আমেরিকান বিপ্লবের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিনগুলো যে খুব ভাল কেটেছিল তা বলা ঠিক হবে না। অঞ্চলভেদে নানারকম সমস্যা লেগেই থাকত নবগঠিত দেশটিতে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মূল মাথাব্যথা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা। প্রচলিত অর্থে তাদের বলা হয় আফ্রিকান-আমেরিকান। উপনিবেশিক শাসনামলে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল আমেরিকা মহাদেশে। মূলত সে সময় আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দাস হিসেবে আনা হয়েছিল তাদেরকে। কেউ কেউ আবার উন্নত জীবনের আশায় মহাসাগরে গা ভাসিয়েছিলেন আফ্রিকা থেকে।
দেড়শ বছরের দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখাকে কেন্দ্র করে ১৮৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। একই সময় দাসপ্রথার পক্ষ নেয়া শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন কনফেডারেসি বা মৈত্রী রাষ্ট্র গঠন করার উদ্যোগ নেয়। শেষপর্যন্ত কনফেডারেসি বাঁচিয়ে রাখার জন্য সৃষ্ট গৃহযুক্ত থামাতে বাধ্য হয় মার্কিন সরকার। সেই সাথে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ৪ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ নারী, পুরুষ ও শিশুকে মুক্তি দেয়া হয়।
বাস্তবিক এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি আফ্রিকান-আমেরিকানরা। নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অন্যতম প্রধান দাবি ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। সংবিধানের সংশোধনী তাদেরটে প্রকৃত আমেরিকান হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ব্যালট পেপারে নাম যাওয়া পর্যন্ত বিষয়টা ছিল অনেকটাই অস্বীকৃত। এই মানুষগুলোর ভোটাধিকার পাওয়ার ইতিহাস সুদীর্ঘ। চলুন জানা যাক সে সম্পর্কে।
ব্ল্যাক কোড
১৮৬৫ সালের এপ্রিলে আব্রাহাম লিংকন খুন হওয়ার পর প্রস্তাবিত ইউনিয়ন পুনর্গঠনের দায়িত্ব পড়ে তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি এন্ড্রু জনসনের কাঁধে। টেনেসিতে জন্মগ্রহণকারী ইউনিয়নবাদী এই রাজনীতিবিদ অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তিমত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি ইউনিয়ন পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলের শ্বেতাঙ্গদের দাবিগুলোকে প্রাধান্য দেন। মূলত গৃহযুদ্ধের জন্য দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গরাই বেশি দায়ী। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, দক্ষিণের রাজ্যসমূহকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে রাখার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের দাবিগুলোও প্রাধান্য দেয়ার দরকার ছিল। সে কারণেই হয়তো এন্ড্রু জনসন এমন কৌশল অবলম্বন করেন।
অনেক বিতর্কের পরেও সংবিধানের নতুন সংশোধনীতে দক্ষিণের রাজ্য সমূহের আংশিক সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলেন তিনি। এরই মাঝে দক্ষিণের অনেক আইনসভা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বিধিনিষেধ স্বরূপ নতুন ব্ল্যাক কোড আইন পাশ করে। এতে করে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তাদের জীবনযাত্রা। এসব দেখে কংগ্রেসের রিপাবলিকানদের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মূলত দক্ষিণাঞ্চলে ব্ল্যাক কোডের আড়ালে আবারও দাসপ্রথার প্রবর্তনের চেষ্টা করছিল শ্বেতাঙ্গরা।
অতঃপর ১৮৬৬ সালের গোড়ার দিকে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসেবে কৃষ্ণকায় মানুষদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নাগরিক অধিকার বিল কংগ্রেসে উত্থাপন করা হয়। এই বিলের বিপক্ষে মতামত পেশ করে এন্ড্রু জনসন ভেটো দেন। যদিও অধিংকাংশ সদস্যের সমর্থন পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবার রাষ্ট্রপতির ভেটো থাকা সত্ত্বেও কোনো বিল গুরুত্বপূর্ণ আইনে পরিণত হয়। যদিও একে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখেন অনেক ইতিহাসবিদ।
চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ সংশোধনী
১৮৬৭ সালের মার্চ মাসে একটি নতুন আইন পাশ করার মধ্য দিয়ে কংগ্রেশনাল যুগ শুরু হয়। এই আইন পাশ করার ক্ষেত্রেও ভেটো দিয়েছিলেন জনসন। পরবর্তী এক দশকে নতুন প্রণীত এই আইনটির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জায়গায় কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দেন। ১৮৬৮ সালের নির্বাচনে সর্বমোট ২২ জন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ২ জন সিনেটেও আসন পান। মূলত রিপাবলিকানদের ক্ষমতায় বসানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই কৃষ্ণাঙ্গ নেতারা।
চতুর্দশ সংশোধনীর প্রক্রিয়াটি ১৮৬৬ সালে শুরু হয়েছিল। যদিও এটি কংগ্রেসে অনুমোদন পেয়ে আইন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ১৮৬৮ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে। চতুর্দশ সংশোধনীতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা সকল নাগরিকের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। সকল নাগরিক বলতে জন্মসূত্রে কিংবা অভিবাসী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা সকলকেই বোঝায়। এই নাগরিকত্ব আইনে দাসসহ প্রায় সকল কৃষ্ণাঙ্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অতঃপর ১৮৭০ সালে নাগরিকত্ব সংস্কারের তৃতীয় আইনটি পাশ হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বলা হয়- জাতি, বর্ণ কিংবা অতীতের দাসত্বকে সামনে এনে কারও ভোটাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এমনকি নাগরিক হিসেবে সবার অধিকার সমানভাবে দেখা হবে। মূলত দক্ষিণাঞ্চলে প্রচলিত ব্ল্যাক কোড নামক বৈষম্য দূর করার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করে রিপাবলিকান সরকার। এতে করে দক্ষিণে প্রথমবারের মতো শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও তখন অধিকাংশ ভূমির কর্তৃত্ব ছিল শ্বেতাঙ্গদের হাতে। এই আইনের পরেও ভোটারদের মতো কৃষ্ণাঙ্গ নির্বাচন কর্মকর্তারা বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ সংগঠনের কর্মীদের মাধ্যমে নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার হতেন।
নাগরিক অধিকার পুনর্গঠনের যুগ
রিপাবলিকানদের পঞ্চদশ সংশোধনীতে জাতিগত বৈষম্য অনুযায়ী ভোটাধিকারের বিষয়টি একেবারেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যোগ্যতা যাচাইবাছাই করার ক্ষমতা রাজ্য সরকারকে দিয়ে রেখেছিল। রিপাবলিকানদের জনপ্রিয়তা তখনও তুঙ্গে ছিল বলে তারা ভেবেছিল রাজ্যগুলো সবসময় তাদের অধীনে থাকবে। এই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলো ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর প্রদানসহ নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করে।
কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বরাবরই হিংসাত্মক ঐ অঞ্চলের সরকার এসব বিধিনিষেধ শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার জন্যই আরোপ করতো। ফলশ্রুতিতে আবারও ব্ল্যাক কোড নামক বৈষম্য চালু হয় যা কয়েক দশক ধরে চলতে থাকে। শ্বেতাঙ্গদের এমন বিভেদে শুধুমাত্র ভোটাধিকারের ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েনি কৃষ্ণাঙ্গরা, একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিকভাবে উঁচু-নিচু যে স্তর তৈরি হয়েছিল সেখানে তারা শোচনীয়ভাবে নিম্নমানের জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
দীর্ঘদিন যাবত বঞ্চিত হওয়ার পর ১৯৫০ এবং '৬০ এর দশকে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকারের বিষয়টি নাগরিক অধিকার আদায়ের দাবিতে পরিণত হয়।। মানুষ রাজপথে নেমে অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করায় ১৯৬৪ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু জাতীয় প্রতিষ্ঠানে জাতিগত পৃথকীকরণ নিষিদ্ধ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সঠিক নাগরিক আইন প্রণয়ন করে মার্কিন সরকার। কিন্তু সেখানেও ভোটাধিকারের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো সমাধান হয়নি।
১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং কিছু সংখ্যক আন্দোলনকারীকে সঙ্গে নিয়ে বিশাল লোকসমাগম তৈরি করে আলাবামার রাজপথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাদের দাবি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেনিকানদের ভোটাধিকারের সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে নেয়া এবং পূর্ণাঙ্গ নাগরিক সুবিধা আদায় করা। দুর্ভাগ্যবশত তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আক্রমণ করে শ্বেতাঙ্গ সংগঠনের কর্মীরা। এতে করে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নজর পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের দিকে। পরের বছর প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ভোটাধিকার আইনে স্বাক্ষর করেন। এতে করে মার্কিন নাগরিকদের ভোটাধিকার অর্জন করতে স্বাক্ষরতাসহ বিভিন্ন প্রকার যোগ্যতা প্রমাণের পদ্ধতি বাতিল হয়।
সংকট তখনও চলমান
জনসন প্রশাসন কর্তৃক ভোটাধিকার আইন পাশের পূর্বে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ২৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক মূল ভোটার তালিকায় জায়গা করে নেন। ১৯৬৯ সালে এই সংখ্যা ৬১ শতাংশে পৌঁছায়। অতঃপর ১৯৮০ সালের মধ্যে শুধুমাত্র দক্ষিণাঞ্চলেই কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারের সংখ্যা পুরো দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের তুলনায় বেড়ে যায়। ইতিহাসবিদ জেমস কোব ২০১৫ সালে লেখেন, ১৯৮০ সালে দক্ষিণাঞ্চলের সরকারি অফিসগুলোতে যে সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ কাজ করতো তা ছিল গোটা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য জায়গার জনসংখ্যার তুলনায় বেশি।
২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারের সংখ্যা শ্বেতাঙ্গদের ছাড়িয়ে যায়। ৬৬.৬ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের ভোটে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা পুনঃনির্বাচিত হন। এই পরিস্থিতির পর ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ভোটাধিকার আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাতিলের নির্দেশনা দেয়। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, যেসব রাজ্যে ভোটার বৈষম্য বিদ্যমান ছিল কিংবা আছে সেখানে নির্বাচনী আইন পরিবর্তন করার আগে ফেডারেল অনুমোদন নেয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল সংবিধানবিরোধী।
সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি রাজ্য ভোটাভুটির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধ আরোপ করে। সেসবের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ভোটদান সীমাবদ্ধ করা এবং জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবি সংযুক্ত করার প্রক্রিয়াটি ছিল উল্লেখযোগ্য। এই প্রক্রিয়াকে সমর্থনকারী লোকেরা বলছেন, এতে করে ভোটে জালিয়াতি কমবে। আর সমালোচকেরা বলছেন, এটি আবারও ভোটাধিকারের কালো যুগে প্রবেশের সংকেত। কারণ এতে করে আবারও ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে যোগ্যতার বিধিনিষেধ উঠে আসবে এবং যার ফল ভোগ করবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকরা।
This article written about African Americans voting rights. After more then hundreds of year nothing is clear.
Feature Image: History Collection.com