Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিগুরাত: প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় স্বর্গ ও মর্ত্যের সংযোগস্থল

রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের দ্বন্দ্ব চিরায়ত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়াও এই দ্বন্দ্বের বাইরে ছিল না। আজ থেকে প্রায় ৫,০০০ বছর পূর্বে ইউফ্রেটিস (ফোরাত) ও টাইগ্রিস (দিজলা) নদীর মধ্যবর্তী মেসোপটেমিয়ান অঞ্চলে শাসকশ্রেণীর সাথে পুরোহিত শ্রেণীর এরকমই সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব চলছিল। সে সময়ের সমাজে পুরোহিতরা ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। কাজেই মেসোপটেমিয়ার শাসকশ্রেণী নিজেদেরকে পুরোহিতদের চেয়েও ধর্মের প্রতি অধিক নিবেদিত প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে হাতে নিয়েছিলেন এক বিশাল প্রকল্প। ছোট ছোট অসংখ্য ইট দ্বারা তারা তৈরি করেছিলেন পিরামিড সদৃশ সুউচ্চ ধর্মীয় স্থাপনা, জিগুরাত (ziggurat, زقورة)। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার প্রায় সবগুলো প্রধান শহরেই একটি করে জিগুরাত নির্মাত হয়েছিল।

গ্রেট জিগুরাত অফ উর এর মডেল; Image Source: Wikimedia Commons

সবচেয়ে প্রাচীন জিগুরাত নির্মিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দের দিকে। সুমেরীয় শাসকরা জিগুরাত নির্মাণের প্রচলন করলেও পরবর্তীতে ব্যবিলনীয় এবং অ্যাসিরীয় রাজাদের সময় জুড়েও এগুলোর নির্মাণ অব্যাহত ছিল। সর্বশেষ জিগুরাত নির্মিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে। মেসোপটেমিয়া তথা বর্তমান ইরাকের অংশবিশেষ ছাড়াও ইরানের বিভিন্ন স্থানেও জিগুরাত নির্মিত হয়েছিল। কালের বিবর্তনে অধিকাংশ জিগুরাত ধ্বংস হয়ে গেলেও উনবিংশ শতাব্দিতে মাটি খুঁড়ে ইরাক এবং ইরানের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু জিগুরাতের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। এর বাইরেও প্রাচীন ইতিহাসবিদদের এবং সাহিত্যিকদের বর্ণনা থেকেও বিভিন্ন জিগুরাতের বিবরণ, নির্মাণের উদ্দেশ্য, কার্যাবলি প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।

জিগুরাত শব্দটি এসেছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার আক্কাদীয় ভাষার জাকারু বা জাগারু(zaqâru) শব্দ থেকে, যার অর্থ উপরে ওঠানো। জাকারু থেকে পরবর্তীতে জিকুরাতু বা জিগুরাতু (ziqqurratu) শব্দটির উদ্ভব হয়, যার অর্থ উচ্চস্থানে নির্মাণ করা, পর্বতের চূড়া অথবা উপরে উঠে যাওয়া স্থাপনা। আক্ষরিক অর্থেই জিগুরাতগুলো সুউচ্চ স্থাপনা, যাদের অধিকাংশের উচ্চতা ৫০ মিটার বা তার চেয়েও বেশি। সর্বোচ্চ ৯২ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট জিগুরাতেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। জিগুরাতগুলোর সর্বোচ্চ চূড়া সমতল হয়ে থাকে এবং এই চূড়ার উপর একটি করে মন্দির থাকে। ফলে জিগুরাতগুলো মূলত মন্দিরের ভিত্তি অথবা উচ্চস্থানে অবস্থিত মন্দিরে পৌঁছানোর পথ হিসেবে কাজ করে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে গ্রেট জিগুরাত অফ উর; Image Source: copycateffect.blogspot.com

জিগুরাতগুলো দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো হলেও পিরামিডের সাথে এদের বেশ কিছু পার্থক্য আছে। জিগুরাতের অভ্যন্তরে পিরামিডের মতো কোনো প্রকোষ্ঠ নেই। অর্থাৎ জিগুরাতের অভ্যন্তর পিরামিডের মতো ফাঁপা নয়, বরং পর্বতের মতো নিরেট। পিরামিডের মতো জিগুরাতে কোনো মমি সংরক্ষিত নেই। অর্থাৎ জিগুরাত পিরামিডের মতো মৃতদেহ সংরক্ষণের স্থান নয়, বরং মন্দির বা উপাসনালয়। নির্মাণ কৌশলের দিক থেকেও পিরামিডের সাথে জিগুরাতের পার্থক্য আছে। পিরামিডের মতো জিগুরাতের পৃষ্ঠ সমতল বা মসৃণ না, বরং একাধিক ধাপ বিশিষ্ট। পিরামিডের মতো জিগুরাত বিশালাকৃতির প্রস্তরখন্ড দ্বারাও তৈরি করা হয়নি, বরং এগুলো তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট ইট দ্বারা।

জিগুরাতের ভূমি সাধারণত বর্গাকার, আয়তাকার বা উপবৃত্তাকার হয়ে থাকে। অধিকাংশ বর্গাকার জিগুরাতের ভূমির বাহুর দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৫০ মিটার এবং আয়তাকার জিগুরাতের দৈর্ঘ্য ৫০ মিটারের কাছাকাছি ও প্রস্থ ৪০ মিটারের কাছাকাছি হয়ে থাকে। যদিও বর্তমানে কোনো জিগুরাতই সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত অক্ষত নেই, কিন্তু বিভিন্ন বিবরণ থেকে সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ সাত ধাপ বিশিষ্ট জিগুরাতের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রতিটি ধাপের ক্ষেত্রফল তার নিম্মবর্তী ধাপের ক্ষেত্রফলের চেয়ে কম। প্রতিটি ধাপের ঢালু দেয়াল এবং উপরস্থ চত্বর বিভিন্ন গাছপালা দ্বারা সজ্জিত থাকত। মেসোপটেমিয়ার জিগুরাতগুলোর প্রতিটি ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপে পৌঁছানোর জন্য একাধিক সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ইরানের জিগুরাতগুলোতে নিচ থেকে চূড়া পর্যন্ত একটিমাত্র সর্পিলাকার র‌্যাম্প বা ক্রমশ ঢালু পথ ছিল।

গ্রেট জিগুরাত অফ উর; Image Source: 1milyarbilgi.com
গ্রেট জিগুরাত অফ উর; Image Source: khanacademy.com

জিগুরাতগুলো মূলত বিশাল মন্দির কমপ্লেক্সের কেন্দ্রে অবস্থিত হতো। এরকম একটি কমপ্লেক্সে শত শত ভবন থাকত। এখান থেকেই নগররাষ্ট্রের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। কমপ্লেক্সে অবস্থিত মন্দিরগুলোতে কয়েক শত থেকে কয়েক হাজার কর্মচারী নিযুক্ত থাকত। জিগুরাত হতো এসব কমপ্লেক্সের, তথা পুরো শহরের প্রধান আকর্ষণ। তবে মেসোপটেমিয়ান জিগুরাতগুলো সাধারণ নাগরিকদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। শুধুমাত্র পুরোহিতরাই এতে উঠতে পারত। কারণ জিগুরাতের সর্বোচ্চ চূড়ায় যে মন্দিরটি থাকত, সেটিকে উৎসর্গ করা হতো নগরের অভিভাবক দেবতার প্রতি। আশা করা হতো, দেবতা সেখানে এসে বসবাস করবেন, ফলে নগরের কল্যাণ বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ জিগুরাত জনসাধারণের প্রার্থনার স্থান ছিল না, এটি ছিল দেবতার অস্থায়ী বাসভবন।

জিগুরাতকে বিবেচনা করা হতো স্বর্গ এবং মর্ত্যের সংযোগস্থল হিসেবে, যেখানে দেবতা স্বর্গ থেকে এসে অবস্থান গ্রহণ করবেন এবং পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন। কিছু কিছু জিগুরাতের নাম থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ ব্যবিলনের ইতেমেনানকি জিগুরাতটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে স্বর্গ এবং মর্ত্যের ভিত্তি। কিছু কিছু জিগুরাতকে সুমেরীয়রা সৃষ্টিজগতের কেন্দ্র হিসেবেও বিবেচনা করত। এছাড়াও জিগুরাতের অন্যান্য কিছু তাৎপর্যও ছিল। যেমন- এর সাতটি ধাপ দ্বারা স্বর্গের সাতটি স্তরকে নির্দেশ করা হতো। অনেকে অবশ্য সাতটি ধাপ দ্বারা সাতটি গ্রহ, সপ্তাহের সাতটি দিন, কিংবা সাতটি রং বোঝানো হতো বলেও মনে করেন।

চোগা জানবিল জিগুরাত; Image Source: charismaticplanet.com
চোগা জানবিল জিগুরাত; Image Source: insearchoflostplaces.com

গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরাটোডাসের বর্ণনা অনুযায়ী, জিগুরাতের সর্বোচ্চ চূড়ায় একটি প্রশস্ত মন্দির থাকত, যার অভ্যন্তরে অস্বাভাবিক আকারের এবং মহামূল্যবান অলঙ্কার খচিত একটি পালঙ্ক থাকত। পালঙ্কের পাশেই থাকত স্বর্ণের তৈরি একটি টেবিল। মন্দিরের অভ্যন্তরে কোনো মূর্তি থাকত না। মন্দিরে কোনো প্রহরী অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিও থাকত না। থাকত শুধু দেবতাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নগরীর নারীদের মধ্য থেকে বাছাই করা একজন নারী। এছাড়াও জিগুরাতের সর্বনিম্ন ধাপে একটি রান্নাঘরও থাকত, যেখানে পুরোহিতরা দেবতার জন্য আহার প্রস্তুত করতেন।

জিগুরাতগুলো নির্মিত হতো ইট দ্বারা। প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা মাটিকে পবিত্রতম মৌলিক উপাদান হিসবে বিবেচনা করত। সে কারণেই স্বর্গের কাছাকাছি পৌঁছানোর স্তম্ভ তৈরির উপাদান হিসেবে তারা মাটির তৈরি ইটকে বেছে নিয়েছিল। জিগুরাতের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হতো সূর্যের তাপে পোড়া মাটির ইট, আর বাইরের শক্ত দেয়াল এবং সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো আগুনে পোড়া মাটির ইট। একেকটি জিগুরাত তৈরিতে কোটি কোটি ইট ব্যবহৃত হতো। কিছু কিছু জিগুরাতের বিভিন্ন ধাপের দেয়াল বিভিন্ন রংয়ের হতো। বিশেষ করে সর্বোচ্চ চূড়ার মন্দিরটি ভিন্ন রংয়ের ইট দ্বারা নির্মিত হতো।

চোগা জানবিল জিগুরাতের মডেল; Image Source: iranroyalholidays.com

বর্তমানে খুব কম সংখ্যক জিগুরাতই তার অবিকৃত আকৃতি ধরে রাখতে পেরেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রচেষ্টায় সন্ধান পাওয়া জিগুরাতগুলোর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় এবং সংরক্ষিত জিগুরাতগুলোর একটি হচ্ছে ইরানের চোগা জানবিল (Chogha Zanbil) জিগুরাত। খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০ সালে নির্মিত এই জিগুরাতটির আসল নাম ছিল দুর উনতাশ (Dur Untash)। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০ সালে বহিঃশত্রুর আক্রমণে এটি ধ্বংস হয়ে যায়। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১০৫ মিটার এবং উচ্চতা ৫৩ মিটার, যদিও সম্পূর্ণ উচ্চতা এখন আর অবশিষ্ট নেই। জিগুরাতটির প্রতি ১০ সারি ইটের পর একসারি ইটের গায়ে প্রাচীন ইলামাইট ভাষায় সতর্কবাণী খোদাই করা আছে যে, যদি কেউ এর কোনো ক্ষতি সাধন করে, তাহলে তার উপর অভিশাপ বর্ষিত হবে।

আরেকটি সংরক্ষিত জিগুরাত হলো ইরাকের দি কার প্রদেশে অবস্থিত দ্য গ্রেট জিগুরাত অফ উর। ২,১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত জিগুরাতটির দৈর্ঘ্য ৬৪ মিটার, প্রস্থ ৪৬ মিটার এবং উচ্চতা প্রায় ৩০ মিটার। বর্তমানে অবশ্য এর উচ্চতা মাত্র এক ধাপ পর্যন্ত অবশিষ্ট আছে, কিন্তু ভূমির ক্ষেত্রফল, জিগুরাতের গঠন, ইটের সংখ্যা প্রভৃতি হিসেব করে এই উচ্চতা নির্ণয় করা হয়েছে। জিগুরাতটি নির্মাণ করা হয়েছিল সুমেরীয়দের চন্দ্রদেবতা নান্নাকে উৎসর্গ করে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে নিকটবর্তী ফোরাত নদী দিক পরিবর্তন করায় উর শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং জিগুরাত অফ উরও ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্তিকরা এটি আবিষ্কার করেন।

দ্য গ্রেট জিগুরাত অফ উরের ইটগুলোর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩০ সেন্টিমিটার, উচ্চতা ৯.৫ সেন্টিমিটার এবং ওজন প্রায় ১৫ কেজি। জিগুরাতটির শুধুমাত্র প্রথম ধাপের বহিঃস্থ দেয়াল নির্মাণেই প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার ইট ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে এর মাত্র তিনটি ধাপ অবশিষ্ট আছে। ১৯৮৫ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন জিগুরাতটির সর্বনিম্ন ধাপের দেয়াল এবং সিঁড়িগুলো সংস্কার করেছিলেন। সে সময় কিছু কিছু ইটের স্থানে তিনি নিজের নাম খোদাই করা ইট ব্যবহার করেছিলেন। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের সময় তার নির্দেশে কিছু মিগ যুদ্ধবিমান জিগুরাতটির পাশে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এই আশায় যে, আমেরিকানরা হয়তো এখানে বিমান হামলা করবে না। কিন্তু তার অনুমান ভুল ছিল, বিমানগুলো মার্কিন হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। তবে যুদ্ধে জিগুরাতটির সামান্য ক্ষতি হলেও এটি এখনও প্রায় আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।

ফিচার ইমেজ- ancient-origins.net

Related Articles