Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বীরশ্রেষ্ঠ আর্টিফিসার রুহুল আমিন

সন্তর্পণে পরবর্তী লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে জলজ কনভয়। মিত্রবাহিনীর ভুল বোঝাবুঝিতে অকস্মাৎ আকাশ থেকে শুরু হল গোলাবর্ষণ! জাহাজ বাঁচাতে করতে হবে যুদ্ধ কিন্তু নির্দেশ এলো জাহাজ ত্যাগের। সবেমাত্র জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এই জাহাজটি তখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সে চিন্তা মাথায় নিয়ে জাহাজ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন বাংলার এক সাহসী সন্তান…

সেই অসমসাহসী যোদ্ধার ওপর আলোকপাত করেই আজকের এই লেখনী। তিনি আর কেউ নন, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন। তাঁর অপার বীরত্ব ও সাহসের উপাখ্যান বাংলাদেশে চিরদিন অমর হয়ে থাকবে।

1

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১৯৩৪ সালের (মতান্তরে ১৯৩৫) ১লা ফেব্রুয়ারি নোয়াখালি জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার বাঘপাঁচড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামাতা হলেন মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারী এবং জোলেখা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। প্রথমে তিনি স্থানীয় মক্তবে কিছুদিন পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে স্থানীয় বাঘপাঁচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি আমিষাপাড়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকে (মতান্তরে সোনাইমুড়ি হাইস্কুল থেকে) ১৯৪৯ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। এর মাঝে কিছুদিন তিনি স্থানীয় খবরের কাগজেও কাজ করেছেন।

১৯৫৩ সালে তিনি জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন এবং করাচি চলে যান। প্রথমে করাচির নিকটবর্তী আরব সাগরের মানোরা দ্বীপের পাকিস্তানি নৌঘাঁটিতে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে করাচির পিএনএস কারসাজে (নৌবাহিনীর কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হত এখানে) যোগ দেন তিনি এবং পরবর্তীতে পিএনএস বাবর, পিএনএস খাইবার ও পিএনএস তুঘরিলেও দক্ষভাবে কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন এবং ১৯৬৫ সালে মেকানিক্যাল কোর্সের জন্য মনোনীত হন। কোর্সটি সম্পন্ন করার পর তিনি ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার-১ পদে উপনীত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি চট্টগ্রামের পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে বদলী হন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত
তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

2

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন

মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে রুহুল আমিন আর্টিফিসার-১ হিসেবে কর্মরত ছিলেন বখতিয়ার নৌঘাঁটির পিএনএস কুমিল্লা গানবোটে। ২৫শে মার্চের কালরাত্রে তিনি সেই কাজে অব্যাহতি দিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান এবং সেখানে ছাত্র, জনতা, সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর লোক ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য একত্রিত করতে থাকেন এবং প্রশিক্ষণ দেন। এরপর প্রায় ৫০০ প্রশিক্ষিত মানুষসহ এপ্রিল মাসে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা গিয়ে মেজর কে এম সফিউল্লাহর অধীনে তিন নং সেক্টরে যোগ দেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ নং সেক্টরের অধীনেই তিনি নানান স্থল অপারেশনে অংশ নেন। পরবর্তীতে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে তিনিসহ সকল নৌবাহিনীতে কাজ করা কর্মকর্তারা আগরতলায় সমবেত হন এবং সেখানেই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি প্রাথমিক কাঠামো তৈরি হয়, গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের ১০ নং সেক্টর- নৌবাহিনী সেক্টর। পরবর্তীতে তারা কলকাতায় যান। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে কলকাতার গার্ডেনরিচ ডকইয়ার্ডে দুটি টাগবোট উপহার দেয়া হয়। এরপর কলকাতা গার্ডেনরিচ ন্যাভাল ওয়ার্কশপে সেগুলোতে ২ টি করে বাফার গান ও মাইন পড সংযোজন করা হয় এবং ব্রিটিশ ধরণের ৪টি ৫০০ পাউন্ড ওজনের মার্কমাইন বহনের উপযোগী গানবোটে রুপান্তরিত করা হয়। সেই গানবোট দুটির নামকরণ করা হয়- পদ্মা এবং পলাশ। রুহুল আমিন পলাশ এর ইঞ্জিনরুমে আর্টিফিসারের দায়িত্ব পান।

3

মাজার কমপ্লেক্সের নামফলক

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোরে পাকিস্তান সেনানিবাসের পতন হয় এবং পদ্মা, পলাশ ও মিত্রবাহিনীর গানবোট পাভেল মংলা বন্দরের পাকিস্তান নৌঘাঁটি পিএনএস তীতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে ভারতের হলদিয়া নৌঘাঁটি থেকে যাত্রা প্রারম্ভ করে। ৮ ডিসেম্বর তাদের সাথে সুন্দরবনের আড়াই বাঁকি থেকে বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) এর টহল জাহাজ চিত্রাঙ্গদাও যোগ দেয়। কোন ধরণের বাধা ছাড়াই ৯ ডিসেম্বর তারা হিরণ পয়েন্টে পৌঁছান।

১০ ডিসেম্বর ভোরে তারা মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন, ভোর ৭ টায় পৌঁছানোর পর টহল জাহাজ চিত্রাঙ্গদা সেখানেই পজিশন নেয়, কনভয়ের বাকি অংশ খুলনা শিপইয়ার্ড দখলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। মধ্যদুপুর নাগাদ খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌঁছালে রূপসা নদীতে হঠাত করে উপরে কয়েকটি বোমারু বিমান দেখা যায়। শত্রুপক্ষের বিমান ভেবে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হলে অভিযানের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ জানান যে সেগুলো ভারতীয় বিমান বিধায় গুলি ছোঁড়া যাবে না। কিন্তু আচমকা বিমানগুলো নিচে নেমে আসে এবং ভুলবশত পাকিস্তানি নৌবহর মনে করে গোলাবৃষ্টি শুরু করে। প্রথমে পদ্মায় এবং পরে পলাশে গোলা পড়ে। পদ্মার ইঞ্জিনরুম ধ্বংস হয়ে অনেক নাবিক ও যোদ্ধা হতাহত হন এবং পলাশে পড়া গোলায় এর শিপ ম্যাগাজিন বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে ও গানবোটটি ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। গোলার আঘাতে শহীদ হন বীরবিক্রম মহিবুল্লাহ।

এই অবস্থা দেখে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরি নাবিক ও সবাইকে জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন, এতে ক্ষিপ্ত হন রুহুল আমিন। তিনি সবাইকে বিমানের দিকে গুলি ছোঁড়ার আহ্বান জানান এবং জাহাজ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে ইঞ্জিনরুমে ফেরত আসেন। কিন্তু অভিযানপ্রধানের নির্দেশ অমান্য করে বিমানের দিকে কোন গুলি ছোঁড়া হয়নি। এদিকে আগুন নেভাবার ও জাহাজটিকে কর্মক্ষম রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। তিনি অন্য ক্রুদের বলেন, “গানবোটটি বাঁচানো না গেলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকেও রক্ষা করা যাবে না, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।” ক্রুদের বারবার জাহাজ ত্যাগের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি জাহাজেই রয়ে যান। অন্যান্য ক্রু ও নাবিকরা জাহাজ ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরপর বিমান থেকে গোলা এসে ইঞ্জিনরুমের ওপর পড়ে তা ইঞ্জিন বিকল করে আগুন ধরিয়ে দেয়- ডান হাত উড়ে যায় রুহুল আমিনের, তলিয়ে যায় পলাশ। এই আহত অবস্থা নিয়েও তিনি জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অভূতপূর্ব সাহস, উদ্যম ও প্রাণশক্তির পরিচয় দিয়ে সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছান। কিন্তু তীরে আগে থেকেই অপেক্ষমান ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর ঘৃণ্য রাজাকারেরা। আহত, রক্তাক্ত বীর রুহুল আমিনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত করে তারা, শহীদ হন দেশপ্রেমিক প্রচন্ড তেজস্বী এই সাহসী যোদ্ধা। 

4

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সমাধি

রূপসার পাড়ে তার মৃতদেহ পড়ে ছিলো কিছুদিন। এরপর স্থানীয় গ্রামবাসী তার মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং রূপসা নদীর তীরে বাগমারা গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত সরকারি গেজেটের নোটিফিকেশন অনুযায়ী মোহাম্মদ রুহুল আমিনকে মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার স্মরণে এবং সম্মানে তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে আমিননগর রাখা হয়েছে এবং রো রো ফেরির নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া নোয়াখালি জেলা পরিষদ কর্তৃক বাষট্টি লাখ টাকা ব্যয়ে রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার নির্মিত হয়েছে তার পরিবারের দান করা কুড়ি শতাংশ জমির উপর। কক্সবাজারের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামের নামকরণ তার নামানুসারেই করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস রুহুল আমিনের নামকরণও তার নামে করা হয়েছে।

তিন কন্যা ও এক পুত্রসন্তান রেখে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন শহীদ হন, দারিদ্র্য-দৈন্যের মাঝেই তার ছেলে শওকত আলীর বাস। বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ তার বিবাহিত বোনেরা নেন বিধায় দিনমজুর ও ভ্যানচালকের কাজ করা শওকত আলীর নিজের ক্ষুদ্র আয়ে পরিবার চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে নদী ভাঙনের দরুণ তার সমাধি ও স্মৃতিস্তম্ভটিও ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে, স্থানীয় লোকজন ও তার আত্মীয়-স্বজনের দাবি তার দেহাবশেষ তুলে তার জন্মস্থানে নিয়ে যাওয়া হোক।

6

বিএনএস রুহুল আমিন: বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ

বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন এক সুবর্ণখচিত জ্বলজ্বলে নামফলক। যে মনোবল ও সাহসিকতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন তা সর্বদা প্রেরণা, সম্মান, ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধার কালিতে আঁকা থাকবে বাংলার ক্যানভাসে, বাঙালির হৃদয়ে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে তার নাম ও স্মৃতি থাকবে চির অম্লান।

5

এখানেই শায়িত আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন

This article is in Bangla language. It's about bir sreshtha ruhul amin, great hero of bangladesh liberation war.

References:

1. http://bangladeshcontinual.blogspot.com/2011/07/bir-sreshtho-mohammad-ruhul-amin.html

2. http://archive.sahos24.com/english/2014/12/10/2249

3. http://www.dhakatribune.com/bangladesh/2016/12/11/bir-shreshtha-ruhul-amin-remembered/

4. http://www.thedailystar.net/news-detail-260565

5. http://offroadbangladesh.com/places/bir-srestho-ruhul-amin-cemetery-complex/

Featured Image: bagagist.com

Related Articles