যুদ্ধের সময় বিবদমান দুটি পক্ষের যেকোনো একপক্ষ চাইলেই যে প্রতিপক্ষ দেশের উপর গতানুগতিক গোলাগুলি চালানোর বাইরে নিজ দেশের সরকারবিরোধীদের উপর ভয়াবহ সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারে– এটা খুব সুচারুভাবে দেখিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক জান্তা সরকার। কারণ, যুদ্ধের সময় সাধারণত একটি দেশের সবধরনের গণমাধ্যম যুদ্ধের বিভিন্ন খবর প্রকাশ করা নিয়ে মেতে থাকে, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারও যুদ্ধকালীন সাংবাদিকতার এই নিয়মের সুযোগ নিয়েছিল। কোরিয়া উপদ্বীপের যুদ্ধে প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী কী করছে, দখলকৃত জায়গা ফিরে পাওয়া যাচ্ছে কিনা, উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য কতটুকু– এ ধরনের খবরের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যম পুরোপুরি যুদ্ধমুখী হয় এবং যুদ্ধবিষয়ক হালনাগাদকৃত তথ্য দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করে।
দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদের পদ্ধতি অনুসরণ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এশিয়ার চারটি দেশকে 'এশিয়ান টাইগার্স' বলা হয়, যার একটি দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটি প্রযুক্তিগত দিক থেকে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। একই সময়ে জাপানের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার থেকে যোজন যোজন এগিয়ে গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, যেখানে উত্তর কোরিয়া এখনও ধুঁকছে। অনেক দেশের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া এখন রোল মডেল। কিন্তু এই দেশই মাত্র সত্তর বছর আগে সংঘটিত কোরিয়া যুদ্ধের আগে, যুদ্ধচলাকালীন এবং যুদ্ধের পরে নিজ দেশের নাগরিকের উপর রাজনৈতিক কারণে রীতিমতো দশটিরও বেশি গণহত্যা চালায়, যেটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করা হয় না। অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের দ্বারা পরিচালিত এসব গণহত্যার খবর যেন বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সেজন্য তাদের সরকার এবং তার মিত্র দেশগুলোও যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান নাৎসি জার্মানির অক্ষশক্তির পক্ষে অংশগ্রহণ করে। বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল কী ছিল, তা আমরা সবাই মোটামুটি জানি। জাপানের দুই সমৃদ্ধ নগরী হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে গণবিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে এই যুদ্ধের যবনিকাপাত ঘটে। যুদ্ধ শুরুর আগে কোরিয়া উপদ্বীপে জাপানি দখলদারিত্ব ছিল। কিন্তু যেহেতু বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হয়, তাই সেখান থেকে তারা সরে যেতে বাধ্য হয় এবং মিত্রপক্ষের অন্যতম দুই প্রধান শক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়া উপদ্বীপকে ভাগ করে। দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকা পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন করে। অপরদিকে উত্তর কোরিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত করে। উত্তর কোরিয়ার নেতারা চেয়েছিলেন যুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়াকে পরাজিত করে আবার আগের মতো দুই কোরিয়া একত্রিত করে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা হবে। এজন্য ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়া সীমান্ত অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ার উপর সামরিক আক্রমণ চালায় এবং কোরিয়া উপদ্বীপের যুদ্ধ শুরু হয়।
বোদো লীগ গণহত্যা (Bodo League) দিয়েই শুরু করা যাক। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং দেশটির জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা সিংম্যান রি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞ বিচারকদের পরামর্শে গতানুগতিক বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তির পরিবর্তে কমিউনিস্ট নেতাকর্মী এবং এর প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের সংশোধনের জন্য 'রি-এডুকেশন প্রোগ্রাম' হাতে নেন। এই প্রোগ্রামকেই বলা হতো 'বোদো লীগ'। এই প্রোগ্রামের অধীনে ফাঁসি কিংবা দীর্ঘদিন কারাবাসের পরিবর্তে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের সমর্থক হাওয়ার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা দেয়া হতো। প্রায় দুই লাখ কমিউনিস্ট ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিকে এই প্রোগ্রামের অধীনে নিয়ে আসা হয়, যাদের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি ছিলেন যারা কমিউনিস্টও না, কিংবা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিলেন না। কোরীয় যুদ্ধ শুরু হলে প্রধানমন্ত্রী সিংম্যান রি দক্ষিণ কোরিয়ান সেনাবাহিনী ও স্থানীয় কমিউনিস্টবিরোধী জনগণ জেলে আটক থাকা কমিউনিস্টদের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ইতিহাসবিদদের মতে, আনুমানিক দুই লাখ মানুষ শুধু রাজনৈতিক কারণে এই গণহত্যার শিকার হন।
দক্ষিণ কোরিয়ার আরেকটি ঘৃণ্যতম গণহত্যা সংঘটিত হয় গানঘোয়া দ্বীপে। যুদ্ধ শুরু হলে এই দ্বীপের মানুষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী লড়াই করছিল, তখন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করেছিল। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশবাহিনী, যুদ্ধরত সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু ইউনিট ও স্থানীয় আধাসামরিক বাহিনী– দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান তিনটি বাহিনী দ্বীপবাসীদের 'যথোপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার' জন্য একত্রিত হয়। ১৯৫১ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি মাত্র তিন দিনের মধ্যেই প্রায় তেরশো দ্বীপবাসীকে কোনো বিচার ছাড়াই ফায়ারিং স্কোয়াডে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়োংস্যাং অঞ্চলে ঘটে আরেক গণহত্যা। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী অঞ্চলটি দখল করার আগে স্যানচোং কাউন্টি পার্টি অঞ্চলটিতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই পার্টির নিজস্ব গেরিলা দলের মাধ্যমে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতো। এই গেরিলা দল দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং অঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়। ১৯৫১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রায় ছয়টি গ্রামের ১৩৬ জনকে পাকসিন উপত্যকায় নিয়ে মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। পরদিন ঐ অঞ্চলে অবস্থানরত সবাইকে আশেপাশের বিভিন্ন উপত্যকায় নিয়ে যাওয়া হয়, যাদের পরবর্তীতে গুলি করে মারা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে মৃত বেশিরভাগ মানুষই ছিল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। গণহত্যার সমস্ত আলামত নষ্ট করার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা মৃত ব্যক্তিদের লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলে। এই গণহত্যা প্রসঙ্গে দেশটির তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, "কমিউনিস্টদের উৎখাতের জন্য এটা করা হয়েছে, কোনো নিরপরাধ মানুষ এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।"
জেজু আন্দোলন ও এই আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের প্রয়োগ আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কোরিয়া উপদ্বীপ ভাগ হওয়ার আগে থেকেই জেজু দ্বীপে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয়। ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর ভাগ হওয়ার পর জেজু দ্বীপকে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। দ্বীপের অধিবাসীরা কোনোভাবেই কোরিয়ার এই বিভাগ মেনে নিতে পারেননি। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ যখন দক্ষিণ কোরিয়ায় সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন, তখন জেজু দ্বীপবাসীরা এর প্রতিবাদে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে এই দ্বীপে 'সাউথ কোরিয়া ওয়ার্কার্স পার্টি'র যেসব নেতাকর্মী ছিল, তারা সহিংস আন্দোলন শুরু করে। তাদের প্রধান টার্গেট ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সিংম্যান রি সরকারের অনুগত পুলিশবাহিনী। সরকারের কাছে জেজু দ্বীপের সশস্ত্র আন্দোলনের খবর পৌঁছানোর পর আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সামরিক আইন জারি করা হয়। আন্দোলনকারীরা এতে দমে না গিয়ে সহিংসতা অব্যাহত রাখে। মাত্র দুই মাসের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী জেজু দ্বীপের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এরপর শুরু হয় ধরপাকড় ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী ও আন্দোলনকারীদের সহিংসতায় প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ মারা যায়। এছাড়াও প্রাণ বাঁচাতে জাপানে পালিয়ে যায় প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ। ২০০৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার এই গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
মাত্র চারটি গণহত্যার কথা বলা হলেও দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দশটিরও বেশি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এসব গণহত্যায় টার্গেট করা হয় কমিউনিস্ট ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গকে। এছাড়াও অনেক সন্দেহভাজন নিরপরাধ ব্যক্তিকেও সিংম্যান রিং সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করে, যাদের অনেককে পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। একুশ শতকে এসে ধীরে ধীরে দক্ষিণ কোরীয় সরকার এসব ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের কথা স্বীকার করতে শুরু করে। বর্তমানে অনেক গণহত্যার কথাই দক্ষিণ কোরিয়া সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে।
Language: Bangla
Topic: White terror in Korea
Reference:
১) South Korea Jeju Massacre haunts the memories of survivors - UPI