Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তুর্কি–জর্জীয় যুদ্ধ: তুরস্ক যখন জর্জিয়ায় আক্রমণ করেছিল

দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত রাষ্ট্র জর্জিয়ার সঙ্গে বর্তমানে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। তুরস্ক মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং জর্জিয়া ন্যাটোর সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ। বর্তমানে তুরস্ক ও জর্জিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান, সেটিকে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ (strategic partnership) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র দুইটির মধ্যেকার সম্পর্ক সবসময় এ রকম উষ্ণ ছিল না। এমনকি ১৯২১ সালে যখন তুরস্ক মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সেসময়ও তারা জর্জিয়ার ওপর আক্রমণ চালায় এবং এর ফলে সংঘটিত হয় তুর্কি–জর্জীয় যুদ্ধ।

অবশ্য অতীত থেকেই রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। সেলজুক ও ওসমানীয় তুর্কিদের সঙ্গে জর্জীয়দের বেশ কয়েকবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে জর্জিয়া ইরানি নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায় এবং অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অঞ্চলটি কার্যত ইরান ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিরাজ করে।

১৭৮৩ সাল থেকে ১৮১৩ সালের মধ্যে জর্জিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লবের ফলে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ১৯১৮ সালের মে মাসে জর্জিয়ায় ‘জর্জিয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয়তাবাদী ও সামাজিক গণতন্ত্রী ‘জর্জিয়া সামাজিক গণতন্ত্রী দল’ (‘জর্জীয় মেনশেভিক’ নামেই সমধিক পরিচিত) সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির শাসনভার গ্রহণ করে।

জর্জিয়ার স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯১৮ সালের জুনে ওসমানীয় সাম্রাজ্য জর্জিয়ার ওপর আক্রমণ চালায় এবং সেটিকে দখল করে নেয়ার প্র‍য়াস পায়। কিন্তু জর্জিয়া ওসমানীয়দের মিত্ররাষ্ট্র জার্মানির সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং একটি জার্মান আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা জর্জিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করে, কিন্তু পরবর্তীতে তারা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। একইসময় জর্জিয়া পার্শ্ববর্তী আর্মেনিয়া, রুশ শ্বেত ফৌজ, জর্জীয় বলশেভিক দল এবং জর্জিয়ার অভ্যন্তরে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

১৯২১ সাল নাগাদ রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ জাতিগত জর্জীয় বলশেভিক নেতা জোসেফ স্তালিন ও সের্গো ওর্দঝোনিকিদজে জর্জিয়াকে বলশেভিক শাসনাধীনে আনার পরিকল্পনা করেন। তাদের নির্দেশনায় ১৯২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আর্মেনীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও জর্জিয়ার মধ্যবর্তী লোরি ‘নিরপেক্ষ অঞ্চলে’ জর্জীয় বলশেভিকরা বিদ্রোহ করে। এরপর রুশ, আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রত্রয় থেকে বলশেভিক সৈন্যরা জর্জীয় বলশেভিকদের ‘সহায়তা করার উদ্দেশ্যে’ জর্জিয়ায় প্রবেশ করে এবং জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যদের পরাজিত করে দ্রুতগতিতে রাষ্ট্রটির ভূখণ্ড অধিকার করতে থাকে।

মানচিত্রে জর্জিয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সীমানা; Source: Wikimedia Commons

২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বলশেভিক সৈন্যরা জর্জিয়ার রাজধানী তিফলিস (বর্তমান তিবলিসি) দখল করে নেয় এবং ‘জর্জীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করে। অবশ্য তখনো পুরো জর্জিয়ার ওপর বলশেভিকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যরা বলশেভিকদের প্রতিরোধ করতে থাকে, কিন্তু একের পর এক যুদ্ধে বলশেভিকরা বিজয়ী হতে থাকে এবং জর্জীয় বলশেভিকরা ক্রমশ পশ্চাদপসরণ করতে থাকে।

এ সময় তুরস্কের আঙ্কারাকেন্দ্রিক ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সরকার’, যেটি ‘আঙ্কারা সরকার’ নামে অধিক পরিচিত, মিত্রশক্তির (প্রধানত গ্রিস, ব্রিটেন ও ফ্রান্স) বিরুদ্ধে তুরস্কের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯২০ সালের ১৩ নভেম্বর আঙ্কারা সরকার ও জর্জিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু জর্জিয়ায় বলশেভিক আক্রমণের প্রেক্ষাপটে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা ইতিপূর্বে হারানো তুর্কি ভূমি পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেখতে পায়।

উল্লেখ্য, ১৮৭৭–১৮৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে ওসমানীয়দের পরাজয়ের পর রুশরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আর্তভিন, আরদাহান, ওলতু ও বাতুমি অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। ১৯১৮ সালে কেন্দ্রীয় শক্তি ও রুশ বলশেভিকদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি অনুযায়ী বলশেভিকরা অঞ্চলগুলোকে ওসমানীয়দের কাছে প্রত্যর্পণ করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয়দের পরাজয়ের পর এই অঞ্চলগুলো জর্জিয়ার হস্তগত হয়। ১৯২১ সালে জর্জিয়ার ওপর বলশেভিক আক্রমণের সুযোগে আঙ্কারা সরকার এই অঞ্চলগুলো পুনর্দখল করার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আঙ্কারা সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের কমান্ডার জেনারেল কাজিম কারাবেকির জর্জীয় মেনশেভিক সরকারকে একটি চরমপত্র প্রেরণ করেন এবং আরদাহান, আর্তভিন ও ওলতু অঞ্চলগুলো তুর্কিদের হাতে সমর্পণ করার দাবি জানান। বলশেভিকদের হাতে বিপর্যস্ত হতে থাকা জর্জীয় মেনশেভিক সরকারের পক্ষে সম্ভাব্য তুর্কি আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না। ফলে নিরুপায় হয়ে তারা উল্লেখিত অঞ্চলগুলো থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। জেনারেল কারাবেকিরের নেতৃত্বে ২০,০০০ তুর্কি সৈন্য জর্জিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং উক্ত অঞ্চলগুলো হস্তগত করে।

মানচিত্রে তুর্কি–জর্জীয় যুদ্ধ; Source: Wikimedia Commons

এ পর্যায়ে জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যদের সঙ্গে তুর্কিদের কোনো সশস্ত্র সংঘাত হয়নি। তুর্কি সৈন্যরা কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী বাতুমির সন্নিকটে উপস্থিত হয়। এ সময় জর্জীয় মেনশেভিক সরকার বাতুমিতে অবস্থান করছিল এবং দিমিত্রি ঝলোবার নেতৃত্বাধীন বলশেভিক লাল ফৌজের ১৮তম অশ্বারোহী ডিভিশন বাতুমির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এমতাবস্থায় ৭ মার্চ জর্জীয় মেনশেভিক সরকার তুর্কিদের সঙ্গে একটি মৌখিক সমঝোতায় পৌঁছায়। সমঝোতা অনুযায়ী জর্জীয় মেনশেভিকরা বাতুমিতে তুর্কি সৈন্যদের প্রবেশের ব্যাপারে সম্মত হয়, কিন্তু শহরটির বেসামরিক প্রশাসন জর্জীয় মেনশেভিক সরকারের হাতে থাকবে বলে ন্যস্ত হয়।

এই সমঝোতার মধ্য দিয়ে জর্জীয় মেনশেভিক সরকার কার্যত তুর্কিদের ‘আশ্রিত সরকারে’ পরিণত হয়। বাতুমিতে তুর্কি সৈন্যদের প্রবেশের সুযোগ করে দেয়ার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল খুবই সরল। তারা চাচ্ছিল, বাতুমির অধিকার নিয়ে তুর্কিদের সঙ্গে বলশেভিকদের সংঘর্ষ শুরু হোক। এর ফলে তুর্কি–বলশেভিক দ্বন্দ্বের সুযোগে জর্জীয় মেনশেভিকরা পুনর্গঠিত হতে পারবে এবং জর্জিয়াকে স্বাধীন রাখার একটা সুযোগ পাবে।

৮ মার্চ কর্নেল কিজিম বের নেতৃত্বে তুর্কি সৈন্যরা বাতুমি শহরে প্রবেশ করে এবং সম্ভাব্য বলশেভিক আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। এই ঘটনায় বলশেভিকরা ক্ষিপ্ত হয়। রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিওর্গি চিচেরিন মস্কোয় নিযুক্ত আঙ্কারা সরকারের রাষ্ট্রদূত আলী ফুয়াদ চেবেসোয়কে একটি প্রতিবাদপত্র প্রদান করেন এবং বাতুমি থেকে তুর্কি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানান। এর জবাবে চেবেসোয় চিচেরিনকে দুইটি নোট প্রদান করেন। এর মাধ্যমে তিনি জানান যে, সোভিয়েত সামরিক অভিযানের ফলে বাতুমি অঞ্চলের স্থানীয় মুসলিমদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে এবং এজন্য তুর্কি সৈন্যরা তাদের নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে বাতুমিতে প্রবেশ করেছে।

এদিকে বলশেভিকদের জন্য আঞ্চলিক পরিস্থিতি ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। একে তো জর্জীয় মেনশেভিক সরকার আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল, তদুপরি জর্জিয়ায় বলশেভিক সামরিক অভিযান শুরুর পরপরই ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্মেনীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদী দল ‘আর্মেনীয় বিপ্লবী ফেডারেশন’ বা ‘দাশনাক’ বলশেভিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ইয়েরেভান দখল করে নেয়। দাগেস্তানে বিদ্রোহীরা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।

বলশেভিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘চেকা’ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, আর্মেনীয় দাশনাক ও দাগেস্তানি বিদ্রোহীদের তুর্কিরা সহায়তা করছিল। এটি ছিল ‘রিয়েলপলিটিকে’র একটি আদর্শ উদাহরণ, কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ওসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক পরিচালিত আর্মেনীয় গণহত্যার প্রেক্ষাপটে তুর্কি ও আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীদের মধ্যেকার সম্পর্ক ছিল খুবই খারাপ। কিন্তু এ সময় বলশেভিকদের চাপে রাখার উদ্দেশ্যে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীদের সহায়তা করে এবং আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্বার্থে এই সহায়তা গ্রহণ করে।

১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত জর্জীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পতাকা; Source: Wikimedia Commons

সামগ্রিকভাবে, ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ জর্জিয়ায় তুর্কি ও বলশেভিকদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছিল। বলশেভিকরা এই সংঘর্ষ এড়াতে চাচ্ছিল এবং এজন্য তারা একটি বহুমুখী নীতি গ্রহণ করে। তুর্কি প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য মস্কোয় আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সেখানে আঙ্কারা সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বলশেভিকরা বিস্তৃত আলোচনায় লিপ্ত হয়। ২ মার্চ রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির লেনিন ‘সোভিয়েত জর্জিয়া’কে উষ্ণ শুভেচ্ছা প্রেরণ করেন এবং যেকোনো মূল্যে জর্জীয় মেনশেভিকদের সঙ্গে একটি জোট সরকার গঠনের জন্য জর্জীয় বলশেভিক সরকারকে আহ্বান জানান। এর উদ্দেশ্য ছিল তুর্কি ও জর্জীয় মেনশেভিকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা।

জর্জীয় বলশেভিক সরকার মেনশেভিকদের সঙ্গে জোট গঠনে ইচ্ছুক ছিল না, কিন্তু লেনিনের পরামর্শ উপেক্ষা করার মতো পরিস্থিতিও তাদের ছিল না। এজন্য ৮ মার্চ তারা জর্জীয় মেনশেভিকদেরকে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু জর্জীয় মেনশেভিক সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বস্তুত এ সময় জর্জীয় মেনশেভিক সরকার আশা করছিল, তাদেরকে রক্ষা করার জন্য ফরাসি ও ব্রিটিশরা জর্জিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জর্জিয়ায় বলশেভিক আক্রমণের পর ফরাসি নৌবাহিনী কৃষ্ণসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষার জন্য জর্জীয় মেনশেভিকদের সহায়তা করেছিল এবং একপর্যায়ে বলশেভিক সৈন্যদের ওপর গোলাবর্ষণও করেছিল। সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, কারণ জর্জীয় মেনশেভিক সরকার তুর্কিদের সুরক্ষায় থেকে জর্জিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করার জন্য ফরাসিদের চাপ দিচ্ছিল, অথচ সেসময় তুরস্ক ও ফ্রান্স একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।

অবশ্য তুর্কি ও জর্জীয় মেনশেভিকদের মধ্যেকার মিত্রতা স্থায়ী হয়নি। শীঘ্রই উভয় পক্ষ একে অপরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। জর্জীয় মেনশেভিক সরকার ফ্রান্সের নিকট আবেদন জানায় যে, তারা যেন জর্জিয়াকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি প্রদান ও জর্জিয়ায় ভৌগোলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার জন্য তুর্কিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু ফ্রান্স এ সময় তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং তুর্কিদের ওপর চাপ প্রয়োগের মতো অবস্থানে ছিল না।

এদিকে বলশেভিকরা তাদের কূটনৈতিক অভিযান অব্যাহত রাখে। ১৯২১ সালের ১৬ মার্চ তারা ব্রিটেনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এ চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডে বলশেভিকবিরোধী সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা স্থগিত রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। এর ফলে জর্জিয়ায় ব্রিটিশ অভিযানের সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায়। ব্রিটিশদের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া ফরাসিরাও দক্ষিণ ককেশাসে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ছিল না। ফলে জর্জিয়ায় ফরাসি সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাও দূরীভূত হয়। একই দিনে রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও আঙ্কারা সরকারের মধ্যে ‘মস্কো চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে মস্কো ও আঙ্কারা দক্ষিণ ককেশাসের বলশেভিক প্রজাতন্ত্রগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সীমান্ত নির্ধারণ করে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে আরদাহান, আর্তভিন ও ওলতু তুরস্কের হস্তগত হয় এবং বাতুমি জর্জীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

মানচিত্রে বাতুমি শহর; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু চুক্তির পরেও তুর্কিরা বাতুমি ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক ছিল না। ১৭ মার্চ বাতুমিতে মোতায়েনকৃত তুর্কি সৈন্যদের কমান্ডার কর্নেল কিজিম বে নিজেকে বাতুমির সামরিক প্রশাসক ঘোষণা করেন। এর ফলে জর্জীয় মেনশেভিক সরকার আশঙ্কা করতে শুরু করে যে, কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাতুমি স্থায়ীভাবে জর্জিয়ার হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং তুর্কি শাসনাধীনে চলে যাবে। এদিকে ব্রিটিশ বা ফরাসিদের কাছ থেকে সহায়তা লাভের আর কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। এজন্য তারা বলশেভিকদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯২১ সালের ১৭ মার্চ কুতাইসিতে জর্জীয় বলশেভিক সরকারের প্রতিনিধি আভেল এনুকিদজে এবং জর্জীয় মেনশেভিক সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রিগোল লোর্দকিপানিদজে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। পরবর্তী দিন স্বাক্ষরিত আরেকটি চুক্তি অনুযায়ী জর্জীয় মেনশেভিকরা বাতুমিকে বলশেভিকদের কাছে হস্তান্তর করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী বলশেভিকরা জর্জীয় মেনশেভিকদের পূর্বের সকল কর্মকাণ্ড থেকে দায়মুক্তি প্রদান করতে এবং বাতুমির উত্তরে ৭০ মাইল পর্যন্ত রেলপথ মেনশেভিকদের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়। বিনিময়ে জর্জীয় মেনশেভিকরা বলশেভিক সৈন্যদের জন্য রেলগাড়ি সরবরাহ করতে এবং বাতুমিতে বন্দি সমস্ত বলশেভিককে মুক্তি দিতে সম্মত হয়।

চুক্তি অনুযায়ী বলশেভিক সৈন্যরা বাতুমির সন্নিকটে উপস্থিত হয়। এদিকে বলশেভিক সৈন্যদের বাধা দেয়ার জন্য বাতুমির উপকণ্ঠে প্রায় ১০,০০০ জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্য জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু জর্জীয় বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির সংবাদ পাওয়ার পর বাতুমিতে অবস্থানরত তুর্কি সৈন্যরা তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ১৮ মার্চ বাতুমিতে তুর্কি ও জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু এই যুদ্ধ ছিল অসম, কারণ জেনারেল গিওর্গি মাজনিয়াশভিলির নেতৃত্বাধীন ১০,০০০ জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যের বিপরীতে কর্নেল কিজিম বের নেতৃত্বাধীন বাতুমিতে অবস্থানরত তুর্কি বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ২,০০০।

স্বভাবতই যুদ্ধের ফলাফল তুর্কিদের অনুকূলে যায়নি। দুই দিনব্যাপী তীব্র যুদ্ধের পর ১৯ মার্চ বাতুমির অধিকাংশ অঞ্চল জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যদের হস্তগত হয় এবং তুর্কি সৈন্যরা বাতুমির অবশিষ্টাংশ থেকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ৩০ জন তুর্কি সৈন্য নিহত, ২৬ জন আহত ও ৪৬ জন নিখোঁজ হয়। জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে বাতুমিতে তুর্কি কর্তৃত্বের অবসান ঘটে।

তুর্কি সৈন্যদের পশ্চাদপসরণের পর বাতুমিতে বলশেভিক সামরিক কমান্ডারবৃন্দ; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধের সময় বলশেভিক সৈন্যরা বাতুমির উপকণ্ঠে থেকে যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু তারা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, কারণ তাদের অংশগ্রহণ এই যুদ্ধকে তুর্কি–বলশেভিক যুদ্ধে রূপ দিতে পারত। যুদ্ধ শেষে ১৯ মার্চেই জর্জীয় মেনশেভিকরা বাতুমিকে বলশেভিকদের কাছে হস্তান্তর করে। একই দিনে জর্জীয় মেনশেভিক সরকারের সদস্যরা একটি ইতালীয় জাহাজে চড়ে জর্জিয়া ত্যাগ করে। বাতুমির যুদ্ধে বিজয়ী জেনারেল মাজনিয়াশভিলি বলশেভিকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং লাল ফৌজে যোগদান করেন।

বাতুমি অধিকারের জন্য বলশেভিকরা চাতুর্যের সঙ্গে জর্জীয় মেনশেভিকদের ব্যবহার করে। এর মধ্য দিয়ে একদিকে বাতুমি তাদের হস্তগত হয়, অন্যদিকে তারা তুর্কিদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ এড়াতেও সক্ষম হয়। স্বভাবতই বলশেভিকদের কার্যকলাপে তুর্কিরা ক্ষিপ্ত হয় এবং সীমান্ত সংক্রান্ত আলোচনা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখে।

অবশ্য বাতুমি দখলের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও তুর্কি সৈন্যরা এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জর্জিয়ার কাছ থেকে আরদাহান, আর্তভিন ও ওলতু অঞ্চলত্রয় অধিকার করতে সক্ষম হয়। তুর্কিদের অধিকৃত ভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১২,০০০ বর্গ কি.মি.। মস্কো চুক্তিতে বলশেভিকরা এ অঞ্চল তুর্কিদেরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য রাজি হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে ১৯২১ সালের অক্টোবরে স্বাক্ষরিত কার্স চুক্তি অনুযায়ী অঞ্চলগুলো স্থায়ীভাবে তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত হয়।

তদুপরি, মস্কো চুক্তি অনুযায়ী বলশেভিকরা বাতুমি অঞ্চলের মুসলিমদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে এবং ‘আদজারীয় স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে। এর পাশাপাশি তুরস্ক বিনা শুল্কে বাতুমি বন্দর ব্যবহারের অধিকার লাভ করে। এজন্য সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুর্কি–জর্জীয় যুদ্ধে তুর্কিরা বিজয়ী হয় এবং এর মধ্য দিয়ে নিজেদের ভূখণ্ডের পরিমাণ বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।

Related Articles