যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর কয়েক বছর পরের ঘটনা। রোমান সাম্রাজ্যের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে এক নতুন গুপ্তসংঘের গুজব। এর কীর্তিকলাপের গুজব শুনে কেউ কেউ তাদের ধরা পড়ামাত্র মৃত্যুদণ্ডের দাবি করে বসেন। কেউ কেউ তাদের প্রতিবেশিদেরও সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করল, এ লোকও হয়তো যোগ দিয়েছে সেই গুপ্তসংঘে। রোমানদের মধ্যে একরকম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।
রোমানদের কানে এলো, এই গুপ্তসংঘের সদস্যরা বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জ্যন্ত অবস্থায় বাচ্চার রক্ত পান করে। এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় খুব গোপনে, সভ্য সমাজের আড়ালে কোনো স্থানে। রোম শহরের নিচের নোংরা ক্যাটাকম্বেও তাদেরকে দেখা যায়।
রোমান সাম্রাজ্যের যেখানেই এ গুজব পৌঁছালো, উত্তেজিত জনগণ তাদেরকে ধরে ফাসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার দাবি জানালো। অভিজাত সমাজ আর রাজনীতিকরাও এদেরকে ধরার জন্য সিনেটের কাছে অনুরোধ করলো। কিন্তু এই গুপ্তসংঘটা কাদের? এই বিকৃত মনের বিদ্রোহীরা কারা? কেউ কেউ বলে এরা খ্রিস্টান!
খ্রিস্টানরা কি আসলেই এরকম ছিল? নাকি এর পুরোটাই ছিল রোমান সিনেটের তৈরি প্রোপাগান্ডা? তাদের তথাকথিত নরখাদকতা কিংবা অযাচারী আচরণ নিয়ে রোমান সিনেটের কোনো মাথাব্যথা ছিল না, তাদের প্রধান মাথাব্যথা ছিল সম্রাটের প্রতি খ্রিস্টানদের আনুগত্য না দেখানো। ফলে রোমান জনগণের মধ্যে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কয়েকজন বক্তাকে দায়িত্ব দেয় রোমান সিনেট, যাতে রোমের সাধারণ জনগণ এই নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট না হয়।
তবে এ ধরনের গালগল্প কিংবা গুজব রোমান সিনেট তৈরি করেনি, বরং স্বয়ং খ্রিস্টানদের কাছ থেকেই তাদের কার্যকলাপের কাহিনী শুনে তারা নিজেদের মতো করে ঘটনা বানিয়েছে।
প্রাচীন রোমে গরীব ঘরের শিশুদের না খাওয়াতে পেরে রোমানরা তাদের বাচ্চাদেরকে বন-জঙ্গলে অথবা অন্য কোথাও ফেলে রেখে আসতো। খ্রিস্টানরা এ বাচ্চাগুলোকে পরবর্তীতে তুলে নিয়ে এসে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে। রোমানদের মাথায় চিন্তা ছিল কেন একজন আরেকজনের বাচ্চাকে পেলেপুষে বড় করবে? তারা এত বাচ্চা দিয়ে করবেইটা কী? ফলে তারা বাচ্চা খেয়ে ফেলার মতো মস্তিষ্কপ্রসূত ঘটনা তৈরি করে আর সাধারণ জনগণের মধ্যে রটিয়ে দেয়। আবার খ্রিস্টানরা একে অপরকে ‘ব্রাদার-সিস্টার’ বলে সম্বোধন করতো। খ্রিস্টানদের গোপন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাইরের কেউ না থাকায় সাধারণ জনগণের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে সেখানে বুঝি ভাই-বোনের অযাচারী হয়। এভাবেই তৈরি হয় অযাচারী সম্পর্কের মতো কন্সপিরেসি থিওরি।
অবিচ্ছেদ্য কন্সপিরেসি থিওরি এবং গুপ্ত সংগঠন
খেয়াল করলে দেখা যাবে, শতকরা ৯৯ ভাগ কন্সপিরেসি থিওরির সাথেই জড়িয়ে আছে কোনো না কোনো গুপ্ত সংগঠন। প্রাচীনকালের সলোমনের গুপ্তধন আগলে বসে রাখা ফ্রিম্যাসন, মধ্যযুগের নাইটস টেম্পলার আর জেসুইট কিংবা এই আধুনিক যুগেও ৯/১১ এর পেছনে কোনো ইহুদি গুপ্ত সংগঠনের হাত আছে বলে মনে করা হয়। এমনকি কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের মতে, পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করার পেছনেও আছে ইলুমিনাটি এবং রথসচাইল্ড পরিবারের হাত। সমতল পৃথিবী দাবি করা ‘ফ্ল্যাট আর্থার’রা যদিও কোনো গোপন সংস্থা নয়, তবুও কন্সপিরেসি থিওরি দাঁড় করানো অনুসারীরা সংস্থার সদস্য তো বটে।
এই ধারাবাহিকে আমরা চেষ্টা করবো কন্সপিরেসি থিওরি আর এর পেছনে থাকা গুপ্তসংঘের আসল চেহারা খুঁজে বের করতে, গালগল্প আর গুজবে ভরা কন্সপিরেসিগুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে বিশ্লেষণ করবো গুপ্তসংঘগুলোর আসল উদ্দেশ্য এবং এর প্রকৃত ইতিহাস।
তবে তার আগে কন্সপিরেসি থিওরিতে মানুষ কেন বিশ্বাস করে, কীভাবে এবং কেন তৈরি করা হয় এসব তত্ত্ব এবং মস্তিষ্কপ্রসূত এসব তত্ত্ব থেকে কীভাবে আসল তথ্য বের করা যায় তা নিয়েই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
কন্সপিরেসি থিওরির বিশ্বে বসবাস
কন্সপিরেসি থিওরির মাধ্যমে সমাজ আর বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ করার জনপ্রিয়তা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বলতে গেলে একেবারে নতুন। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব থেকেই মূলত এর উত্থান, আর শেষ ৪০ বছরে কন্সপিরেসি থিওরির পরিমাণ আর জনপ্রিয়তা আকাশসীমায় পৌঁছে গেছে। যোগাযোগ মাধ্যমের অসাধারণ উন্নতি আর সাম্প্রতিক সময়ের ইলেকট্রনিক আর সোশ্যাল মিডিয়াও এর অন্যতম প্রধান কারণ।
কন্সপিরেসি থিওরি জিনিসটা কী আসলে? সমাজ আর বিশ্বের দৈনন্দিন ঘটনা-দুর্ঘটনাকে খালি চোখে না দেখে, সাধারণ কিছু মনে না করে, বরং এর পেছনে আরো গোপন কিছু রয়েছে, কোনো হীন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই কাজ করা হয়েছে, এবং এই হীন উদ্দেশ্যটা কী এবং এর পেছনে কারা আছে তা খুঁজে বের করাকেই এক বাক্যে কন্সপিরেসি থিওরি বলা যায়।
কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাসীরা মনে করে, পৃথিবীর সব ঘটনার পেছনেই কোনো না কোনো কারণ আছে। যেমন: পেপসির লাভের টাকা ট্রান্সকম বেভারেজ নয়, বরং তা যাচ্ছে ইসরায়েলের জায়োনিস্ট ইহুদিদের কাছে। কিংবা সে যে কম্পিউটার ব্যবহার করছে তার কোথাও কোনো মাইক্রোচিপ লাগানো রয়েছে, যার সাহায্যে তার সব ধরনের সাইবার কার্যক্রম পৌঁছে যাচ্ছে গোয়েন্দাদের কাছে। মাইকেল বারকান তার ‘এ কালচার অব কন্সপিরেসি’ বইয়ে কন্সপিরেসিস্টদের চিন্তাভাবনার ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
- কোনো দুর্ঘটনাই আসলে দুর্ঘটনা নয়: পৃথিবীতে যা ঘটছে তা সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত এবং তা বিশাল কোনো পরিকল্পনার অংশ।
- চোখে যা দেখা যাচ্ছে আসলে তা নয়: যে বা যারাই এটা নিয়ন্ত্রণ করছে তারা ছদ্মবেশ ধরে রেখেছে। দিনের বেলায় তাদের চেহারা এক, কিন্তু রাতের অন্ধকারেই তাদের অন্য চেহারা দেখা যাবে।
- সবকিছুই একে অপরের সাথে জড়িত: যেহেতু এসব ঘটনা আগে থেকেই কোনো হীন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করা হয়েছে, সুতরাং সবকিছুই একে অপরের সাথে জড়িত। ‘কাকতালীয়’ বলে কোনো শব্দ নেই। এবং একজন ‘চোখকান খোলা রাখা ব্যক্তি’ কোনো ঘটনা দেখলে এর ধরন, প্যাটার্ন, কাজকর্ম দেখেই বুঝে ফেলতে পারবে যে এর সাথে কোনো গোপন কিছু জড়িত আছে।
কন্সপিরেসি থিওরি নিরীক্ষা
ইন্টারনেট আর বিভিন্ন ট্যাবলয়েডে ঘুরে বেড়ানো কন্সপিরেসি থিওরিগুলোতে চোখ বুলালে ঘুরেফিরে একই জিনিস আপনার চোখে পড়বে। কন্সপিরেসি এনসাইক্লোপিডিয়ার লেখক টম বার্নেটের মতে,
কন্সপিরেসি থিওরিগুলোকে বলা যায় প্রাচীন উপকথার একপ্রকার উন্নত সংস্করণ, যেখানে অলিম্পাস আর ভ্যালহাল্লার দেবতারা রূপ নিয়েছে এলিয়েন এবং ওয়াশিংটন-বাকিংহাম প্রাসাদে বসে থাকা ইলুমিনাটি সদস্যতে।
কন্সপিরেসি থিওরি আর গুপ্তসংগঠন নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে যে, সবগুলো থিওরিই এসেছে হাতেগোনা কিছু মূল সূত্র থেকে, আর এ ঘটনাগুলোই বারবার ঘুরেফিরে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। একটা উদাহরণ দেখা যাক।
১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল। জন উইলকস বুথের রিভলবারের গুলিতে থিয়েটারে লাশ হয়ে পড়ে আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন কন্সপিরেসি থিওরি। এগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া ‘ন্যাশনাল ট্রেজার ২: দ্য বুক অব সিক্রেটস (২০০৭)’ মুভিতে দেখা যায় যে, জন উইলকস বুথের ডায়েরিতে কিছু পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে, এবং তা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবং বাস্তবেই বুথের ডায়েরিতে কিছু ছেঁড়া পৃষ্ঠা ছিল। বুথের ছেঁড়াপৃষ্ঠার এই তথ্যসূত্রের মূল খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া গেল ‘দ্য লিংকন কন্সপিরেসি’ নামের এক বই। আর অন্যান্য কন্সপিরেসি থিওরির বইগুলোর মতো এই বইয়ের শেষেও পাওয়া গেল অসংখ্য রেফারেন্স আর ফুটনোট, যার সবগুলোই একজন আরেকজনকে নির্দেশ করছে! অর্থাৎ, ১৩ নম্বর বই বলছে এই তথ্য রয়েছে ২৬ নম্বর বইয়ে, ২৬ নম্বর বই বলছে এটি রয়েছে ৩৯ নম্বর বইয়ে, আবার ৩৯ নম্বর বই বলছে এটি রয়েছে ১৩ নম্বর বইয়েই!
যা-ই হোক, লিংকনের খুনের পেছনে থাকা কন্সপিরেসি থিওরিগুলোর মধ্যে সবাই একটি বইকেই মূল তথ্য হিসেবে ধরে নেয়, আর তা হলো ১৯৩০ এর দশকে অটো আইজেনস্খিমেল নামক এক রসায়নবিদের বই। সেখানে লেখক দাবি করেছেন, তিনিই একমাত্র যিনি লিংকনের খুনের পেছনের কারণ ঠিকভাবে বের করতে পেরেছেন। এবং তার এই দাবির পেছনেও অসংখ্য ডকুমেন্ট আর ডায়েরি আছে।
এগুলোর মধ্যে আছে মিলিয়ন ডলারের ‘জন উইলকিস বুথের ডায়েরির ছেঁড়া পৃষ্ঠা’। কিন্তু বইয়ের প্রথমেই লিখে রাখা হয়েছে,
উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ডায়েরির এই ছেঁড়া পৃষ্ঠার হাতের লেখার সাথে আসল ডায়েরির হাতের লেখা মিলিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি।
এর মানেটা হচ্ছে, তারা আসল ডায়েরিটাই দেখেনি, অথচ ডায়েরির ছেঁড়া পৃষ্ঠার উপর ভিত্তি করে একটা বই-ই লিখে ফেলেছে। কন্সপিরেসি থিওরিগুলোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এটিই।
কন্সপিরেসি থিওরির প্রকারভেদ
বিখ্যাত কন্সপিরেসি থিওরি বিশেষজ্ঞ মাইকেল বারকান কন্সপিরেসি থিওরিগুলো ৩ ভাগে ভাগ করেছেন।
- ইভেন্ট কন্সপিরেসি: এই কন্সপিরেসি থিওরিগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আফ্রো-আমেরিকানদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে এইডস ভাইরাস তৈরি কিংবা ‘টিডব্লিউএ ফ্লাইট ৮০০’কে (২৩২ জন ব্যক্তি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে ৩য় সর্বোচ্চ) মিসাইল দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো দাবি।
- সিস্টেমিক কন্সপিরেসি: সিস্টেমিক কন্সপিরেসি থিওরিগুলোকে মাঝারি আকৃতির কন্সপিরেসি থিওরি বলা যায়। এই তত্ত্বগুলোর মতে, ষড়যন্ত্রকারীরা বড় কোনো লক্ষ্যের পেছনে ছুটছে। যেমন: কোনো দেশ কিংবা কোনো অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করা, অথবা পৃথিবীর সব টাকা নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই। স্বাভাবিকভাবেই এসব কন্সপিরেসি থিওরিকে বাস্তব প্রমাণ করতে এর পেছনে থাকা কোনো দল/গুপ্তসংঘের নাম অবধারিতভাবেই চলে আসে। এরকমই বেশ কিছু কন্সপিরেসি থিওরি হলো: ইহুদিরা ব্যাংক, সংবাদমাধ্যম অথবা হলিউড নিয়ন্ত্রণ করছে; ফ্রিম্যাসনরাই মূলত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আর সরকার চালায় কিংবা ইহুদি/ক্যাথলিকরা অন্যান্য ধর্মের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে চায়।
- সুপার কন্সপিরেসি: এ ধরনের কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাসীরা মনে করে পৃথিবীর সবকিছুই একটি বিশাল পরিকল্পনার অংশ। উপরিউক্ত ইভেন্ট কন্সপিরেসি আর সিস্টেমিক কন্সপিরেসি থিওরিগুলো এই বিশাল সুপার কন্সপিরেসিগুলোর সামান্য অংশ। সবকিছুই আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে, এবং তা নিয়ন্ত্রণ করছে একজন কিংবা কয়েকজনের ছোট একটি দল। কন্সপিরেসি সাহিত্যের ভাষায় একে উল্লেখ হয় ‘দ্য গ্র্যান্ড প্লান’ হিসেবে।
This article is in Bangla language. It is about "Why people believe in conspiracy theories?"
References:
1. Secret Societies: Gardiner's Forbidden Knowledge – Philipp Gardiner
2. Conspiracy Theories & Secret Societies For Dummies – Christopher Hodapp & Alice Von Kannon
Feature Image: Edited by Writer