার কারণেই আজও বিশ্বের এক অনন্য বিস্ময়!

ফিচার ইমেজ: TravelDigg.com

Related Articles