দুজন মানুষের মাঝে ঝগড়া লাগে, দুটো দেশের মাঝে বেঁধে যায় যুদ্ধ- এমন পরিস্থিতি আমরা বহুকাল আগে থেকেই দেখে আসছি। তবে ঝগড়া-যুদ্ধের সূচনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে সেসবের সমাপ্তি টানা হলো। কারণ, দিনশেষে সবাই শান্তিই চায়।
দুজন মানুষের বেলায় এ সমাপ্তি কখনও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আসে, আবার কখনও আইন-আদালতের হাত ধরে। দুটো দেশের ক্ষেত্রে একপক্ষকে সেই যুদ্ধ বা বিরোধে জিততে হয়, কিংবা দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ একসাথে বসে কোনো একটি চূড়ান্ত সমাধানে আসার চেষ্টা করে যান।
তবে মানুষে মানুষে এমন বিবাদ, হানাহানি আর ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে দেখতে বোধহয় প্রকৃতিও ক্লান্ত হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। তাই তো সেসব বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব সে তুলে নেয় নিজের হাতেই। আজ আমরা এমনই কিছু ঘটনার ব্যাপারে জানবো, যখন দুটো দেশের বিরোধ নিষ্পত্তিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিলো প্রকৃতিই।
১
১২৭৪ সালের কথা। ৫০০-৯০০টি জাহাজে চড়ে ৩০,০০০-৪০,০০০ মঙ্গোলীয় সেনা চীন থেকে রওয়ানা দিলো, উদ্দেশ্য জাপানকে তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত করা। জাপানের হাকাতা উপসাগরে গিয়ে নোঙর ফেললো মঙ্গোলদের বিশাল এই নৌবহর। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলো বড়সড় এক আক্রমণের। কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল ছিলো বোধহয় অন্যরকম। তাই তো মঙ্গোলরা জাপানে আঘাত হানার আগে উল্টো তারাই শিকার হয় ভয়াবহ এক ঘূর্ণিঝড়ের। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মঙ্গোলীয় যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সলিল সমাধি ঘটে প্রায় ১৩,০০০ সেনার। এত বড় ক্ষতির শিকার হয়ে মঙ্গোলরা এরপর চীনে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
তবে এটাই শেষ ছিলো না। ১২৮১ সালে আনুমানিক ৪,৪০০ যুদ্ধজাহাজ এবং ১,৪০,০০ সেনার সুবিশাল এক বাহিনী নিয়ে আবারও আগমন ঘটে মঙ্গোলদের। ওদিকে জাপানের ছিলো কেবলমাত্র ৪০,০০০ সামুরাই ও সৈন্য। আগস্ট মাসের ১৫ তারিখে জাপানের উপর মরণ ছোবল হানতে যাচ্ছিলো মঙ্গোলীয় সেনারা। কিন্তু আবারও জাপানের সহায় হলো প্রকৃতি। এবারও এক ঘূর্ণিঝড় এসে তছনছ করে দিলো মঙ্গোলীয়দের গোছানো রণকৌশল।
প্রায় অর্ধেক মঙ্গোল সেনাই এবার মারা যায়, ডুবে যায় প্রায় সব যুদ্ধজাহাজই। অল্প কিছু সৈন্যই বেঁচে ফিরতে পেরেছিলো চীনে। এছাড়া বেঁচে যাওয়া অনেকেই পরবর্তী সময়ে জাপানী সামুরাইদের শিকারে পরিণত হয়। এবারের ঘূর্ণিঝড় জাপানীদের মাঝে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে, ঘূর্ণিঝড় বোঝাতে তারা ‘কামিকাজি’ (স্বর্গীয় হাওয়া) শব্দটির ব্যবহার শুরু করে দেয়। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাদের রক্ষার্থেই সৃষ্টিকর্তা এই ঘূর্ণিঝড় প্রেরণ করেছিলেন।
২
এবার একটু আমাদের বাংলাদেশ এবং নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের দিকেই নজর দেয়া যাক। আনুমানিক সাড়ে ৩ কিলোমিটার লম্বা এবং ৩ কিলোমিটার চওড়া নিউ মুর দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বিবাদ চলছিলো প্রতিবেশী এই দুই দেশের মাঝে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই দ্বীপটির সন্ধান সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালে, স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বীপটির বয়স ততদিনে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গিয়েছিলো।
দ্বীপে নিজেদের দখল নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে ভারতের নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠানো হয় সেখানে, নিয়োগ দেয়া হয় বিএসএফ সেনাদের। ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে তারা সেখানে নিজেদের অধিকার সুসংহত করবার চেষ্টা চালায়। অবশ্য স্থায়ী কোনো স্থাপনা সেখানে গড়ে তোলা হয়নি।
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরীহ বাঙালীদের নিহত হবার ঘটনা নতুন কিছু নয়। তার উপর আবার নতুন এই দ্বীপ নিয়ে বিরোধ সম্ভবত প্রকৃতির পছন্দ হয়নি। তাই তো ১৯৮৭ সালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিতে দেখা যায়, দ্বীপটি ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে শুরু করেছে। ২০১০ সালে এর আর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৩
১৭৯৬ সালের কথা। ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের মাঝে সম্পর্ক তখন বেশ উত্তপ্ত। ফ্রান্সের বেশ কিছু অভিজাত ব্যক্তিবর্গ ও বিদ্রোহীকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিচ্ছিলো ব্রিটেন। সেই সাথে বেশ কিছু মিত্র দেশকেও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে সহায়তা করছিলো তারা।
এমন পরিস্থিতিতে ফ্রান্সও চুপচাপ বসে থাকার কথা না, আর তারা সেটা করেওনি। তারাও হাত মেলায় আইরিশ বিদ্রোহীদের সাথে, যারা তখন ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো। ফ্রান্সের পরিকল্পনা ছিল যে, তারা এই বিদ্রোহীদেরকে সহায়তা দেবে, যার মাধ্যমে আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের কবল থেকে মুক্ত হবে। এরপর থেকে ফ্রান্সের বিশ্বাসযোগ্য মিত্র হয়েই থাকবে আয়ারল্যান্ড।
১৭৯৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর; বেশ কিছু জাহাজে করে প্রায় ১৫,০০০ ফরাসি সেনার বহর ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ত্যাগ করে। মাঝপথে তারা ভয়াবহ এক ঝড়ের কবলে পড়ে। বেশ কিছু সেনা কোনোমতে বান্ত্রি উপসাগরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, যেখানে তাদের আঘাত হানবার আগে মিলিত হবার কথা ছিলো। তারপরও আঘাত হানা হলো না, কারণ জেনারেল ওশকে বহনকারী ফ্র্যাটারনাইট জাহাজটিরই কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিলো না। শেষপর্যন্ত ফরাসি সেনারা ইংল্যান্ডে আর আঘাত হানেনি। জেনারেল ওশ অবশ্য ফিরে এসেছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো, এর পরের বছর বাটাভিয়ান রিপাবলিক ব্রিটেনে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য তাদের নৌবহর বন্দর ছেড়েই বের হতে পারেনি।
৪
১৭০৮ সালে প্রায় ৪০,০০০ সুইডিশ সেনা আক্রমণ চালায় রাশিয়াতে। এটা ছিলো ১৭০০ থেকে ১৭২১ সাল পর্যন্ত চলা গ্রেট নর্দার্ন ওয়্যারেরই অংশ। সুইডিশ সেনারা সংখ্যায় কম হলেও বড় বড় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেবার ব্যাপারে তখন বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। পরাজিত হয়ে রাশিয়ান সেনারা স্বদেশের ভেতরের দিকে আশ্রয় নেয়। যাবার সময় তারা পুড়িয়ে দিয়ে যায় তাদের গ্রামগুলোকে।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, রাশিয়ান সেনারা কেন তাদের নিজ দেশের গ্রামগুলোই পোড়ালো। এটা আসলে ছিলো তাদের যুদ্ধকৌশলেরই অংশ। এর মাধ্যমে তারা এটা নিশ্চিত করেছিল যে, সুইডিশ সেনারা যখন দেশটির আরো ভেতরের দিকে অগ্রসর হবে তাদের পিছু পিছু, তখন যেন তারা কোথাও থেকে দরকারি রসদ সংগ্রহ করতে না পারে। পাশাপাশি বেশ কিছু রাশিয়ান ইউনিট তখন হামলা চালায় সুইডিশ সেনাদের রসদবাহী ইউনিটগুলোতে। ফলে সুইডিশ বহরে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
১৭০৯ সালের শীতটি পরিচিত ‘দ্য গ্রেট ফ্রস্ট’ নামে। সেই বছরের শীত ইউরোপে বিগত ৫০০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। একদিকে তীব্র শীত, অন্যদিকে রসদের অভাব- সব মিলিয়ে সুইডিশ সেনাদের অবস্থা ছিলো বেশ করুণ। এক রাতেই তারা হারায় প্রায় ২,০০০ এর মতো সহযোদ্ধাকে। শীত শেষ হতে হতে প্রায় অর্ধেক সুইডিশ সেনাই মারা যায়। গ্রীষ্ম শুরু হলে অবশিষ্ট সুইডিশ সেনারা আবারও রাশিয়ায় আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু ততদিনে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় প্রায় ৮০,০০০ রাশিয়ান সেনা। শেষপর্যন্ত মাত্র ৫৪৩ জন সুইডিশ সেনা জীবন নিয়ে স্বদেশে ফিরতে পারে।
৫
প্রোটেস্ট্যান্ট রানী এলিজাবেথকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না স্পেনের রাজা ২য় ফিলিপ। তাই ১৫৮৮ সালের দিকে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, এলিজাবেথকে সরিয়ে সেখানে কোনো রোমান ক্যাথলিককে বসাতে হবে। এই উদ্দেশ্যে ১৩০টি জাহাজের বিশাল এক বহর তিনি পাঠালেন ফ্ল্যান্ডার্সের উদ্দেশ্যে, যেন সেখান থেকে ৩০,০০০ এর মতো সেনা নিয়ে তারা ব্রিটেনের অভিমুখে যাত্রা করতে পারে।
ব্রিটিশরা এই অভিযানের ব্যাপারে আগেভাগেই টের পেয়ে যায়। ফলে তারাও প্রস্তুত হয়ে এগিয়ে যায়। প্লাইমাউথের উপকূলবর্তী অঞ্চলে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। বেশ কয়েকবার যুদ্ধে জড়ালেও কোনো পক্ষই জয়ের দেখা পাচ্ছিলো না। শেষপর্যন্ত পরাজয় ঘটে স্পেনেরই, তবে সেটা ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হাতে না, বরং প্রকৃতির কাছে। মারাত্মক এক ঝড়ের কবলে পড়েই দফারফা হয়ে যায় স্প্যানিশদের।
এই দুর্ঘটনায় পড়ে স্প্যানিশদের রসদ সরবরাহ কমে যাবার পাশাপাশি আহতদের সেবাশুশ্রুষার বিষয়টিও ছিলো। তাই তারা স্পেনে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঝড়ের রাগ বোধহয় তখনও কমেনি। তাই তো ফিরে যাবার সময়ও ঝড়ের প্রকোপে আরো অনেকগুলো জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৩০টির মাঝে মাত্র ৬০টি জাহাজ স্পেনে ফিরতে পেরেছিল, মৃত্যুবরণ করেছিল প্রায় অর্ধেকের মতো স্প্যানিশ সৈন্য।
This Bangla article describes some events in history when battles were calm down by mother nature. Necessary references have been hyperlinked.
Feature Image: Wikimedia Commons