Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন কেন ‘হোয়াইট হাউজ’-এ গোলাবর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন?

১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায়। বরিস ইয়েলৎসিন রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের ২রা জানুয়ারি থেকে তিনি রাশিয়ায় একটি নতুন অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু করেন। নতুন অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়নের শুরুতে সরকারি খাতে ব্যয় সংকোচন এবং নতুন নতুন খাতে বিপুল অঙ্কের করারোপ করা হয়। ফলে, এই সংস্কার কর্মসূচির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়, এবং রুশ জনগণের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন দেশটিতে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেন; image source: Mark Reinstein/Shutterstock

১৯৯২ সালের পুরোটা জুড়ে রাশিয়ার আমলাতন্ত্রের কর্মকর্তা এবং শিল্পপতি থেকে শুরু করে কয়েকজন আঞ্চলিক নেতাও প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির বিরোধিতায় সরব ছিলেন। এদিকে, রাশিয়ার তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার রুটস্কয় প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিকে ‘অর্থনৈতিক গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর তীব্র সমালোচনা করেন। এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত জ্বালানি সমৃদ্ধ দুটো প্রজাতন্ত্র বাসকিরিয়া এবং তাতারস্থান দেশটি থেকে পৃথক হতে স্বাধীনতার ডাক দেয়।

১৯৯১ সালের শেষের দিকে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের নিকট ডিক্রি জারি করাসহ বেশ কিছু বিশেষ ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ইয়েলৎসিনের এসব বিশেষ ক্ষমতার সময়সীমা ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এমন পরিস্থিতিতে, প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার বিশেষ ক্ষমতার সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য দেশটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ ‘সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এবং দেশটির সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী পরিষদ ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এর সদস্যদের প্রতি আহবান জানান। উল্লেখ্য, জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী পরিষদ ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এর সদস্যদের মাধ্যমে ‘সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এর সদস্যরা নির্বাচিত হন। কিন্তু, ইয়েলৎসিনের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে দেশটির পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য প্রেসিডেন্টের বিশেষ ক্ষমতা জারি করার সময়সীমা বৃদ্ধি করার বিরুদ্ধে ছিলেন। এমনকি, ১৯৯২ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত উদার অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের কট্টর সমর্থক ইয়েগোর জাইদারের নিয়োগ প্রত্যয়ন করতে দেশটির সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী পরিষদ ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ অস্বীকৃতি জানায়।

প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন রুশ পার্লামেন্ট স্পিকার রাশলান কাসবুলাতোভ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার রুটস্কয়; image source: Sputnik

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, সেই বছরের ১০ ডিসেম্বর ইয়েলৎসিন দেশটির ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর বিরুদ্ধে সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম ব্যাহত করার অভিযোগ করেন। এমতাবস্থায়, সংকট নিরসনের লক্ষ্যে ১২ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন এবং পার্লামেন্ট স্পিকার রাশলান কাসবুলাতোভ কয়েকটি বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছেন। তারা নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে একটি গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেন, এবং গণভোট আয়োজন হওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের কয়েকটি বিশেষ ক্ষমতা অব্যাহত রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এরপর ১৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন প্রধানমন্ত্রী পদে ভিক্টর চেরনোমারডিনের নাম সুপারিশ করলে রুশ পার্লামেন্ট এই নিয়োগ অনুমোদন করে।

প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্টের মধ্যকার সমঝোতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালের শুরুতে গণভোটের বিষয়বস্তু এবং প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একই বছরের ১০ মার্চ ‘পিপলস ডেপুটিজ’ এর অষ্টম কংগ্রেস শুরু হলে স্পিকার রাশলান কাসবুলাতোভ আক্রমণাত্মক ভাষায় প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি ইয়েলৎসিনের বিরুদ্ধে ‘অসাংবিধানিক পন্থায়’ দায়িত্ব পালনের অভিযোগ তোলেন। পরবর্তীতে মার্চ মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর একটি জরুরি অধিবেশন বসে। সেই অধিবেশনে সদস্যরা সংবিধান সংশোধন করার পক্ষে ভোট দেন, প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের বেশ কয়েকটি ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, এবং নির্ধারিত এপ্রিল মাসের গণভোটের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।

তবে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন পার্লামেন্টের এসব সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এদিকে, দেশটির মুখ্য উপ–প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির শুমেকো ১৯৯৩ সালের ২৫ এপ্রিল পূর্ব নির্ধারিত গণভোটের তারিখ ঘোষণা করেন। এতে প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্টের মধ্যে মুখোমুখি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে, ২০ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া টেলিভিশন ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর সদস্যদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত আমলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টার অভিযোগ তুলে প্রয়োজনে প্রেসিডেন্টের ‘বিশেষ নির্বাহী ক্ষমতা’ প্রয়োগের হুঁশিয়ারি দেন। রাশিয়ান ফেডারেশনের সাংবিধানিক আদালতের চেয়ারম্যান ভ্যালেরি জোরকিন, দেশটির প্রসিকিউটর জেনারেল ভ্যালেন্টিন স্টেপানকোভ, ‘সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এর মুখ্য উপ–চেয়ারম্যান ইউরি ভরোনিন, এবং দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার রুটস্কয় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ইয়েলৎসিনের এই টেলিভিশন ভাষণের নিন্দা জানিয়ে প্রসিডেন্টের বিশেষ নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের হুঁশিয়ারিকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দেন। ‘পিপলস ডেপুটিজ’ এর নবম কংগ্রেসে একই বছরের ২৮ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের বিপক্ষে আনীত অভিশংসন প্রস্তাব অল্পের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে, এই যাত্রায় প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন অভিশংসনের কবল থেকে রক্ষা পান।

প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের জনপ্রিয়তা যাচাই, তার অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থনের বিষয়টি যাচাই–বাছাই করা, আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া বা না হওয়া, এবং ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না– এই চারটি ইস্যুতে সেই বছরের ২৫ এপ্রিল দেশটিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত গণভোটে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির প্রতি অধিকাংশ ভোটারের সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি দেন। এই গণভোটের ফলাফল অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের প্রতি আস্থা রাখেন, এবং তার অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানান। একইসাথে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার দেশটিতে আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও তারা ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমর্থন জানান।

১৯৯৩ সালের ২৯ এপ্রিল দেশটির মন্ত্রী এবং আঞ্চলিক নেতাদের সাথে একটি বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন প্রস্তাবিত সংবিধানের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন। অন্যদিকে, ১লা মে ইয়েলৎসিনের বিরোধী নেতারা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ–সমাবেশের ডাক দিলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। একই বছরের ১২ মে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন খসড়া সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত করতে ১৯৯০ সালের ১২ মে যাত্রা শুরু করা ‘ফেডারেশন কাউন্সিল’ এর বিশেষ অধিবেশন আহবান করেন। এদিকে, ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর সদস্যরা মিলে অন্য একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করেন, এবং প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের প্রস্তাবিত সংবিধানের সাথে এই খসড়া সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোর বণ্টনের বিষয়ে তারতম্য ছিল। সেই বছরের ১২ জুলাই ‘ফেডারেশন কাউন্সিল’ এর সদস্যরা পারস্পরিক আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের খসড়া সংবিধানের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই গৃহীত সংবিধানের আলোকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চালু, এবং একইসাথে বিদ্যমান ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ বিলুপ্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে, ‘সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ সংবিধানের এই বিধান নাকচ করে দেয়, এবং নতুন সংবিধানের ব্যাপারে দেশটির সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী পরিষদ ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে বিবেচিত হবে– এমন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।

১৯৯৩ সালের জুলাই–আগস্ট মাসের দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন অবকাশকালীন ছুটিতে থাকা অবস্থায় পার্লামেন্ট অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির বিপক্ষে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাশ করে। এমনকি, পার্লামেন্ট ইয়েলৎসিনের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তদন্ত শুরু করে। অন্যদিকে, আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন ‘যেকোনো মূল্যে’ পার্লামেন্টের নতুন নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি ১লা সেপ্টেম্বর রুশ ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার রুটস্কয়কে দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে, ৩রা ডিসেম্বর ‘সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ আলেকজান্ডার রুটস্কয়কে বরখাস্তের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে, এবং এই বিষয়ে রাশিয়ান ফেডারেশন এর সাংবিধানিক আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করে। প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন ক্রেমলিনের কার্যালয়ে আলেকজান্ডার রুটস্কয়ের কক্ষ সিলগালা করলে, রুটস্কয়ের জন্য পার্লামেন্ট ভবনে একটি কার্যালয় বরাদ্দ করা হয়।

একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এবং ‘সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন; তবে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এই বিলুপ্তির ঘোষণা ১৯৭৮ সালে প্রণীত রাশিয়ার সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক ছিল। ২২ সেপ্টেম্বর রাশিয়ান ফেডারেশনের সাংবিধানিক আদালত সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনকে অভিশংসিত করা যেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত জানায়। সাংবিধানিক আদালতের এমন সিদ্ধান্তের পর সেদিন দিবাগত রাতভর স্পিকার রাশলান কাসবুলাতোভের সভাপতিত্বে চলা পার্লামেন্ট অধিবেশনে সদস্যরা প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন কর্তৃক ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এবং ‘সুপ্রিম সোভিয়েত অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ বিলুপ্তির সিদ্ধান্তকে বাতিল ঘোষণা করেন। একইসাথে, সেই অধিবেশনে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার রুটস্কয়কে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এদিকে, রুটস্কয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ইয়েলৎসিন সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাভেল গ্রাচেভ, নিরাপত্তামন্ত্রী নিকোরাই গোলাস্কো, এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টর ইয়েরিনকে বরখাস্ত করেন। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে, রাশিয়ায় কার্যত দুটো সরকারের অস্তিত্ব বজায় ছিল।

সেই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ ইয়েলৎসিনকে চূড়ান্তভাবে অভিশংসিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। একইদিনে ইয়েলৎসিন ১৯৯৪ সালের জুন মাস নাগাদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর সদস্যরা ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে একইসাথে প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এর এমন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ২৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের নির্দেশে পার্লামেন্ট ভবনের বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ এবং গরম পানি সরবরাহ-ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পার্লামেন্টের কার্যক্রম ব্যাহত করার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং জীবনযাত্রার মান অবনতির প্রতিবাদে প্রায় দশ হাজার বিক্ষোভকারী রাজধানী মস্কোর রাজপথে প্রতিবাদ জানায়।

আলেকজান্ডার রুটস্কয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র যুবকেরা মস্কো শহরের মেয়রের কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ নেয়; image source: AFP

২৮ সেপ্টেম্বর বিশেষ পুলিশ বাহিনীর সাথে ইয়েলৎসিনের বিরোধীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। একইদিন, রুশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক পার্লামেন্ট ভবন সিলগালা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এদিকে, ১লা অক্টোবর দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায় যে, প্রায় ৬০০ সশস্ত্র যুবক ইয়েলৎসিনের বিরোধীদের সাথে যোগ দিতে রুশ পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে রুশ অর্থোডক্স গির্জার প্যাট্রিয়ার্ক প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করেন, তবে সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। ৩রা অক্টোবর বিকেলে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের বিরোধী সশস্ত্র যুবকেরা রুশ পার্লামেন্ট ভবনের সামনে অবস্থান করা পুলিশ ব্যারিকেড অতিক্রম করে ফেললে, পার্লামেন্ট ভবনে অবস্থান করা আলেকজান্ডার রুটস্কয় সশস্ত্র যুবকদের প্রতি আরও সংঘবদ্ধ হয়ে শহরের মেয়রের কার্যালয় ও দেশটির জাতীয় টেলিভিশন কার্যালয় দখল করতে, এবং ক্রেমলিনে পৌঁছে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনকে অবরুদ্ধ করার জন্য আহবান জানান। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সেদিন বিকাল চারটা নাগাদ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন মস্কোয় জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেন। ৩রা অক্টোবর সন্ধ্যায় শহরের মেয়রের কার্যালয় নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর কর্নেল জেনারেল আলবার্ট মাকাসোভের নেতৃত্বাধীন ইয়েলৎসিনের বিরোধী সশস্ত্র যুবকেরা দেশটির জাতীয় টেলিভিশন কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুগত বিশেষ বাহিনীর সাথে তাদের গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই সংঘাতের ঘটনায় সরকারি তথ্য বিবরণী অনুসারে, প্রায় ৪৬ জন ব্যক্তি নিহত হন, এবং প্রেসিডেন্টের বিরোধী সশস্ত্র যুবকেরা সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

৪ঠা অক্টোবর সকাল আটটা নাগাদ সেনাবাহিনী পার্লামেন্ট ভবন ‘হোয়াইট হাউজ’ এর উপরের তলাগুলো লক্ষ্য করে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করেছিল; image source: TASS

দেশজুড়ে চলমান এমন অচলাবস্থা নিরসনে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের আহবানে সাড়া দিয়ে ৪ঠা অক্টোবর ভোর থেকে রুশ সেনাবাহিনী দেশটির পার্লামেন্ট ভবন ঘেরাও করতে শুরু করে, এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনী প্রথমে পার্লামেন্ট ভবন হিসেবে পরিচিত ‘হোয়াইট হাউজ’ এর উপরের তলাগুলো লক্ষ্য করে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। সেদিন দুপুর নাগাদ সেনাসদস্যরা হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করে প্রতিটি তলায় তল্লাশি শুরু করে, এবং বিকাল নাগাদ রাজপথ থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। হোয়াইট হাউজ এলাকায় চলা সংঘাতের ঘটনায় সরকারি তথ্য বিবরণী অনুসারে, সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ প্রায় ১০১ জন ব্যক্তি নিহত হন। এভাবে, প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের নির্দেশে সার্বিক পরিস্থিতির পুরো নিয়ন্ত্রণ রুশ সেনাবাহিনীর কাছে চলে আসে।

১৯৯৩ সালের ৪ঠা অক্টোবর হোয়াইট হাউজের বাইরে ট্যাংকের উপস্থিতি; image source: Corbis/VCG/Getty Images

হোয়াইট হাউজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকটি ডিক্রি জারি করে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন নিজের ক্ষমতা আরও সুসংহত করেন। একই বছরের ১৫ অক্টোবর বরখাস্তকৃত ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার রুটস্কয় এবং পার্লামেন্ট স্পিকার রাশলান কাসবুলাতোভের বিরুদ্ধে ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে’ অভিযোগ গঠন করা হয়, এবং তাদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে তাদের দায়মুক্তি দিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়।

রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ‘হোয়াইট হাউজ’ এর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর পার্লামেন্ট স্পিকার রাশলান কাসবুলাতোভ (বাম দিক থেকে দ্বিতীয়জন), এবং বরখাস্তকৃত ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার রুটস্কয়কে (ডান দিক থেকে তৃতীয়জন) আটক করে সশস্ত্র প্রহরায় ভবন থেকে বের করা হয়; image source: AFP

১৯৯৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাশিয়াতে সাংবিধানিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত গণভোটের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান অনুমোদন করা হয়, যা ২৫ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। নতুন সংবিধানে রুশ প্রেসিডেন্টের উপর উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা অর্পণ করা হয়, এবং পার্লামেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এই সংবিধান কার্যকরের মাধ্যমে রাশিয়ার সাংবিধানিক সংকট থেকে উত্তরণ ঘটে।

Related Articles