Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জয় বাংলা: পাকিস্তানের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া স্লোগানের ইতিহাস

অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাঙ্গালী বরাবরই এগিয়ে ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বাঙ্গালীর কন্ঠ ছিল স্লোগানমুখর। উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী গণঅভুত্থ্যানের মঞ্চে বাঙ্গালীর সংগ্রামী চরিত্র আরেকবার নতুন করে জন্ম নেয়।

পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে বাঙ্গালী ছাত্র ও সাধারণ মানুষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র। ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হতে থাকে তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা‘, পিন্ডি না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা, তুমি কে আমি কে/বাঙ্গালী বাঙ্গালী এ ধরনের স্লোগান। কিন্তু বাঙ্গালীর রক্তে আগুন ধরানো আসল স্লোগান তখনো রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে।

ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছে মুক্তির স্লোগানে; Image source: ournews24.com

পাকিস্তানী শাসকেরা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের এই উত্থানকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। আন্দোলন ঠেকাতে মরিয়া হয়ে বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের সামনে থাকা সৈনিকদের নামে ঠুকে দেয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু এই মামলা বাঙ্গালীকে আরো জাগিয়ে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমানকে করে পরিণত করে জাতীয় বীরে। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী জেল থেকে মুক্তি পাওয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কন্ঠ থেকে যে পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু উপাধির জন্ম হয়েছিল,  ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের জন্মও সেই অগ্নিগর্ভ থেকেই।

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষ্যে সেপ্টম্বরের ১৫ তারিখ থেকেই তিন দিনব্যাপী কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছিল। ১৫ তারিখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির মঞ্চ মধুর ক্যান্টিনে সাধারণ ছাত্র সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সভা চলাকালীন একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমদ চিৎকার করে স্লোগান দিয়ে উঠেন ‘জয় বাংলা’ বলে। ঘটনার আকস্মিকতার রেশ কাটিয়ে উঠে ইকবাল হলের আরেক শিক্ষার্থী চিশতি শাহ হেলালুর রহমানও চিৎকার দিয়ে উঠেন ‘জয় বাংলা’ বলে। মধুর ক্যান্টিনে বসে আকস্মিকভাবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উঠা এই ছাত্ররা হয়তো নিজেরাও জানতো না এই স্লোগান পাকিস্তানের ভিত্তিমূল ভেঙ্গে জন্ম দেবে স্বাধীন বাংলাদেশের।1

জয় বাংলা, পাকিস্তানের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া স্লোগান; Image source: banglanewspost.com

১৫ সেপ্টেম্বরের সেই জয় বাংলা ধীরে ধীরে ছাত্রনেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। মিটিং শেষে অভিবাদন ধ্বনি হিসেবেই ব্যবহার হতে থাকে এটি। ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারী পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় মঞ্চের সামনে টানিয়ে দেওয়া হয় জয় বাংলা খচিত ব্যানার। শিল্পী কামাল আহমেদের ডিজাইন করা সেই ব্যানার থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই অগ্নিস্ফুলিংগ। প্রধান বক্তা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন সেই মঞ্চে। সেখানে দাঁড়িয়েই তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান বেশ কয়েকবার এই স্লোগান দিয়েছিলেন এবং উপস্থিত সাধারণ মানুষ অনেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে সাড়া দেয়। তবে তখনো পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার ব্যাপারটি ছাত্রনেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, আওয়ামী লীগের কোনো নেতা তখনো সরাসরি মঞ্চ থেকে এই স্লোগান উচ্চারণ করেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জন্ম নেওয়া স্লোগান এই এলাকায় দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৭০ সালের ৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার প্রচারণায় এই স্লোগান ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ব্যানারে ফেস্টুনে জয় বাংলা স্লোগান ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দাবানলের মতো।

১৯৭০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ব পাকিস্তানে জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল আওয়ামী লীগ। ৪ থেকে ৬ জুন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলও অনুষ্ঠিত হয়। এই উপলক্ষ্যে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ৭ জুন পল্টনে র‍্যালীর আয়োজন করা হয়। র‍্যালীর কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার জন্য গঠন করা হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে সেই কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারীদের টুপিতে সেফটিপিন দিয়ে আটকনো ছিলএই স্লোগানটি। সেই কুচকাওয়াজ থেকে শেখ মুজিবকে অনেকটা সামরিক কায়দায় সালামও জানানো হয়।

সেই ৭ জুন তারিখে ঢাকার রেসকোর্স মাঠে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল পরবর্তী জনসভাও আয়োজন করা হয়। সেই ভাষণেই প্রথমবার শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চ থেকে এই স্লোগানটি উচ্চারণ করেন।

তবে তখনো আওয়ামী লীগ নেতারা জনসভায় এই স্লোগান তেমন উচ্চারণ করতেন না। কারণ ‘জিয়ে সিন্ধ’ স্লোগান দিয়ে ইতোমধ্যেই সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা জি এম সৈয়দের উপরে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অগ্নিদৃষ্টি পড়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কড়া নজর রাখছিলেন, পান থেকে চুন খসলেই সত্তরের নির্বাচন বানচাল হয়ে যাবে এমন আশংকায় আওয়ামী লীগ নেতারাও ছিলেন তটস্থ।

নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়ে গেছে। জাতীয় পরিষদের ভোটগ্রহণ ৭ ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক পরিষদের জন্য ১৯ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে। এরই মধ্যে অক্টোবর মাসে ছাত্রলীগ কর্মীদের গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) জয় বাংলা নামে হাতে লেখা বুলেটিন প্রচার করতে থাকে। নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার জন্য প্রত্যন্ত এলাকায় এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই বুলেটিনের বাণী। যদিও বুলেটিনে সরাসরি বিএলএফ কিংবা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করা হয়নি।

১৯৭০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএলএফের বুলেটিন; Image source: প্রথমা প্রকাশন

ভোটের রায়ে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয়। একাত্তরের তিন জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আয়োজিত এক জনসভায় ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে বক্তব্য শেষ করেন শেখ মুজিব। এর আগের এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করে জয় সিন্ধু, জয় পাঞ্জাব, জয় সীমান্ত প্রদেশ, জয় পাকিস্তান বলে সবার শেষে জয় বাংলা বলেন। রেসকোর্স ময়দানের জনসভার পরের দিন চার জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভার শুরুতেই স্লোগান উঠে বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো, লাল সূর্য উঠেছে/বীর জনতা জেগেছে। ছাত্রজনতার স্লোগান ও স্লোগানগুলো মন দিয়ে শুনে প্রধান অতিথি শেখ মুজিব বক্তৃতায় দাঁঁড়ালেন। বক্তৃতা শেষ করলেন শুধু ‘জয় বাংলা’ দিয়েই। ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দটি সেদিন বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর কোনো ভাষণেই তিনি সেটি উচ্চারণ করেননি।

ইয়াহিয়ার টালবাহানা শুরু হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশ বাতিলের সাথে সাথে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ছাত্রজনতা। ডাকসু এবং ছাত্রলীগের প্রাধান চার নেতা সেদিন বিকেলেই দেখা করেন শেখ মুজিবের সাথে।

পল্টনে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ; Image source: dw.com

৩ মার্চ পল্টনে ছাত্র পরিষদের সভার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা এবং কর্মসূচী আকারে একটি ইশতেহার তৈরি করা হয়। এই ইশতেহারের শিরোনাম দেওয়া হয় ‘জয় বাংলা- ইশতেহার নং এক’। পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে সেই জয় বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ। জয় বাংলা স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে সারা পল্টন। শেখ মুজিবুর রহমান জানান তিনি ৭ তারিখেই তার যাবতীয় সিদ্ধান্ত জানাবেন।

৩ মার্চের ইশতেহার; Image source: প্রথমা প্রকাশন

৭ মার্চের উনিশ মিনিটের ভাষণে বাঙালির শোষণের যাতাকল ভেঙে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানালেন বঙ্গবন্ধু। ডাক দিলেন ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার উদাত্ত আহ্বান জানালেন। জনতার অগ্নিগর্ভের সামনে দাঁঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণ শেষ করলেন জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। রেসকোর্স ময়দান থেকে উঠা এই রণধ্বনি অব্যাহত ছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে। এই স্লোগান বুকে ধরেই মুক্তিসংগ্রামে লড়ে গেছে বাঙ্গালীরা। জয় বাংলা নামের এই সাধারণ একটি স্লোগান বুকে ধরে স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীরা কাঁপিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের ভিত্তি, সত্যি করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু; Image source: The Daily Star

সত্তরের নির্বাচনে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের পক্ষ থেকে ছাপানো এক প্রচারপত্রের শেষে জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে একটি বাণী লেখা ছিল। বাণীটিতেই ফুটে উঠেছে কত আবেগ, কত ভালোবাসা আর ত্যাগের প্রস্তুতি জড়িয়ে ছিল এই স্লোগানের সাথে।2

“শত প্রতিবন্ধকতা, লোভ-লালসা, আত্মকলহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘জয় বাংলা’ আমাদের ধ্যানধারণা, ‘জয় বাংলা’ কেবল একটি স্লোগান নয়, ‘জয় বাংলা’ একটি আদর্শ। ‘জয় বাংলা’ আমাদের মূল উৎস। ‘জয় বাংলা’ আমাদের চলার শেষ প্রান্ত। জয় বাংলা।” (অক্টোবর ১৯৭০)

তথ্যসূত্র

  1. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৪), জাসদের উত্থান পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ২৬-৩৭
  2. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৪), জাসদের উত্থান পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ২৭২

Related Articles