বিগত প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে তুর্কি–আর্মেনীয় জাতিগত দ্বন্দ্ব ককেশাস অঞ্চলের রাজনীতির একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ, বিদ্রোহ, গণহত্যা– এই বিষয়গুলোর মধ্য দিয়েই তুর্কি–আর্মেনীয় সম্পর্ক পরিচালিত হয়েছে। তুর্কি জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ধারণানুসারে, আর্মেনীয়রা তুর্কি জাতির চিরন্তন শত্রু এবং তারা বিভিন্ন বহিঃশক্তির প্রক্সি হিসেবে তুর্কি জাতির ক্ষতিসাধনে ব্যস্ত। অন্যদিকে, আর্মেনীয় জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ধারণানুসারে, তুর্কিরা আর্মেনীয় জাতির চিরন্তন শত্রু এবং তুর্কিরা তাদের সংখ্যাধিক্যের জোরে ক্ষুদ্র আর্মেনীয় জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ইচ্ছুক। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব ছাড়া অন্য কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। কিন্তু তুর্কি ও আর্মেনীয় ইতিহাসের একটি বিশেষ মুহূর্তে তুর্কি ও আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। এই মুহূর্তটি ছিল ১৯২১ সালে আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা পরিচালিত 'ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ'।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ঐতিহাসিক আর্মেনীয় ভূখণ্ড রুশ ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে বিভক্ত ছিল। রুশ রাষ্ট্রের অধীনে ছিল রুশ বা পূর্ব আর্মেনিয়া, এবং ওসমানীয় রাষ্ট্রের অধীনে ছিল ওসমানীয়/তুর্কি বা পশ্চিম আর্মেনিয়া। রুশ ও আর্মেনীয় উভয় জাতিই ধর্মগতভাবে খ্রিস্টান, এজন্য রুশ আর্মেনিয়ায় জাতিগত আর্মেনীয়রা তুলনামূলক ভালো অবস্থায় ছিল। কিন্তু ওসমানীয়রা ধর্মগতভাবে ছিল মুসলিম, এজন্য ওসমানীয় আর্মেনিয়ায় খ্রিস্টান আর্মেনীয়রা নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হতো। এমতাবস্থায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্যান্য জাতির মতো আর্মেনীয়দের মধ্যেও জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে এবং সৃষ্টি হয় আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদী সংগঠন 'আর্মেনীয় বিপ্লবী ফেডারেশন' বা 'দাশনাক্তসুতিয়ুন' (সংক্ষেপে 'দাশনাক')।
আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদ দমনের উদ্দেশ্যে ওসমানীয় সরকার ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৬ সালের মধ্যে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ৫০,০০০ জাতিগত আর্মেনীয়কে হত্যা করে। ১৯০৯ সালের আদানা গণহত্যায় প্রায় ৩০,০০০ জাতিগত আর্মেনীয় নিহত হয়। ওসমানীয় সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের পর ওসমানীয় আর্মেনীয়দের একাংশ রুশদের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত হয়। ১৯১৫ সালে সারিকামিশের যুদ্ধে রুশদের নিকট ওসমানীয়রা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ওসমানীয় সরকার এই পরাজয়ের জন্য আর্মেনীয়দের 'বিশ্বাসঘাতকতা'কে দায়ী করে এবং আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত গণহত্যা আরম্ভ করে। ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে পরিচালিত আর্মেনীয় গণহত্যায় ৮ থেকে ১৫ লক্ষ জাতিগত আর্মেনীয় প্রাণ হারায়। আর্মেনীয় ইতিহাসে এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা।
১৯১৭ সালের রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে রুশ সৈন্যরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড থেকে পশ্চাৎপসরণ করে এবং স্বল্পসংখ্যক ও স্বল্প অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী আর্মেনীয় 'স্বেচ্ছাসেবক' ইউনিটগুলোর ওপর ওসমানীয়দের পূর্ণ শক্তি নিপতিত হয়। এমতাবস্থায় আর্মেনীয় সৈন্য ও জনসাধারণ ওসমানীয় ভূখণ্ড থেকে ক্রমশ পিছু হটতে থাকে এবং এ সময় তারা পথিমধ্যে অবস্থিত তুর্কি গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেয়। এদিকে ১৯১৮ সালের ২৮ মে রুশ/পূর্ব আর্মেনিয়ায় 'আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র' নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং দাশনাকরা রাষ্ট্রটির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ওসমানীয় সৈন্যরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের ট্রান্সককেশাস অঞ্চল আক্রমণ করে এবং অঞ্চলটির অধিকাংশ ভূমি দখল করে নেয়, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর তারা সৈন্য প্রত্যাহার করে ১৯১৪ সালের পূর্ববর্তী সীমারেখায় ফিরে যায়।
এসময় মিত্রশক্তি ওসমানীয় আর্মেনিয়ার বৃহৎ একটি অংশ আর্মেনীয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করে, কিন্তু এটি কখনো বাস্তবায়িত হয় নি। এসময় আর্মেনিয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আজারবাইজানের সঙ্গে এক প্রলম্বিত যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং জর্জিয়ার সঙ্গেও তাদের সংঘর্ষ দেখা দেয়। ১৯২০ সালের শুরুতে আর্মেনিয়ার আয়তন ছিল প্রায় ৬০,০০০ বর্গ কি.মি.।
এদিকে ১৯২০ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত রাশিয়া আজারবাইজানি বলশেভিকদের সহায়তায় আজারবাইজান আক্রমণ করে এবং রাষ্ট্রটির জাতীয়তাবাদী মুসাভাৎ দলীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে আজারবাইজানকে একটি আইনত স্বাধীন কিন্তু কার্যত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি সোভিয়েত রাষ্ট্রে পরিণত করে। এর ফলে আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার যুদ্ধ বন্ধ হয়, কিন্তু অন্যদিকে তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত 'গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সরকার' বা 'আঙ্কারা সরকারে'র সঙ্গে আর্মেনিয়ার সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৯২০ সালের জুন থেকেই তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার মধ্যে বিক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষ চলছিল, এবং সেপ্টেম্বরে এটি পূর্ণ যুদ্ধের রূপ ধারণ করে। তুর্কি–আর্মেনীয় যুদ্ধে জেনারেল কাজিক কারাবেকিরের নেতৃত্বাধীন তুর্কি বাহিনীর নিকট প্রায় তিনগুণ ক্ষুদ্র আর্মেনীয় বাহিনী পর্যুদস্ত হয়। এই যুদ্ধের সময় তুর্কি সৈন্যরা ৬০,০০০=২,৫০,০০০ বেসামরিক আর্মেনীয়কে হত্যা করে।
আর্মেনিয়ার এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে সোভিয়েত রাশিয়া আর্মেনিয়াকে একটি বলশেভিক রাষ্ট্রে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তুর্কি–আর্মেনীয় যুদ্ধ চলাকালেই ১৯২০ সালের নভেম্বরে আর্মেনিয়ার অভ্যন্তরে আর্মেনীয় বলশেভিকরা দাশনাক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ২৯ নভেম্বর সোভিয়েত রুশ ও সোভিয়েত আজারবাইজানি সৈন্যরা আর্মেনিয়া আক্রমণ করে। ২ ডিসেম্বর ইয়েরেভান বলশেভিকদের হস্তগত হয় এবং দাশনাকরা আর্মেনীয় বলশেভিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। একই দিনে আর্মেনিয়ায় আইনত স্বাধীন কিন্তু কার্যত সোভিয়েত রুশ–নিয়ন্ত্রিত 'আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩ ডিসেম্বর দাশনাকরা তুরস্কের সঙ্গে আলেক্সান্দ্রোপোল চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এর মধ্য দিয়ে কার্স ও সুরমালি অঞ্চল (আর্মেনিয়ার অর্ধেকের বেশি ভূখণ্ড) তুর্কিদের কাছে হস্তান্তর করে। দাশনাকরা আগের দিনই পদত্যাগ করায় এই চুক্তি করার বৈধ ক্ষমতা তাদের ছিল না, ফলে চুক্তিটি অকার্যকর হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু চুক্তির মাধ্যমে সমর্পিত অঞ্চল ইতোমধ্যেই তুর্কিরা দখল করে নিয়েছিল। এভাবে তুর্কি–আর্মেনীয় যুদ্ধের ফলে আর্মেনিয়ার অর্ধেকের বেশি ভূখণ্ড তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আর্মেনিয়ার অবশিষ্টাংশে একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
অর্থাৎ, ১৯২০ সাল নাগাদ তুর্কিরা আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে অন্তত ৪টি বৃহৎ মাত্রার গণহত্যা চালায় এবং ১৯১৮ সালে আর্মেনীয়রা তুর্কিদের বিরুদ্ধে একটি গণহত্যা চালায়। তদুপরি, ১৯২০ সালের তুর্কি আক্রমণের ফলে আর্মেনিয়া তাদের অর্ধেকের বেশি ভূখণ্ড হারায় এবং তাদের রাষ্ট্র বলশেভিকদের কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই আর্মেনীয় ও তুর্কিদের মধ্যবর্তী হিংসাত্মক মনোভাব সেসময় প্রবল ছিল। এছাড়া দাশনাকরা ছিল ঐতিহাসিকভাবেই তীব্র তুর্কিবিরোধী এবং ১৯২০ সালে তুর্কিদের কারণেই তারা বলশেভিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। সুতরাং দাশনাকদের মধ্যে এসময় তুর্কিদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এমন একটি ঘটনা ঘটে, যেটি এই স্বাভাবিক সমীকরণকে উল্টে দেয়।
১৯২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জর্জীয় বলশেভিকরা জর্জীয় মেনশেভিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং সোভিয়েত রুশ, সোভিয়েত আজারবাইজানি ও সোভিয়েত আর্মেনীয় সৈন্যরা জর্জিয়া আক্রমণ করে। কিন্তু জর্জিয়া নিয়ে বলশেভিকদের ব্যস্ততার সুযোগে একই সময়ে সিমন ভ্রাৎসিয়ানের নেতৃত্বে দাশনাকরা আর্মেনিয়ায় বলশেভিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এটি ইতিহাসে 'ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। ১৮ ফেব্রুয়ারি দাশনাকরা আর্মেনীয় বলশেভিকদের কাছ থেকে রাজধানী ইয়েরেভান দখল করে নেয়। এর ফলে আর্মেনীয় বলশেভিকরা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, কিন্তু মস্কো সিদ্ধান্ত নেয় যে, জর্জিয়ার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তারা আর্মেনিয়ার দিকে মনোনিবেশ করবে।
এদিকে জর্জীয় মেনশেভিকদের বিপর্যয়ের সুযোগে ২৩ ফেব্রুয়ারি তুর্কিরা জর্জিয়া আক্রমণ করে এবং বিনা বাধায় আর্তভিন ও আরদাহান অঞ্চল দখল করে বাতুমি শহরের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়। জর্জীয় মেনশেভিকদের সঙ্গে একটি মৌখিক সমঝোতা অনুযায়ী তুর্কি সৈন্যরা বাতুমিতে প্রবেশ করে, কিন্তু শহরটির বেসামরিক কর্তৃত্ব জর্জীয় মেনশেভিকদের হাতে ন্যস্ত থাকে। তুর্কিরা চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল বাতুমি অঞ্চল দখল করে নিয়ে তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত বন্দরনগরী বাতুমির ভূকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম, এবং এজন্য বলশেভিকরা বাতুমি তুর্কিদের হাতে সমর্পণ করতে ইচ্ছুক ছিল না। ফলে বলশেভিক সৈন্যরা তুর্কি–অধিকৃত বাতুমির দিকে অগ্রসর হয় এবং তুর্কি–বলশেভিক যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
এই পরিস্থিতিতে তুর্কিরা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেটিকে ক্লাসিক রিয়েলপলিটিক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তারা আর্মেনিয়ায় বিদ্রোহী দাশনাকদের সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে! সোভিয়েত রুশ গোয়েন্দা সংস্থা 'চেকা'র সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এসময় তুর্কিরা দাশনাকদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র সরবরাহ করে এবং গোয়েন্দা সংক্রান্ত সহায়তাও প্রদান করে। এই সহায়তায় বলীয়ান হয়ে দাশনাকরা ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চের মধ্যে আর্মেনীয় বলশভিকদের ইয়েরেভান পুনর্দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। অর্থাৎ, আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা তুর্কিদের সহায়তায় বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল!
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, তুর্কিরা কেন দাশনাকদের সহায়তা করতে আগ্রহী হলো? আর দাশনাকরাই কেন বা তুর্কি সহায়তা গ্রহণ করতে রাজি হলো? বস্তুত এক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই স্বার্থ জড়িত ছিল।
দাশনাকদের সহায়তা করার পশ্চাতে তুর্কিদের উদ্দেশ্য ছিল আর্মেনিয়ায় চলমান বলশেভিকবিরোধী বিদ্রোহকে আরো তীব্র করে তোলা। এর ফলে বলশেভিকরা বাধ্য হয়ে জর্জিয়া থেকে আর্মেনিয়ার দিকে মনোনিবেশ করত এবং জর্জিয়া থেকে আর্মেনিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তুর্কিরা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাতুমি বন্দরকে স্থায়ীভাবে তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারত। বাতুমিতে তুর্কিদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সরাসরি যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনোভাবে সেটির নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব হবে না। এবং সেসময় যেহেতু সোভিয়েত রাশিয়া তুরস্কের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক ছিল, সেহেতু তারা তুর্কিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করত না। এই হিসাব থেকে তুর্কিরা দাশনাকদের সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়।
অবশ্য দাশনাকদের সহায়তা প্রদানের পশ্চাতে তুর্কিদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, এবং এই উদ্দেশ্যটি ছিল আক্ষরিক অর্থেই ভয়াবহ। তুর্কিদের হিসেব অনুযায়ী, দাশনাকরা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হারুক অথবা জিতুক, উভয় ক্ষেত্রেই তুরস্ক লাভবান হত। যদি দাশনাকরা বলশেভিকদের পরাজিত করতে সক্ষম হত (যদিও সেই সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে), সেক্ষেত্রে আর্মেনিয়ায় পুনরায় দাশনাকরা ক্ষমতা লাভ করত। এক্ষেত্রে তাদের একদিকে থাকত শত্রুভাবাপন্ন বলশেভিকরা, অন্যদিকে থাকত তুরস্ক। বলশেভিকদের বিরুদ্ধে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দাশনাকরা বাধ্য হয়ে তুর্কিদের আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হত এবং সেক্ষেত্রে দাশনাক–নিয়ন্ত্রিত আর্মেনিয়া একটি তুর্কি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হত।
অবশ্য দাশনাকদের তুর্কিদের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে না চাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। বরং তারা ক্ষমতায় ফিরে এলে তুরস্কের কাছে ১৯২০ সালে হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে পারত। অবশ্য এক্ষেত্রেও তুরস্ক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল, কারণ দাশনাক–নিয়ন্ত্রিত আর্মেনিয়া যদি তুরস্কের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করত, সেক্ষেত্রে দুর্বল আর্মেনিয়াকে সহজেই তুর্কিরা দখল করে নিতে পারত।
অন্যদিকে, তুর্কিদের হিসেব ছিল, যদি বলশেভিকরা দাশনাকদের পরাজিত করতে সক্ষম হত, সেক্ষেত্রে এই বিস্তৃত বিদ্রোহের শাস্তিস্বরূপ বলশেভিকরা দাশনাকদের ধ্বংস করে দিত। এর ফলে আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদ দারুণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ত এবং তুরস্কের প্রতি আর্মেনীয় হুমকি দূরীভূত হতো, কারণ আর্মেনীয় ও রুশ বলশেভিকরা তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল। শেষ পর্যন্ত তুর্কিদের এই হিসেবই বাস্তবে রূপ নিয়েছিল।
বিপরীত দিকে, দাশনাকরা তুর্কি সহায়তা গ্রহণ করেছিল, কারণ তাদের কাছে বিকল্প কোনো উপায় ছিল না। বহির্বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র তাদেরকে সহায়তা প্রদান করতে সম্মত হয়নি, এবং বাইরের সহায়তা ব্যতীত বলশেভিকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন টিকে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য তারা তুর্কি সহায়তা গ্রহণ করে এবং সেটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ্য, আর্মেনিয়ায় দাশনাকদের বিদ্রোহ শুরু পশ্চাতে তুর্কিদের কোনো ভূমিকা ছিল না। তুর্কিরা কেবল আর্মেনিয়ায় বিরাজমান পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছিল। বস্তুত এসময় যে অকস্মাৎ তুর্কি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ববোধ সৃষ্টি হয়েছিল এমনটা নয়, বরং প্রয়োজনের তাগিদে বাস্তববাদীর মতো তারা এই সহযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। কার্যত ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ চলাকালে তুর্কি–দাশনাক সহযোগিতা রিয়েলপলিটিকের এক অসাধারণ নজির।
কিন্তু দাশনাকদের সহায়তা করার পশ্চাতে তুর্কিদের যে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল (অর্থাৎ বাতুমি দখল করা), সেটি পূর্ণ হয় নি। বলশেভিকরা তুর্কিদের পরিকল্পনা ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছিল এবং তুর্কিদের চাতুর্য মোকাবিলা করার জন্য তারাও চাতুর্যের আশ্রয় নেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথমে তারা জর্জিয়াকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনবে, এবং কেবল এরপরেই আর্মেনিয়ার প্রতি মনোনিবেশ করবে। এসময় তারা তুর্কিদের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল, এবং ১৬ মার্চ স্বাক্ষরিত মস্কো চুক্তি অনুযায়ী তুর্কিরা বাতুমির ওপর তাদের দাবি ছেড়ে দিতে সম্মত হয়।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তুর্কি সৈন্যরা বাতুমি ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এমতাবস্থায় তুর্কিদের সঙ্গে যেন তাদের সরাসরি যুদ্ধ করতে না হয়, সেজন্য বলশেভিকরা জর্জীয় মেনশেভিকদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। সেই মোতাবেক ১৮ মার্চ জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যরা বাতুমি শহরে অবস্থানরত তুর্কি সৈন্যদের আক্রমণ করে এবং প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ১৯ মার্চ তুর্কি সৈন্যরা শহরটি থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে দাশনাকদের সহায়তা প্রদানের পশ্চাতে তুর্কিদের যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, সেটি ব্যর্থ হয়ে যায়।
বাতুমি অধিকারের পর বলশেভিকরা আর্মেনিয়ার দিকে মনোনিবেশ করে। ১৯২১ সালের ২৪ মার্চ নাগাদ বলশেভিকরা আর্মেনিয়ায় একটি বৃহৎ আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে এবং ২ এপ্রিলের মধ্যে ইয়েরেভানসহ আর্মেনিয়ার অধিকাংশ ভূখণ্ড থেকে দাশনাকদের বিতাড়িত করে। দাশনাকরা জাঙ্গেজুর অঞ্চলে পশ্চাৎপসরণ করে এবং ২৬ এপ্রিল সেখানে 'পার্বত্য আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র' নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। কিন্তু ১৩ জুলাই বলশেভিকরা জাঙ্গেজুর দখল করে নেয় এবং দাশনাক–নিয়ন্ত্রিত এই প্রোটো–আর্মেনীয় রাষ্ট্রটির বিলুপ্তি ঘটায়।
জাঙ্গেজুরে বলশেভিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দাশনাক নেতারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইরানে পালিয়ে যায় এবং এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত আর্মেনিয়ায় জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায়। আর্মেনীয় বলশেভিকরা তুর্কিদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে আগ্রহী ছিল এবং ১৯২০ সালে হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে তাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এর ফলে ১৯২১ সালের অক্টোবরে স্বাক্ষরিত কার্স চুক্তির মধ্যে দিয়ে তুরস্ক ও সোভিয়েত আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ ঘটে। এর ফলে দাশনাকদের সহায়তা করার পশ্চাতে তুর্কিদের যে দ্বিতীয় হিসেব ছিল, সেটি মিলে যায়। এবং এসবের মধ্য দিয়ে তুর্কি ও আর্মেনীয়দের ইতিহাসে পারস্পরিক সহযোগিতার সংক্ষিপ্ত অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটে।
This is a Bengali article about secret Turkish–Armenian cooperation during the anti-Bolshevik February Uprising in 1921.
Sources:
1. Arnold Kadishev. "Intervention and Civil War in the Transcaucasus." Moscow: Voennoe Izdatel'stvo, 1960. https://www.amazon.com/-/es/n/dp/B07143RXC4
2. Richard K. Debo. "Survival and Consolidation: The Foreign Policy of Soviet Russia, 1918-1921." Montreal and Kingston: McGill-Queen's University Press, 1992. https://www.amazon.com/Survival-Consolidation-Foreign-Policy-1918-1921/dp/0773508287
Source of the featured image: Wikimedia Commons