এসডিজির প্রাথমিক পাঠ ও অগ্রগতির উপাখ্যান | পর্ব-১

যে সময় আমি, আপনি কিংবা আমাদের চারপাশের মানুষেরা পেট পুরে খেতে পারছেন, থাকছেন আয়েশী জীবনের বৃত্তে, ঠিক সেসময়ই পৃথিবীর নানা প্রান্তে অনেক মানুষ খাবারের অভাবে, বাসস্থানের অপ্রতুলতায় জীবনের চরম বাস্তবতার সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু এমন যদি হয়, দারিদ্র্য বলে কিছুই থাকবে না পৃথিবীতে। কেমন হবে যদি মানুষ তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে বেঁচে থাকার সুযোগ পায় এই পৃথিবীর বুকে? দারিদ্র্যহীন, ক্ষুধাহীন, সুস্বাস্থ্য কিংবা গুণগত শিক্ষার মতো মৌলিক এবং সমসাময়িক অধিকার অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘের চলমান এক উদ্যোগের নাম ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’ বা এসডিজি।

টেকসই উন্নয়নের ধারণা 

টেকসই উন্নয়ন বলতে সাধারণত এমন একটি ব্যাপারকে বোঝানো হয় যেটি ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতার সঙ্গে আপোষ না করে বর্তমানের চাহিদা মেটানোতে জোর দেওয়া হয়। টেকসই উন্নয়নকে দেখা হয় দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক উন্নয়নের পথপ্রদর্শক নীতি হিসেবে। সাধারণত, তিনটি স্তম্ভের উপর টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো হলো- অর্থনৈতিক উন্নয়ন,  সামাজিক উন্নয়ন, এবং পরিবেশের সুরক্ষা। টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি রচিত হয় ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে, ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত একটি সম্মেলনে। তবে এই সম্পর্কে আলোচনার শুরু স্টকহোমে, ১৯৭২ সালে, জাতিসংঘের মানব পরিবেশ বিষয়ক একটি সম্মেলনে। 

জাতিসংঘের মানব পরিবেশ বিষয়ক একটি সম্মেলনে; Image Courtesy: UN photo

পরিবেশগত সীমার মধ্যে বাস করাটা টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নীতি। এটি না করার একটি প্রভাব হলো জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু শুধু পরিবেশকেন্দ্রিক নয়, বরং এর কার্যক্ষেত্র আরও ব্যাপক। এটি একটি শক্তিশালী, সুস্থ এবং ন্যায্য সমাজ নিশ্চিত করার বিষয়ে কাজ করে। বিদ্যমান এবং ভবিষ্যত সম্প্রদায়ের সকল মানুষের বৈচিত্র্যময় চাহিদা মেটানো, ব্যক্তিগত সুস্থতা, সামাজিক সংহতি, এবং অন্তর্ভুক্তি প্রচার করা এবং সমান সুযোগ তৈরি করা টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য।

এমডিজি থেকে এসডিজির গল্পে 

২০০০ সালে জাতিসংঘের ১৮৯টি সদস্য দেশ সংস্থাটির সদর দপ্তরে ঐতিহাসিক এক উদ্যোগের বিষয়ে সিদ্ধান্তে সম্মত হন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (এমডিজি) নামক এই উদ্যোগের মাধ্যমে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য আটটি লক্ষ্য স্থির করেন তারা। এই লক্ষ্য পূরণে দেশগুলো চরম দারিদ্র্য হ্রাসকরণ থেকে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, শিশু মৃত্যুহার কমানো, টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণ, এবং এইডস ও অন্যান্য রোগ দূরীকরণে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে। প্রায় সকল দেশই এমডিজি অর্জনে বেশ সাফল্যের পরিচয় দেয়। এমডিজির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে যেখানে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ১৯০ কোটি, সেখানে ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৮৩ কোটিতে। ১৯৯০ সালের তুলনায় উন্নয়নশীল অঞ্চলে অপুষ্টির শিকার মানুষের অনুপাত প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়বিমুখ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল ১০ কোটি। এমডিজির শেষ বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এই সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেকে (৫ কোটি ৭০ লক্ষ) নেমে এসেছে। এমন করে আটটি লক্ষ্যের প্রতিটিতেই অভাবনীয় সাফল্যের দেখা মিলেছে দেশে দেশে। প্রতিবেদনে মত দেওয়া হয়, লক্ষ্য ঠিক করে সেটি পূরণে এগিয়ে যাওয়া সাফল্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। 

এমডিজিতে আটটি লক্ষ্য ছিল; Image Source : mdg monitor 

 

এমডিজি সময়সীমা চলার মধ্যেই ২০১২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে জাতিসংঘের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রিও+২০ নামে পরিচিত এই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো দুটি প্রধান বিষয়ের উপর আলোচনা করে। প্রথমটি, টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য কীভাবে একটি সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলা যায় এবং জনগণকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা যায় তা চিন্তা করা। একইসাথে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তাদের উন্নয়নের একটি সবুজ পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করা। দ্বিতীয়টি, কীভাবে টেকসই উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমন্বয় উন্নত করা যায়। সম্মেলনে দেশগুলো টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করে। 

সেসময় এমডিজি বাস্তবায়নের সময়সীমা চলমান থাকায় টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায়নি জাতিসংঘ। এটি নিয়ে আরো আলোচনার সুযোগ রাখা হয়। পরের তিন বছর এই বিষয়ে আলোচনা, জরিপ এবং সম্মেলন চলতে থাকে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সম্মেলনে বসে সংস্থাটির ১৯৩ সদস্য দেশ। ঠিক করা হয় ১৭টি অভীষ্ট এবং ১৬৯টি লক্ষ্য। সম্মেলন থেকে আসা সিদ্ধান্তে জানানো হয়, সদস্য দেশগুলো একটি দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ এবং অভাবমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখে, যেখানে সমস্ত জীবন উন্নতি করতে পারে। জাতিসংঘ ভয় ও সহিংসতামুক্ত একটি বিশ্ব কল্পনা করে।

এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে সার্বজনীন স্বাক্ষরতার সুযোগ থাকা নিশ্চিত করতে চায় সংস্থাটি। সংস্থাটি এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখে যেখানে সকল স্তরে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতা নিশ্চিত করা হবে। নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের মানবাধিকার সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতি পুনর্নিশ্চিত এবং উন্নত স্বাস্থ্যবিধির সুযোগ রাখার পক্ষেও দৃঢ় সংকল্পের কথা জানায় সংস্থাটি। জাতিসংঘ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মাধ্যমে এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন পূরণে অংশীদার হতে চায় যেখানে মানুষের বাসস্থান হবে নিরাপদ, স্থিতিস্থাপক ও টেকসই, এবং যেখানে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই শক্তির সার্বজনীন অধিকার থাকবে। 

অভীষ্ট ১: দারিদ্র্যমুক্ত এক পৃথিবীর আশা

আমরা সকলেই স্বপ্ন দেখি দারিদ্র্যমুক্ত এক পৃথিবীর। আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথরেখা হিসেবে কাজ করছে এসডিজি-র প্রথম অভীষ্ট। এই অভীষ্টের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সর্বত্র সকল প্রকার দারিদ্র্যের অবসান’। এই অভীষ্ট অর্জনে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পাঁচটি লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।

Image Source: বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন
  • প্রথমত, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য দৈনন্দিন মাথাপিছু আয় ১.২৫ ডলারের কম অনুযায়ী বর্তমানে পরিমাপকৃত চরম দারিদ্র্যের সম্পূর্ণ অবসান করা।

  • দ্বিতীয়ত, দেশগুলো তাদের জাতীয় সংজ্ঞানুযায়ী অন্তর্ভুক্ত সকল বয়সের দরিদ্র নারী, পুরুষ ও শিশুর সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেকে নামিয়ে আনা।

  • তৃতীয়ত, ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার নিশ্চয়তা বিধানসহ সকলের জন্য জাতীয়ভাবে উপযুক্ত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ ও সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপসমূহের বাস্তবায়ন, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে এর আওতায় নিয়ে আসা।

  • চতুর্থত, ২০৩০ সালের মধ্যে সকল নারী ও পুরুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অনুকূলে অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মৌলিক সেবা-সুবিধা, জমি ও অন্যান্য সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, উত্তরাধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদ, ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা, উপযুক্ত নতুন প্রযুক্তি ও আর্থিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করা।

  • পঞ্চমত,২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্র ও নাজুক জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা সৃষ্টি এবং জলবায়ু সম্পর্কিত চরম ঘটনাবলী ও অন্যান্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত অভিঘাত ও দুর্যোগে তাদের আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনা।

দারিদ্র্যমুক্তির জন্য নির্ধারিত অভীষ্ট ও তার অধীনে থাকা লক্ষ্যগুলো পূরণে সকল দেশই কম-বেশি কাজ করে যাচ্ছে। সফলতা যে আসছিল সেটি স্পষ্ট পরিসংখ্যানেই। এসডিজি সময়সীমা শুরুর বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে বৈশ্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ১০.১ শতাংশ। সেসময় বিশ্বব্যাপী চরম দরিদ্রতায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৪ কোটি। বছরচারেক পর (২০১৯) চরম দারিদ্র্যের হার ৮.৩ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার পর সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছিল ৬৪ কোটিতে। তবে এই অগ্রযাত্রার মিছিলে বাধা হয়ে এসেছে মহামারি। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে দারিদ্র্যের হার ফের বৃদ্ধি পেতে দেখেছে বিশ্ব। সেসময় এই হার দাঁড়ায় ৯.২ শতাংশে।

দারিদ্র্য হ্রাসের সংগ্রামে বাধা যখন কোভিড; Image Source : UN

জাতিসংঘ প্রতি বছরই এসডিজির অগ্রগতি বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ বছর প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার ৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি। তবুও এই হার কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় বেশি। দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির পেছনে কোভিড ছাড়াও সংস্থাটি দায়ী করছে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধকে। 

কোভিড-পূর্ব সময়ে জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৮ কোটি। সংস্থাটি আশঙ্কা করছে, উভয় সংকটের ফলে এ বছর (২০২২) দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি থেকে সাড়ে নয় কোটি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এসডিজির প্রথম অভীষ্ট অর্জনের পথে সামনের দিনগুলোয় কোভিড এবং ইউক্রেন সংকট কতটা ভোগায় সেটিই এখন দেখার বিষয়।

This feature mainly provides an introduction to the Sustainable Development Goals (SDGs). At the same time, the progress of SDG implementation was also discussed. Sources are hyperlinked within the feature.

Feature Image: sdg zone

Related Articles