স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ভোট দেয়ার অধিকার রয়েছে আমাদের প্রত্যেকের। যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই এটি সত্য। বাংলাদেশেও আমরা আঠারো বছর বয়স হলেই ভোট দেয়ার অধিকার লাভ করি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই অধিকার রয়েছে আমাদের; শর্ত একমাত্র এই দেশের নিবন্ধিত নাগরিক হওয়া। তবে সবসময় কি এরকম ছিল? আধুনিক ভোটিং প্রক্রিয়ার জন্য সারা বিশ্ব যে দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সেই আধুনিক গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাষ্ট্রেই কি সকল নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাগণ, যাদের আমরা চিনি ফাউন্ডিং ফাদারস নামে, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন অসাধারণ মানুষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় তাদের প্রত্যেকের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। কিন্তু বিখ্যাত ‘ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রণেতা এই জাতির পিতারাও তাদের পাহাড়সম ব্যাক্তিত্বের আড়ালে মানবিক দোষ-গুণ সম্পন্ন সাধারণ মানুষই ছিলেন। তাদের মধ্যেও ছিল বর্ণবাদী চিন্তাভাবনা। এবং এই কারণেই তারা যে আমেরিকাকে ‘ল্যান্ড অফ দ্য ফ্রি’ বানাতে চেয়েছিলেন, সেই আমেরিকাতেই তাদের অনেকে আবার অনেক সংখ্যালঘু জাতির ও নিম্নবর্গের মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিপক্ষে ছিলেন।
ফাউন্ডিং ফাদারস অফ ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা
প্রথমে ছোট্ট করে জেনে নেয়া যাক এই জাতির পিতাগণের পরিচয়। তাদের অনেকেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য বড় পদে ছিলেন, তাই তাদের অনেকের নামই হয়তো আমাদের কাছে পরিচিত হতে পারে। মূলত সাতজনকে ফাউন্ডিং ফাদার্স বলা হয়। তারা হলেন জর্জ ওয়াশিংটন, জেমস ম্যাডিসন, থমাস জেফারসন, জন জে, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, জন অ্যাডামস এবং আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। তারা প্রত্যেকে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ হলেও একটি ব্যাপারে তাদের প্রত্যেকের অবদান অনস্বীকার্য, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত মনোমালিন্যও কম ছিল না, তবে তা নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করা যাবে। তাদের মধ্যে ওয়াশিংটন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি, জন অ্যাডামস দ্বিতীয়, জেফারসন তৃতীয় এবং জেমস ম্যাডিসন ছিলেন চতুর্থ রাষ্ট্রপতি।
জর্জ ওয়াশিংটন: রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
জর্জ ওয়াশিংটন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ১৭৮৯ সালে, তা ছিল ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের হাত থেকে মুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন তার বিপুল জনপ্রিয়তার হাত ধরে ভোটে জেতেন কোনোরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই। ইলেক্টোরাল ভোটের ৬৯ আসনের ৬৯টিতেই জিতে যান। তবে তিনি কি সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ইচ্ছায় রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন?
উত্তর হবে, না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল জনগণের খুব ছোট একটি অংশই ভোট দিয়েছিল সেই সময়, তারা ছিল শ্বেতাঙ্গ জমিদারেরা। এবং তারা ছাড়া যে অন্য কেউ ভোট দিতে আগ্রহী ছিল না তা নয়, বাকিদের ভোট দেয়ার অধিকারই ছিল না!
জন অ্যাডামসের চিঠি
এই যে ভোটাধিকার সংরক্ষিত ছিল শুধুমাত্র বড়লোক শ্বেতাঙ্গদের জন্য, এতে বেশ কয়েকজন ফাউন্ডিং ফাদারের মৌখিক এবং লিখিত সমর্থনও ছিল। তারা মূলত আমেরিকার তৎকালীন ফেডারেলিস্ট পার্টির সদস্যগণ (যারা মূলত কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালীকরণের পক্ষে ছিলেন রিপাব্লিকানদের বিপরীতে, যারা ছিলেন রাজ্য সরকার শক্ত করার পক্ষে), যাদের কিছু বিতর্কিত নৈতিক অবস্থান ছিল। এই ফেডারেলিস্টদের অগ্রগণ্য ছিলেন জন অ্যাডামস, ওয়াশিংটনের পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি।
তার ১৭৭৬ সনে লেখা একটি চিঠি থেকে ভোটাধিকার নিয়ে তার কিছু মতামত সম্পর্কে জানতে পারি আমরা, এবং মতামতগুলো খুব উদার নয়। তিনি চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে, ধনী শ্বেতাঙ্গ বাদে জনগণের অন্য অংশকে ভোটাধিকার দেয়ার ফলাফল বেশ খারাপ হতে পারে। তার মতে, এতে জনগণ নতুন নতুন দাবিদাওয়া পেশ করবে ক্রমাগত, মেয়েরা ভোট চেয়ে বসতে পারে, ১২-২১ বছরের সবাই বলতে শুরু করবে তাদের অধিকারগুলো সরকার ঠিকমতো দিচ্ছে না, এবং একেবারে নিম্নস্তরের অশিক্ষিত মানুষরাও (দাপ্তরিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজে যাদের মতামত অবাঞ্ছিত বলে মনে করতেন অ্যাডামস) ভোটে এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য সিদ্ধান্তে মতামত দেয়া শুরু করবে।
এই খোদ ‘ল্যান্ড অফ দ্য ফ্রি’তেই ভোটাধিকারহীন, পরাধীন মানুষেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কৃষ্ণাঙ্গ, নারী, আদিবাসী আমেরিকান এরা কেউই একজন শ্বেতাঙ্গের সমান মানবাধিকার পেতেন না, তার প্রধান প্রমাণ এই ভোটাধিকারে বৈষম্য দেখেই বোঝা যায়।
কবে ভেঙেছিল এই বৈষম্য?
অ্যাডামসের সাবধানবাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভোটাধিকার পেয়েছিল প্রায় সকল প্রান্তিকেরাই, তবে সেটা পাওয়া সহজ হয়নি, এবং সকলে একই সময়ে পায়নি। সব মানুষ যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান এটা পুরোপুরি মানতে গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের লেগেছিল প্রায় ২০০ বছর। এবং তা-ও ধাপে ধাপে।
প্রথমেই ঘুচেছিল সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদার বাঁধ। ১৮৫৬ সালে সম্পত্তির মালিকানার জন্য শ্বেতাঙ্গদের ভোট দেয়ার অধিকারে হেরফের ঘুচে যায়, তবে তা-ও শুধু শ্বেতাঙ্গ এবং পুরুষদের জন্যই। এর পরে অনেক সংগ্রাম ও রক্তপাতের পরে ভোটাধিকার পায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা, ১৮৭০ সালে, রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পরে। এর পরে ভাগ্যবান হয় নারীরা, তা-ও অনেক আন্দোলন ও প্রথম ধারার নারীবাদীদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলেই, ১৯২০ সালে, গৃহযুদ্ধের প্রায় ৫০ বছর পরে। এর বছর চারেক পরে ভোটাধিকার পায় আদিবাসী আমেরিকানরা, ১৯২৪ সালে।
এই ভোটাধিকার পেতে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ, নারী, আদিবাসী এবং সকল প্রান্তিক জনগণকেই। ‘ল্যান্ড অফ দ্য ফ্রি’- নামের সার্থকতা পেতে লেগেছে প্রায় ২০০ বছর, এবং এখনও পুরোপুরি পেয়েছে বলা চলে না।
বর্তমান অবস্থা এবং ভোটার রেজিস্ট্রেশন
বর্তমানেও যে সকলের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে তা বলা যায় না, এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনেক উন্নত দেশ সহ পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ দেশের জন্যই তা সত্য। ভোট চুরি, জোর করে দুর্বল ও প্রান্তিকদের থেকে ভোট আদায়, ভোটকেন্দ্রে জালিয়াতি, প্রচ্ছন্ন একনায়কতন্ত্রসহ বিভিন্ন কারণে এখনও অনেক মানুষের ভোটাধিকার শুধু কাগজে-কলমে থাকে। এবং এই কাগজ-কলমটিই ভোটার নিবন্ধন পদ্ধতি, যা সবার ভোটাধিকার এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য তৈরি হলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় ভোটাধিকার লঙ্ঘনের কাজেই।
পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্রচালিত ভোটার নিবন্ধনও হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রেই, ১৮০০ সালে। তবে তাতে কিছু সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চালও ছিল। অনেক জায়গায় ভোটার নিবন্ধন এতই কঠিন করা হয়েছিল যে মানুষকে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করে ফেলতো, বলেছেন বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অ্যালেক্স কেইসার, তার বই দ্য রাইট টু ভোট: দ্য কন্টেস্টেড হিস্ট্রি অফ ডেমোক্রেসি ইন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস-এ। এই চাল ছিল মূলত অভিবাসীদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করার জন্য। তবে কেইসারের মতে, ক্রমে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়, এবং ভোটার নিবন্ধনের ফলে নির্বাচনে স্বচ্ছতা আসে, যা কাম্য ছিল। তবে ভোটার নিবন্ধন আইনগুলো এতই জটিলভাবে তৈরি করা যে, সকল রাজ্যে এই আইনের ফাঁকফোঁকর ব্যবহার করে জনগণের ভোট নিজের দিকে আনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল রাজনীতিবিদদের মধ্যে, যা আজও অনেকাংশে চালু আছে।
বর্তমানে ভোটার নিবন্ধন অনেক সহজ এবং প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে অবশ্য। তবে প্রান্তিক এবং দরিদ্র মানুষের জন্য এখনও ভোটার নিবন্ধন তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সঠিক মাধ্যম হয়ে উঠতে পারছে না আমাদের দেশে। মৃত ব্যক্তির ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধারণত গরীব বা প্রান্তিক মানুষদের ভোট নিয়েই এ ধরনের কারচুপি হয়ে থাকে। এর সমাধান করার জন্য অবশ্য নতুন কোনো প্রক্রিয়ার দরকার নেই, তবে বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রচুর সংস্কার প্রয়োজন।
Featured Image: Stock Montage/Getty Images
References: The sources are hyperlinked in the article
Description: This is a Bangla article about the exclusionary history of voting and voter registration