Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাজাখস্তানের গ্রামে হঠাৎ ঘুমের প্রকোপ

রাশিয়ার সীমান্ত থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দক্ষিণে, উত্তর কাজাখস্তানের দুটি গ্রাম কালাচি এবং ক্রাস্নোগোর্স্ক। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হলেও এই গ্রাম দুটিতে জার্মান এবং রুশ বাসিন্দাদের প্রাধান্য ছিল বেশি। একটা সময় ছিল যখন গ্রামগুলোতে ছয় হাজারের বেশি লোকের বসবাস ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে লোকের সংখ্যা কমতে থাকে। অধিকাংশ লোকই অন্যত্র স্থান পরিবর্তন করতে শুরু করেন। লোকসংখ্যা কমতে কমতে হাজারের কোঠায় এসে ঠেকে। আর সেখানকার ঐ অল্পসংখ্যক অধিবাসীরা সাক্ষী হয়ে থাকে এক অদ্ভুত ঘটনার।

মানচিত্রে কাজাখস্তান; Source: geology.com

কিছু বছর আগেকার ঘটনা। সময়টা ২০১৩ সালের মার্চ মাসের দিকে। সবকিছু বেশ স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। অন্য যেকোনো দিনের মতোই শুরু হয় সকলের সকালটা। কিন্তু হঠাৎ করেই গ্রামের অনেকেই যেন তাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনে অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে শুরু করেন। গ্রামের অনেকেই হঠাৎ প্রচন্ড ঘুম ঘুম অনুভব করতে থাকে। শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে, যেন কোথাও দাঁড়ানোর অবস্থা পর্যন্ত নেই তাদের। অনেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে বসে পড়ে। যারা কর্মস্থলে ছিল, তাদের অনেকে অফিসেই টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। গ্রাম দুটির প্রায় ১৪০ জনেরও বেশি লোক এই অদ্ভুত ঘুমের অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

কাজাখস্তানের গ্রামে ঘুমের অভিশাপ; Source: youtube.com

ঘুমের এই অসুখ এমনই তীব্র হয়ে উঠছিল যে যারা এমন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারা যেন কিছুতেই চোখের পাতা খোলা রাখতে পারছিলেন না। আর যারা অকারণে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন, তারা ঘুম থেকে উঠেই সবকিছু বেমালুম ভুলে বসছিলেন। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কী কারণে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এসব কিছুই মনে থাকছিল না কারো। তার সাথে আরো যুক্ত হতে থাকে মাথাব্যথা ও দুর্বলতা। এমনও কয়েকবার হয়েছে যে একজন সারা দিনে ৫-৬ বারের বেশিও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

কাজাখস্তানের স্লিপি হলো গ্রাম; Source: youtube.com

গ্রামের এই ঘটনায় চারপাশে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে এই ধরনের ঘটনাকে ‘স্লিপি হলো’ বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। রাশিয়ান পত্রিকা কমসমলস্কায়া প্রাভাদার এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়,

“অসুস্থ ব্যক্তি সচেতন থাকতে পারে, এমনকি হাঁটতেও পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি এমনভাবে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যে রীতিমত নাক ডাকতেও শুরু করেন। ঘুম থেকে জেগে উঠে ব্যক্তিটি কেন এবং কীভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তার কিছুই বলতে পারেন না।”

হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ার রোগে আক্রান্ত একজন; Source: en.trend.az

এই ঘুমের অসুখ, গ্রামটির বুড়ো থেকে তরুণ সকলকেই বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করে তুলেছিল। শিশুদের মধ্যেও এই ঘুমের প্রভাব ব্যাপক পরিমাণ বেড়ে চলতে থাকে। এই কারণে অভিভাবকেরা তাদের শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। অনেক শিশুর মধ্যে আবার দৃষ্টিভ্রম হওয়া শুরু করে। এলাকার কয়েকটি শিশু বলতে থাকে যে তারা এমন ঘোড়া দেখেছে, যার দু’পাশে পাখা রয়েছে। অনেকে আবার বিছানায় সাপ দেখেছে, আবার কেউ কেউ দেখেছে তাদের হাত পোকায় খেয়ে নিচ্ছে। অনেকে আবার অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে থাকে। এর ফলে ঘরের সকলেই বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

শিশুরাও আক্রান্ত ঘুমের অসুখে; Source: rebrn.com

আর মানুষের সাথে সাথে গৃহপালিত পশু-পাখিরাও এই ঘুমরোগে আক্রান্ত হতে থাকে। কালাচি গ্রামের এক অধিবাসী, ইয়েলেনা ঝাভোরনকোভা স্থানীয়  সংবাদমাধ্যম ভ্রেমায়াকে জানান যে তার পোষা বেড়ালটি হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। বিড়ালটি দেয়ালে এবং বাড়ির কুকুরকে আক্রমণ করতে থাকে যা এর আগে কখনো ঘটেনি। সকালের দিকে বিড়ালটি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে এবং টানা একদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকে। এতে স্বাভাবিকভাবেই ইয়েলানা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে।

বিড়ালের সাথে এক কালাচি বাসী; Source: newsweek.com

এই ঘুমের গ্রামের খবর খুব অল্প সময়ের মধ্যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, শিক্ষক নিয়মিত পরিদর্শন করতে থাকেন গ্রাম দুটিকে। বিভিন্ন ধরনের ধারণা এবং মতবাদ উঠে আসতে থাকে এই ঘুমের গ্রাম নিয়ে। অনেকের মতে, বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের প্রভাবেই এই রহস্যজনক অসুস্থতা। আবার কারো মতে, অতিরিক্ত নেশাজাতীয় পানীয় পান করার ফলেই এ ধরনের দৃষ্টিভ্রমের সৃষ্টি। কিন্তু এসব মতের পক্ষে তেমন কোনো জোরালো যুক্তি বা প্রমাণ কেউ দাঁড় করাতে পারেনি।

আকস্মিক ঘুমে আক্রান্ত কালাচিবাসী; Source: ibtimes.co.uk

অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এই ঘুমরোগে আক্রান্তদের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে থাকেন। কিন্তু অনেক গবেষণার পরেও তারা কোনো ধরনের মাদকের জীবাণু খুঁজে পাননি। কিন্তু রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকায় পরে তারা বিষয়টিকে একধরনের মানসিক রোগ বলেও আখ্যা দিতে থাকেন।

গবেষণায় যুক্ত বিশেষজ্ঞগণ; Source: nmc.net

স্থানীয় অনেকেই ধীরে ধীরে একে ভৌতিক কারণ হিসেবে আখ্যা দিতে থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই মতবাদ সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেন। তাদের সবসময় ধারণা ছিল যে এর পেছনে নিশ্চয় কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। এরপর আরো গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, গ্রাম দুটির খুব কাছেই ছিল একটি ইউরেনিয়ামের খনি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় বেশ সমৃদ্ধ ছিল এই খনি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে রীতিমতো পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পড়ে থাকে খনিটি। কিন্তু ঘুমের অসুখের প্রকোপ বাড়তে থাকায় বিশেষজ্ঞদের নজরে পড়ে খনিটি।

কালাচি গ্রামের পাশে ইউরেনিয়াম খনি; Source: buzzfeed.com

কাজাখস্তান হেলথ মিনিস্ট্রি তখন নড়েচড়ে বসেন। মিনিস্ট্রি থেকে কিছু অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং চিকিৎসক নিয়ে একটি পরিদর্শক দল গঠন করা হয়। বিশেষ এই দলকে পাঠানো হয় গ্রাম দুটির আশপাশের মানুষের ওপর পরীক্ষা করার জন্যে। প্রায় সাত হাজারের বেশি মানুষের উপর তারা পরীক্ষা চালায়। বিভিন্ন ঘরবাড়িতে গিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে দলটি। কিন্তু অনেক পরীক্ষা করেও গ্রামবাসীদের মাঝে তেমন কোনো উচ্চমাত্রায় রেডিয়েশন বা অন্য কোনো ক্ষতিকারক পদার্থ খুঁজে পায়নি দলটি। কিছু বাড়িতে রেডিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও, তা খুব বেশি পরিমাণে ছিল না।

কিন্তু গবেষকরা একটি ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, এই ইউরেনিয়ামের খনি হতেই ঘুমের প্রকোপ শুরু। গবেষণার এক পর্যায়ে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ইউরেনিয়ামের খনিটি বন্ধ হয়ে গেলেও এখনও এর প্রভাব ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। ঐ এলাকার বাতাসের ঘনত্ব পরীক্ষা করার পর তাদের মন্তব্য ছিল, এই খনিজের ফলে গ্রামের বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড এবং হাইড্রোকার্বন বেড়ে যাচ্ছিল। আর অন্যদিকে অক্সিজেন মাত্রাতিরিক্তভাবে কমে যাচ্ছিল।

কালাচি গ্রামের আবহাওয়া; Source: wired.com

স্থানীয় বাসিন্দারা খুব অল্প কাজ করেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। ফলে খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়ছিলেন এলাকার লোকজন। এর ফলে খুব দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব না পড়লেও ধীরে ধীরে স্থানীয়দের কর্মক্ষমতা কমে আসছিল অনেকাংশেই। তাই স্থানীয় প্রশাসন খুব দ্রুততার সাথে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রামের প্রায় ২২৩টির মতো পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করে সরকার। আর এর সাথে সাথেই মূলত সমাপ্তি ঘটে কাজাখস্তানের গ্রাম দুটির ঘুমের রহস্যের।

ফিচার ইমেজ: time.com

Related Articles