দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাহাজ ভ্রমণের সুবাদে খ্যাতি অর্জন করেছিল বেশ কিছু বিড়াল। তবে এদের মাঝে বিশেষ স্থান দখল করে আছে ‘আনসিঙ্কেবল স্যাম’ নামক বিড়ালটি, যা একইসাথে ‘অস্কার’ নামেও পরিচিত। জার্মান ও ব্রিটিশ উভয় বাহিনীর জাহাজেই থাকা এ বিড়ালটির নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এর সাথে জাহাজডুবির কোনো কাহিনী বোধহয় জড়িত। আসলেই তা-ই। স্বাভাবিক মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনবার জাহাজডুবির স্বীকার হয়েছে স্যাম। আর অলৌকিকভাবে তিনবারই রক্ষা পেয়েছিলো তার জীবন!
স্যামের ‘মিলিটারি ক্যারিয়ার’ শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জার্মান ব্যাটলশিপ বিসমার্কের এক নাবিক তাকে নিয়েই জাহাজটিতে উঠে যান। ১৯৪১ সালের ১৮ মে, দখলকৃত পোলিশ শহর গোটেনহাফেনের বন্দর ছেড়ে যায় বিসমার্ক, উদ্দেশ্য অপারেশন রাইনুবাংয়ে অংশ নেয়া। বিসমার্কের কাজ ছিলো ব্রিটিশ এসকর্ট শিপগুলোকে নজরে রাখা। সেই সাথে হেভি ক্রুজার প্রিঞ্জ ইউজেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো মালামালবাহী জাহাজগুলোতে হামলা চালানোর।
১৯৪১ সালের ২৭ মে, ভয়াবহ এক নৌযুদ্ধে হার মানে বিসমার্ক, প্রতিপক্ষের আঘাতে ডুবতে শুরু করে সে। জাহাজটিতে থাকা ২,২০০ জন নাবিকের মাঝে ১৫০ জন জীবন নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। এই বেঁচে যাওয়াদের দলে মানুষের সাথে ছিলো আরেকটি প্রাণী, আজকের লেখায় শুরুতেই উল্লেখ করা বিড়াল স্যাম। বিসমার্ক ডুবে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার এইচএমএস কস্যাকের নাবিকরা স্যামকে জাহাজের ধ্বংসাবশেষে ভেসে থাকতে দেখেন। এমন অবুঝ একটি প্রাণীকে এমন পরিস্থিতিতে দেখে মায়া লাগে তাদের। তাই তাকে নিজেদের জাহাজে তুলে নেয় তারা। ব্রিটিশ সেনারা বিড়ালটির কোনো নাম না জানায় তার নতুন নাম হয় ‘অস্কার’।
জার্মান বিমানবাহিনী এবং সাবমেরিনগুলোর আক্রমণে ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক কাজে নিয়োজিত অনেকগুলো জাহাজই ডুবে গিয়েছিল। ফলে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাহাজগুলোকে একত্রে দলবেঁধে চলাফেরা করতে নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। এমন একেকটি দলে কিছু লাইট ক্রুজার, কিছু ডেস্ট্রয়ার এবং একটি করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থাকতো। পরবর্তী কয়েকটি মাস অস্কার (পূর্বের স্যাম) কস্যাকেই কাটায়। এ সময় উত্তর আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগর ঘোরা হয়ে যায় বিড়ালটির।
১৯৪১ সালের ২৪ অক্টোবর; কনভয় এসকর্ট এইচজি-৭৫ এর সাথে জিব্রাল্টার ছেড়ে লিভারপুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এইচএমএস কস্যাক। সেদিনই জার্মান সাবমেরিন ইউ-৫৬৩ থেকে ছুটে আসা এক টর্পেডোর আঘাতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাহাজটি। কস্যাকের ১৫৯ জন নাবিক মারা গিয়েছিল। যারা বেঁচে যায়, তারা গিয়ে ওঠে এইচএমএস লিজিয়নে।
আবহাওয়া হঠাৎ করেই বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফলে এইচএমএস কস্যাককে নিয়ে আবারো জিব্রাল্টারে ফিরে যাওয়া ছিলো অসম্ভব ব্যাপার। তাই, তিন দিন পর, অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর জিব্রাল্টারের পশ্চিমে ডুবে যায় এইচএমএস কস্যাক। সৌভাগ্যবশত এবারও বেঁচে যায় অস্কার (কিংবা স্যাম!)। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জিব্রাল্টারে। সেখানে এভাবে দু-দুবার জাহাজডুবির হাত থেকে ফেরত আসার ঘটনায় আশ্চর্য হয়ে অফিসাররা বিড়ালটির নামের আগে ‘আনসিঙ্কেবল’ (যা/যাকে ডোবানো যায় না) উপাধি যোগ করে দেন।
তবে আনসিঙ্কেবল স্যামের অবিশ্বাস্য সমুদ্রযাত্রার তখনও একটি অধ্যায় বাকি ছিলো। কস্যাকের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এইচএমএস আর্ক রয়্যালে। এর আগে অনেকগুলো মিলিটারি অপারেশনেই অংশ নিয়েছিল ক্যারিয়ারটি। সফলভাবে সেসব সম্পন্ন করায় এর গায়ে ‘লাকি শিপ’ তকমাটি জুটে গিয়েছিল। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, স্যামের প্রথম জাহাজ বিসমার্ককে ডোবাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল তার বর্তমানে জাহাজ এইচএমএস আর্ক রয়্যাল এবং সদ্যই সাবেক হয়ে যাওয়া এইচএমএস কস্যাক!
১৯৪১ সালের ১৪ নভেম্বর, মাল্টা থেকে জিব্রাল্টারের দিকে যাচ্ছিলো আর্ক রয়্যাল। পথিমধ্যে জার্মান সাবমেরিন ইউ-৮১ থেকে টর্পেডো হামলার শিকার হয় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি। জার্মান টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটিতে বেশ বড়সড় ক্ষত তৈরি হয়ে যায়। একে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরামতের মতো পরিস্থিতিও আর ছিলো না। নাবিকেরা তাই দ্রুতই জাহাজটি ত্যাগ করেন। জিব্রাল্টারের ৩০ মাইল পূর্বে অল্প সময়ের মাঝেই সলিল সমাধি হয় আর্ক রয়্যালের। কিছুক্ষণ পর উদ্ধারকারী নৌকায় ঠাই মেলে আর্ক রয়্যালের সেসব বেঁচে যাওয়া নাবিক এবং অবশ্যই আনসিঙ্কেবল স্যামের।
উদ্ধার হওয়া সবাইকেই প্রথমে ডেস্ট্রয়ার এইচএমএস লাইটনিংয়ে এবং পরবর্তীতে ডেস্ট্রয়ার এইচএমএস লিজিয়নে স্থানান্তর করা হয়। আর্ক রয়্যালের ডুবে যাবার মধ্য দিয়েই শেষ হয় স্যামের ঘটনাবহুল ‘নাবিক’ জীবনের। তাকে জিব্রাল্টারের গভর্নর-জেনারেলের অফিসে রেখে আসা হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় যুক্তরাজ্যে। বেলফাস্টে নাবিকদের সাথেই থাকতো সে।
অবশেষে ১৯৫৫ সালে সমুদ্রতীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্যাম। জীবিত থাকাকালে বারবার জাহাজডুবির পরও বেঁচে যাবার কাহিনী তাকে বেশ বিখ্যাত করে তুলেছিল। বিড়ালটির সম্মানার্থে চিত্রশিল্পী জর্জিনা শ-বেকার তার একটি প্যাস্টল পোর্ট্রেটও এঁকেছিলেন। গ্রেনিচের ন্যাশনাল ম্যারিটাইম মিউজিয়ামে গেলে দেখা যাবে সেই চিত্রকর্মটি।
অবশ্য অনেক ইতিহসবিদই স্যামের এই ঘটনাগুলো মিথ্যা বলে দাবি করেন। সেসব জাহাজে স্যামের কোনো ছবি না থাকাকে তার স্বপক্ষের শক্ত প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। ইন্টারনেটেও স্যামের বিভিন্ন ছবি পাওয়া যায়, যেগুলোতে একেক সময় একেক বিড়ালের ছবি এসেছে।
বিসমার্ক যখন ডুবে যায় এবং সেখানে উদ্ধারকার্য চালানোর সময় পরিস্থিতি ছিলো বেশ ভয়াবহ। ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে বলা হয়েছিল পরবর্তী আদেশ দেয়ার আগপর্যন্ত অগ্রযাত্রা অব্যহত রাখতে, কারণ ধারণা করা হচ্ছিলো ধারেকাছেই কোথাও জার্মান ইউ-বোট থাকতে পারে। ফলে সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেককেই ফেলে রেখে এগিয়ে গিয়েছিলো ব্রিটিশ জাহাজগুলো। ব্রিটিশ সাংবাদিক ও মানবতাবাদী কর্মী স্যার লুডোভিচ হেনরি কভার্লে কেনেডির লেখনীতেও এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ওদিকে স্যামের কাহিনীতে উল্লেখ করা আছে, এইচএমএস কস্যাকের নাবিকেরা দয়াপরবশ হয়ে তাকে সমুদ্রের বুক থেকে তুলে নিজেদের জাহাজে জায়গা দেয়। ফলে পরবর্তীকালে নাবিকদের কাছ থেকে স্যামের নামে শোনা নানা কাহিনীর সত্যতা যে আসলেই কতটুকু, তা নিয়ে অনুসন্ধিৎসু মনে প্রশ্ন জাগে বৈকি!
স্যাম কিংবা অস্কার নামে কোনো বিড়াল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আসলেই তিন-তিনবার জাহাজডুবি থেকে বেঁচে গিয়েছিল কি না তা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকতেই পারে। আমরা আর সেদিকে না এগোই। বরং যারা কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে চান কিংবা যারা বলতে চান “হতেও তো পারে!”, তাদের জন্য মজার একটি বিষয় তুলে ধরেই আজকের লেখার ইতি টানছি।
কিছুক্ষণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এইচএমএস আর্ক রয়্যাল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডুবে যাবার পর সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়াদের প্রথমে এইচএমএস লাইটনিং, পরে এইচএমএস লিজিয়নে স্থানান্তরিত করা হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ এক বিমান হামলায় ডুবে যায় লিজিয়ন এবং পরের বছরের ১২ মার্চ ডুবে যায় লাইটনিংও!
কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষেরা বলতেই পারেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও; তাহলে কি বিষয়টা এমন না যে এই স্যামই আসলে কুফা! কারণ, সে যেসব জাহাজে উঠেছে সেগুলোর সবই প্রতিপক্ষের হামলায় ডুবে গেছে!”
স্যাম নামে আসলেই কোনো বিড়াল ছিল কি না সেটা বিচারের দায়ভার তাই পাঠক আপনার উপরই ছেড়ে দিলাম। কারণ, কথায় আছে, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!”
This is a Bangla article that discusses the story of Unsinkable Sam. Necessary references have been hyperlinked.
Feature Image: The Maritime Executive
বি.দ্র: ছবির বিড়ালটি স্যাম নয়