পশ্চিমা সংস্কৃতির অংশ হলেও চলচ্চিত্র-টিভি ধারাবাহিকের মাধ্যমে হ্যালোউইনের ছোঁয়া পড়েছে এ দেশেও। তবে হ্যালোউইনকে আধুনিক ভাবলে ভুল হবে, এর গোড়া ধলে টান দিলে চলে যেতে হবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সেল্টদের বিশ্বাস অনুযায়ী, গ্রীষ্মের শেষদিকে মৃতব্যক্তিরা ফিরে আসে, তাই এ উপলক্ষে মৃতদেরকে সম্মান করতে আর খারাপ আত্মাকে পুড়িয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সামহাইন উৎসবের আয়োজন করতো তারা। পরবর্তীতে রোমানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এ উৎসব।
পোপ তৃতীয় গ্রেগরির আমলে খ্রিস্টানরা পৌত্তলিকদের সামহাইন উৎসবকে নিজেদের মতো করে রূপান্তর করে নেয়। কালের বিবর্তনে এই উৎসবের সাথে যুক্ত হয়েছে কুমড়ার লণ্ঠন, ট্রিক অর ট্রিটসহ নানা উপাদান। হলিউডে তৈরি হয়েছে ঘোস্টবাস্টারের মতো অসংখ্য মুভি, স্টিফেন কিংয়ের উপন্যাসে উঠে এসেছে হ্যালোউইনের ভূতুড়ে আবহ।
প্রাচীন যুগের পৌত্তলিক সেল্ট কিংবা রোমবাসী থেকে শুরু করে বর্তমান যুগে পশ্চিমা দেশগুলোতে হ্যালোউইন উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত খেলার প্রচলন হয়েছে। সেগুলোই দেখে নেওয়া যাক।
অ্যাপল ববিং (প্রাচীন রোম)
ইংল্যান্ডে রোমানদের আগমন ঘটার পর সেল্টদের সংস্কৃতি নিজেদের করে নেয় স্থানীয় রোমানরা। হ্যালোউইন উপলক্ষে সবচেয়ে প্রচলিত খেলা সম্ভবত এই অ্যাপল ববিং, তবে বর্তমানে মজা করে খেলা হলেও তৎকালীন সময়ে রোমানদের কাছে এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানিতে উপচে পড়া বেসিনে ভেসে থাকা আপেল শুধুমাত্র দাঁত দিয়ে তোলাই ছিল এ খেলার নিয়ম। ফলগাছের দেবী পোমোনার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ হওয়া এ খেলা ছিল তরুণদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কারণ যে প্রথমে দাঁত দিয়ে আপেল টেনে তুলতে পারতো, পরবর্তী অনুষ্ঠানের আগেই তার বিয়ে হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
বোনফায়ার স্টোনস (প্রাচীন সেল্ট)
হ্যালোউইনের রাতে ঘুমানোর আগে সাদা পাথরে নিজের নামের আদ্যক্ষর লিখে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে গোল করে সাজিয়ে রাখতো সেল্টরা। সারারাত ধরে জ্বলা আগুন ধীরে ধীরে নিভে যেত। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেল্টদের প্রথম কাজ ছিল নিজেদের পাথর পরীক্ষা করা। যদি আগুনের উত্তাপে নিজের নাম লেখা সাদা পাথরে কোনো দাগ পড়তো, তার মানে হচ্ছে আগামী বছর তার জন্য খুবই খারাপ যাবে। অন্যদিকে অক্ষত পাথর বয়ে আনতো চিন্তামুক্ত ১২টি মাস!
বার্মব্র্যাক (আয়ারল্যান্ড, অষ্টাদশ শতাব্দী)
বার্মব্র্যাক হচ্ছে মূলত একধরনের ঐতিহ্যবাহী আইরিশ মিষ্টি রুটি। যা-ই হোক, হ্যালোউইনের সময় রুটির মধ্যে চীনাবাদাম, এক টুকরো কাপড়, একটি ছোট মুদ্রা, লাঠির অংশ কিংবা আংটি ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এরপর অনেকটা লটারির মতোই আইরিশরা রুটি বাছাই করে নিতো। রুটির মধ্যে চীনাবাদাম পাওয়া মানে হচ্ছে তাদের এ বছর বিয়ে হবে না, আংটি পাওয়া গেলে বিয়ে হবে, লাঠির টুকরো নির্দেশ করে অসুখী দাম্পত্যজীবন। অন্যদিকে কাপড়ের টুকরো দারিদ্র্য আর মুদ্রা সৌভাগ্য এবং ধন-সম্পদকে নির্দেশ করে।
ওইজা বোর্ড (যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৯১)
১৮৮৬ সালের ঘটনা, এক সাংবাদিকের কাছে দুই মহিলা হাজির হলেন। তারা দাবি করে বসলেন, তাদের কাছে একধরনের 'কথা বলা বোর্ড' আছে, যার সাহায্যে তারা মৃত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। সংবাদপত্রে এ ঘটনা আসার পর মেরিল্যান্ডের এক অ্যাটর্নি নিজের নামে ওইজা বোর্ডের পেটেন্ট করে নেন। তারপর থেকেই খেলনার দোকানে ‘নিখুঁতভাবে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলতে পারা’ ওইজা বোর্ড বিক্রি হওয়া শুরু করে, মাত্র দেড় ডলারের বিনিময়ে। যদিও এর মূল উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি, উনবিংশ শতাব্দীর মার্কিনদের মনে ওইজা বোর্ড বেশ ভালোই প্রভাব বিস্তার করেছিলো। আর হ্যালোউইনের রাতে কৌতূহলী কিশোরদের আতঙ্কিত করতে ওইজা বোর্ডই যথেষ্ট ছিল।
ব্লাডি মেরি (ইংল্যান্ড, ১৯৬০)
হ্যালোউইনের রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ৩ বার ‘ব্লাডি মেরি’ উচ্চারণ করলে বিকট মুখাবয়বের কোনো প্রতিশোধপরায়ণ আত্মাকে দেখার সাহস করতো না অনেক ইংরেজই। কেউ কেউ দাবি করে, এই মেরি হচ্ছে টিউডর রাজবংশের রানী প্রথম মেরি, আবার কারো কারো মতে এই মেরি হলো এলিজাবেথ বাথোরি, যিনি কুমারীর রক্ত দিয়ে গোসল করার জন্য কুখ্যাত। এটাও দাবি করা হয়, মেরি ওর্থ নামক এক ডাইনী, যিনি শিশুহত্যার জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনিই আয়নার মধ্যে দেখতে পাওয়া সেই মেরি। ১৯৬০ এর দশকে এই খেলাটি জনপ্রিয় হলেও প্রাচীন হ্যালোউইনের উৎসবের সাথে এর মিল পাওয়া যায়। হ্যালোউইনের শতাব্দী-প্রাচীন ঐতিহ্যে আয়নার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। প্রাচীন আমলের লোকেরা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভালোবাসার মানুষটিকে দেখার কামনা করতো, যা আধুনিক যুগে রূপ নিয়েছে ‘ব্লাডি মেরি’ নামক আত্মায়!
ময়দার পাহাড় (ইংল্যান্ড, উনবিংশ শতাব্দী)
এই সাধারণ খেলাটি পুরো বিশ্বেই বিভিন্নভাবে প্রচলিত রয়েছে। ময়দার দলার পাহাড়ের উপর একটি আঙুর রেখে দেওয়া হয়। এরপর প্রতিযোগীকে ভোঁতা ছুরি দিয়ে নিচ থেকে ময়দার দলাকে অল্প অল্প করে কেটে আলাদা করতে হয়। তারপর পাহাড় যখনই ভেঙে পড়ে, তখন প্রতিযোগীকে শুধুমাত্র দাঁত ব্যবহার করে আঙুরটি ওঠাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আঙুরের বদলে আংটিও ব্যবহার করা হয়। যে ব্যক্তি আগে আংটি ওঠাতে পারে, তার দ্রুত বিয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
উইল অ্যান্ড ও (যুক্তরাষ্ট্র, অষ্টাদশ শতাব্দী)
অষ্টাদশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে একটি জনপ্রিয় খেলা ছিল এই উইল অ্যান্ড ও। এ খেলাইয় প্রথমে দরজার উপরে ঘোড়ার নাল লাগিয়ে রাখা হতো। তারপর প্রতিযোগীদেরকে ৩টি করে আপেল দেওয়া হতো। তারপর কমপক্ষে ১০ কদম দূর থেকে এই আপেল ঘোড়ার নালের মধ্য দিয়ে নিক্ষেপ করা হতো। কেউ সফল হলে পরবর্তী বছর তার খুব ভালো কাটবে, অন্যদিকে ব্যর্থ ব্যক্তি ১২ মাস পর তার দুঃখ ঘোচানোর সুযোগ আবার পেত!
দ্য উইদার্ড কর্পস (যুক্তরাষ্ট্র, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ)
হ্যালোউইনের রাতে মৃতদেহ নিয়ে ভুতূড়ে কবিতা আবৃত্তির মতো অদ্ভুত আর কী হতে পারে? আর তার সাথে যদি চোখ বেঁধে মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ হাত দিয়ে ছুঁয়ে তার সঠিক নাম বলার প্রতিযোগিতা হয়! তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সত্যি সত্যি মৃতদেহ আলাদা করা হয় না। অক্ষিগোলকের বদলে চামড়া ছিলে ফেলা আঙুর, মৃতদেহের শূককীটের বদলে রান্না করা স্প্যাঘেটি কিংবা রক্তের বদলে টমেটো কেচাপ ছুঁয়ে নাম বলতে হয়! তবে বর্তমানে চোখ বেঁধে ছোয়ার বদলে বাক্সের মধ্যে বস্তুগুলো রেখে নাম আন্দাজ করার চ্যালেঞ্জ করা হয়।
ট্রিক অর ট্রিট
ট্রিক অর ট্রিটকে খেলা বললে ভুল হবে। ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকেই ইংল্যান্ডের বাচ্চারা উদ্ভট অভিনব পোশাক পরে প্রতিবেশীদের বাড়িতে হানা দিতো। তবে বিনামূল্যে ট্রিট কিংবা টাকা পয়সা নয়, বরং তার বিনিময়ে লোকসংগীত, নাচ কিংবা কৌতুক পরিবেশন করতে হতো।
তবে বর্তমানে ট্রিক অর ট্রিটের মাধ্যমে প্রচুর দাতব্য সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। হ্যালোউইনের ট্রিক অর ট্রিটের মাধ্যমে ইউনিসেফের তহবিলে এখনও পর্যন্ত ১৮৮ মিলিয়ন ডলার যোগ হয়েছে!
This article is in Bangla language. It is about the weird cultural sports playing in Halloween night. Necessary references are hyperlinked.
Feature Image: Fiverr