অনেকেই বিশ্বাস করেন, মানুষ আসলে চাঁদে যায়নি। পুরো ব্যাপারটাই ছিল আমেরিকার নাটক, চলচ্চিত্র পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিকের শ্যূট করা সিনেমার দৃশ্য, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নৈতিক বিজয় অর্জন করা।
বাস্তবে অবশ্য এটা নিছকই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। চাঁদে যাওয়ার পক্ষে এতো বেশি প্রমাণ আছে যে, কোনো জ্ঞানী মানুষ এখন আর এই প্রশ্ন তোলেন না। কিন্তু যেটি মোটেও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব না সেটি হচ্ছে, চাঁদে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল অনেক পরে। চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ারও অনেক আগে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেয়ার জন্য আমেরিকা আরেকটি শর্টকাট পদ্ধতির কথা বিবেচনা করেছিল। তারা চাঁদের বুকে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল। ইউএস এয়ার ফোর্সের টপ সিক্রেট এই প্রজেক্টের নাম ছিল প্রজেক্ট এ১১৯।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন অন্তত একটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। সেটি হচ্ছে মহাকাশ বিচরণ। ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন প্রথমবারের মতো মহাশূণ্যে তাদের স্পুটনিক স্যাটেলাইট প্রেরণ করে, তখন আমেরিকার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেরা যে সোভিয়েতের তুলনায় পিছিয়ে নেই, সেটা প্রমাণ করার জন্য তাদেরকেও বড় ধরনের কিছু একটা করে দেখাতে হবে।
এর কিছুদিন পরেই গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হতে শুরু করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন অক্টোবর বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উদযাপন করার জন্য ৭ নভেম্বর চাঁদের বুকে একটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটনার পরিকল্পনা করছে। এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই, ৩ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাশূন্যে তাদের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট, স্পুটনিক-২ প্রেরণ করে। আমেরিকানরা রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়ে। নিজেদের স্যাটেলাইট প্রেরণ করতে তাদের আরও কিছু সময় লাগবে, কিন্তু তার আগেই কিছু একটা ঘটিয়ে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে তারা। আর চাঁদের বুকে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটানো ছাড়া পুরো দুনিয়াকে দেখানোর মতো সহজ প্রকল্প আর কী হতে পারে?
মহাশূন্যে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালে পৃথিবীর পরিবেশের উপর তার কীরকম প্রভাব পড়বে, এটা নিয়ে একেবারে শুরু থেকেই আলোচনা হয়ে আসছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির আর্মার রিসার্চ ফাউন্ডেশন ১৯৪৯ সাল থেকেই এ বিষয়ে গবেষণা করে আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মহাকাশ জয়ের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ১৯৫৮ সালের মে মাসে মার্কিন বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে সংগঠনটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়, চাঁদের বুকে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তার প্রভাব পৃথিবীতে কী হতে পারে, সে বিষয়ে গবেষণা করার জন্য।
প্রকল্পটির নাম দেয়া হয় প্রজেক্ট এ১১৯। অত্যন্ত গোপন এই প্রকল্পটির কথা যখন ২০০০ সালে ফাঁস হয়, তখন এর প্রধান বিজ্ঞানী স্বীকার করেন, এটি ছিল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি পাবলিক রিলেশান্স স্টান্টের প্রচেষ্টা। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের বুকে এমন একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটানোর সম্ভাবনা যাচাই করা, যা পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে খালি চোখে দেখা যাবে এবং যা দেখে আমেরিকার সামরিক এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা সম্পর্কে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হবে।
আর্মার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের দশ সদস্যের একটি দল অত্যন্ত গোপনে তাদের গবেষণাকার্য শুরু করেন। তাদের গবেষণার বিষয় ছিল চাঁদের বুকে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তা থেকে বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে কীভাবে উপকৃত হওয়া যাবে, এবং এর বিপরীতে চাঁদের মাটিতে এবং পৃথিবীর পরিবেশে কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে, এসব বিষয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা। গবেষণা দলটির নেতৃত্বে ছিলেন লিওনার্ড রেইফেল নামে একজন বিজ্ঞানী, যিনি পরবর্তীতে নাসার অ্যাপোলো প্রোগামের ডেপুটি পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। এছাড়াও এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন নাসার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কিপার, যাকে আধুনিক গ্রহবিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করা হয়।
গবেষণাদলটির দশ সদস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন সদস্য ছিলেন তারকাখ্যাতি পাওয়া বিজ্ঞানী, জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব কার্ল সেগান। তখনও অবশ্য কার্ল সেগান বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। তিনি ছিলেন তখন অখ্যাত এক তরুণ বিজ্ঞানী। তার পরিচয় ছিল মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কিপারের ছাত্র হিসেবে। প্রজেক্টে এ১১৯ এ তার দায়িত্ব ছিল বিস্ফোরণের পর চাঁদের আশেপাশে কতদূর পর্যন্ত ধূলোর মেঘ ছড়িয়ে পড়বে, গাণিতিক উপায়ে তা নির্ণয় করা।
প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী লিওনার্ড রেইফেলের মতে, প্রকল্পের অধীনে চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠে বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা বিবেচনা করা হচ্ছিল। ফলে বিস্ফোরণ ঘটালেও পৃথিবী থেকে দেখা চাঁদের সৌন্দর্যে কোনো পরিবর্তন ঘটত না। তাদের আশা ছিল, যদি চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমায় ব্যবহার করা বোমার সমান ক্ষমতাবিশিষ্ট একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হতো, তাহলে তার ফলে যে বিশাল মাশরুম ক্লাউডের সৃষ্টি হতো, সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে তা পৃথিবীবাসীর চোখে ধরা পড়ত। পরবর্তীতে অবশ্য হিসেব করা হয়, পৃথিবী থেকে বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখার জন্য মাত্র ১.৭ কিলোটনের বোমাই যথেষ্ট হতো, যেখানে হিরোশিমার বোমাটি ছিল ১৩-১৮ কিলোটনের।
রেইফেল এবং তার টিম 'A Study of Lunar Research Flights' শিরোনামে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। রেইফেলের দাবি, তারা এর ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। চাঁদের বুকে ঠিক কীভাবে পারমাণবিক বোমাটি প্রেরণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু তিনি দাবি করেন, সে সময়ের প্রযুক্তি অনুযায়ী এটি অসম্ভব কিছু ছিল না। আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলের মাধ্যমে সে সময় চাঁদের বুকে যেকোনো স্থানের দুই মাইলের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব ছিল।
প্রজেক্ট এ১১৯ এর কথা দীর্ঘদিন পর্যন্ত গোপন ছিল। কিন্তু ১৯৯৯ সালে কার্ল সেগানের জীবনী রচনা করতে গিয়ে জীবনীকার কেই ডেভিডসন এর অস্তিত্বের কথা জানতে পারেন। কার্ল সেগান মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৯৯৬ সালে। তার মৃত্যুর পর তার জীবনী রচনার জন্য গবেষণা করতে গিয়ে কেই ডেভিডসন আবিষ্কার করেন, সেগান মিলার ইনস্টিটিউটের অত্যন্ত সম্মানজনক গ্র্যাজুয়েট ফেলোশিপের আবেদন করার সময় এই প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছিলেন, যদিও সে সময় এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশে পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা ছিল।
সেগানের জীবনী প্রকাশিত হওয়ার পরেই রেইফেল বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকল্পটির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেন। পরবর্তীতে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকেও প্রকল্পটি সংক্রান্ত কিছু নথিপত্র প্রকাশ করা হয়, যার মধ্যে 'A Study of Lunar Research Flights' গবেষণাপত্রটির অংশবিশেষও আছে।
বলাই বাহুল্য, শেষপর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মার্কিন বিমানবাহিনী প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। তাদের প্রধান আশঙ্কা ছিল, চাঁদের বুকে বিস্ফোরণের ঘটনাটিকে মানুষ ভালোভাবে নেবে না। এছাড়া প্রফেসর রেইফেলের মতে, চাঁদের আশেপাশে পারমাণবিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, যার কারণে ভবিষ্যতে চাঁদে অভিযান কিংবা চাঁদে কলোনী স্থাপনের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
নীল আর্মস্ট্রং যখন চাঁদের মাটিতে পা দিয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, এটি একজন মানুষের জন্য ছোট একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিশাল একটি লাফ। প্রজেক্ট এ১১৯ যদি আসলেই বাস্তবায়িত হতো, তাহলে তিনি হয়তো এই কথা বলার সুযোগ পেতেন না। তার পরিবর্তে হয়তো আমরা বলতাম, এটি ছিল আমেরিকার জন্য ছোট একটি বিস্ফোরণ, কিন্তু বিশ্বের জন্য বিশাল একটি ক্ষতি।
This article is in Bangla. It's about the secret US project to nuke the moon, namely Project A119. All the references are hyperlinked inside the text.
Featured Image: The New York Post