Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাঁকন বিবি: আঁচল তার লাল-সবুজের পতাকা

১৯৭১ সাল, বাংলার বুকে তখন যুদ্ধের আগুন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে, লাখ লাখ নিরীহ মানুষের রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত। কোটি কোটি মানুষ সর্বস্ব ত্যাগ করে এদেশের সীমান্ত পার হচ্ছে রোজ। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন এদেশের মাটিতে ইতিহাসের সবচেয়ে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন এই শোষকদের বিরুদ্ধে দেশের সর্বত্র হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সাধারণ মানুষ। তারা হৃদয়ে ধারণ করেছিল এক কঠিন শপথ;  প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনবে স্বাধীনতা। সর্বস্ব দিয়ে নিজের মা-বোনের অপমানের প্রতিশোধ নেবে তারা।

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি বাংলা; Source: enblog.mukto-mona.com

কিন্তু গল্প কি শুধু এতটুকুই? না, বিশাল এই গল্পের পাতায় পাতায় আছে আরো কিছু খণ্ড গল্প। এদেশের সাধারণ নারীদের গল্পগুলো কেমন ছিল তখন? অসংখ্য নারী নির্যাতিত হয়েছেন, কারো কারো ক্ষেত্রে সেখানেই হয়েছে জীবনের জাগতিক ও আত্মিক সমাপ্তি, আবার কেউ কেউ সেই জীবনকে পেছনে ফেলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাদের অনেকেই অসম সাহস নিয়ে কাজ করে গেছেন স্বাধীনতার পক্ষে। নির্যাতন আর অপমানে ভেঙে না পড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। পুরুষ যোদ্ধার পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছেন মুক্তির সংগ্রামে। সুনামগঞ্জের কাঁকন বিবি সেইসকল বীরাঙ্গনাদেরই একজন। তার সংগ্রামী জীবনের গল্প যেন এক তেজস্বিনী বীরের উপাখ্যানের চেয়ে কম নয়।

সাহসিকতার অপর নাম কাঁকন বিবি; Source: thefinancialexpress.com.bd

খাসিয়া পরিবারের মেয়ে কাঁকন বিবির আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ভারতের মেঘালয়ের নাইরয়া গ্রামে তার জন্ম হলেও তা ঠিক কবে সেটা ঠিকঠিক নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭০ সালে বিয়ে হয়ে কাঁকন এপার বাংলায় চলে আসেন। দিরাই উপজেলার শহীদ আলী নামের এক মুসলিম ব্যক্তির সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরে তখনকার প্রথা অনুযায়ী নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান নূরজাহান বেগম। কিন্তু পরবর্তীতে কাঁকন বিবি নামেই তিনি সবার কাছে বেশি পরিচিত পান।

বিয়ের এক বছর পর প্রথম সন্তানের মুখ দেখেন তিনি। তখন সময়টা একাত্তরের উত্তাল মার্চ। কিন্তু সন্তানের পৃথিবীতে আসার অভিজ্ঞতা মায়ের জন্য মোটেও সুখের হয়নি। কন্যা সন্তান জন্মেছে বলে স্বামীর বিরূপ মনোভাবের সম্মুখীন হয়ে শেষ পর্যন্ত মৌখিকভাবে তালাক দেওয়া হয় কাঁকন বিবিকে। দুধের শিশুকে নিয়ে স্বামী থেকে আলাদা হয়ে যান তিনি। পাহাড়ের সবুজ প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা কাঁকনের পুরো জীবনটাই ছিল এক সংগ্রামের গল্প।

এরপর জন্ম থেকেই জীবন যুদ্ধের সৈনিক এই নারীর সংসার যাত্রা শুরু হয় পেশাগত সৈনিক মজিদ খানের সাথে। তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে মজিদ খান সেই সময় একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মস্থল ছিল সিলেট ইপিআর ক্যাম্প। কাঁকন বিবি নতুন স্বামীর সাথে বসবাস করতে শুরু করেন ঠিকই কিন্তু পূর্বের স্বামীর কাছে রেখে এসেছিলেন দুধের শিশুকন্যা সখিনাকে। সেই শিশুকে ভুলতে পারলেন না। দুই মাস পর আগের স্বামীর গৃহ থেকে সন্তানকে আনতে যান। যাওয়ার আগেই মজিদের সাথে তার শেষ দেখা হয়।

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, সারা দেশে কেবল লাশ আর লাশ। প্রতিটি ঘরে আপনজন হারানোর হাহাকার। কাঁকন বিবির সংসার আবার এলোমেলো হয়ে গেল। শিশুকে নিয়ে ফিরে এসে স্বামীকে আর কোথাও তিনি খুঁজে পাননি। অনেক চেষ্টার পরে খবর পেলেন তার স্বামী দোয়ারাবাজার সীমান্তবর্তী এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন। সেখানেই ছুটে যান তিনি। স্বামীকে পাননি আর খুঁজে। সেই থেকেই বদলে যায় তার সংগ্রামের গল্প। স্বামীর খোঁজে দিশাহারা অতি সাধারণ এক নারীর সংগ্রামের গল্প হয়ে ওঠে একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক খণ্ডচিত্র।

এদেশের সাধারণ মেয়েদের অসাধারণ ত্যাগের গল্পই তো মুক্তিযুদ্ধ; Source: thedailystar.net

কাঁকন বিবি যখন দোয়ারাবাজার এলাকায় স্বামীর খোঁজে যান, তখন সেখানে চলছে মুক্তিবাহিনী আর পাক হানাদারদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। শিশুকন্যাকে এক ব্যক্তির আশ্রয়ে রেখে স্বামীর খোঁজে যান টেংরাটিলা ক্যাম্পের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা তখন ধরে ফেলে তাকে, বাঙ্কারে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন চালায় অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। এই ঘটনার পর তিনি হয়ে ওঠেন অন্য এক কাঁকন বিবি। স্বামীকে ফিরে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন স্বদেশের মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামে।

একাত্তরের জুলাই মাসে তিনি দেখা পান ঐ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মা-বোনের মর্যাদা পেতেন, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর স্নেহ ও আশ্রয় পান কাঁকন বিবি। তিনিই কাঁকন বিবির সশস্ত্র যুদ্ধের পথ সহজ করে দেন। তখন সিলেটের ওই সেক্টরের কামান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মীর শওকত আলী। শওকত আলী কাঁকন বিবিকে তার বোনের মর্যাদা দেন।

দেশের জন্য কাজ করতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখে তাকে দেওয়া হয় ছদ্মবেশ ধরে পাক বাহিনীর তথ্য জোগাড় করে দেওয়ার কাজ। তিনি কখনো ভিখারিনী, কখনো পাগলিনী, আবার কখনো নিম্নশ্রেণীর হতদরিদ্র নারীর বেশ ধরে ক্যাম্পে যেতেন তথ্য জোগাড় করতে। পাকসেনাদের ক্যাম্পের খবরাখবর নিয়ে আসতেন নিঁখুতভাবে। তার কারণে সেই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি সফল অভিযান চালাতে সক্ষম হয়। এছাড়া গুলির বাক্স, খাবার, ওষুধপত্র ও জরুরি খবর আদান-প্রদানের কাজও দায়িত্বের সাথে পালন করেছেন তিনি।

তার জীবনের গল্প মানে কখনো না ভাঙা মনোবলের গল্প; Source: 1971archive.org

এসব দায়িত্ব পালন ছিল সেই সময় অগ্নিপরীক্ষার মতো কঠিন। অনেক সময়ই তাকে চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, কখনো ধরা পড়ে গিয়ে মেনে নিতে হয়েছে পাহাড়সম নিগ্রহ, অপমান আর অত্যাচার। যুদ্ধে তার এই অবদানের কথা উঠে এসেছে স্বাধীনতা অর্জনের অনেক পরে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের অনুসন্ধানে। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় এক সাংবাদিকের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে সকলের দৃষ্টিগোচর হন তিনি। কাঁকন বিবি নিজের এবং সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানা যায়, তার যুদ্ধকালীন সময়ে সাহসিকতার নানা ঘটনা।

একবার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার এলাকায় ছদ্মবেশী গোয়েন্দা হিসেবে খবর সংগ্রহের কাজ করার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। ক্যাম্পে আটকে রেখে তার ওপর চালানো হয় অকথ্য পাশবিক নির্যাতন। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ট্যাংরাটিলা ক্যাম্পে। একসময় তিনি পাক হানাদারদের বলেন যে, তিনি পাকিস্তানি সৈনিক মজিদ খানের স্ত্রী এবং স্বামীর খোঁজে এখানে এসেছিলেন। তার অভিনয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পের কমান্ডার ধোঁকায় পড়ে যান। তিনি তাকে পাকিস্তানের জন্য কাজ করার প্রস্তাব দিলে গোয়েন্দা কাঁকন বিবির কাজ যেন অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনার পক্ষ থেকে দেওয়া পরিচয়পত্রের সাহায্যে তিনি যখন তখন সেনা ক্যাম্পে যাতায়াত করতে থাকেন এবং এদিকে মুক্তিবাহিনীকে তথ্য সরবরাহ করতে থাকেন। অতি দু:সময়েও কাঁকন বিবি একজন অত্যন্ত দক্ষ যোদ্ধার পরিচয় দিয়েছিলেন। এসকল তথ্যের প্রাপ্তি ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সেই এলাকা মুক্ত করা ছিল প্রায় অসম্ভব।

শুধু গোয়েন্দাগিরিতেই এই নারীর সংগ্রামের ইতিহাস শেষ নয়। তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন সম্মুখ যুদ্ধের যোগ্য হিসাবেও। নারী হয়েও পুরুষ যোদ্ধাদের পাশাপাশি অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ২০টি সম্মুখযুদ্ধে, যেগুলোর মধ্যে আছে সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়কে জাউয়া বাজার এলাকায় সেতু উড়িয়ে দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন। মহব্বতপুর, কান্দিগাঁও, টেংরাটিলা, বেটিগাঁও, নূরপুর ও দেয়ারাবাজারের অপারেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২০টি অপারেশনে অস্ত্র হাতে অংশ নেন তিনি। টেংরাটিলা অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। এ জখমের চিহ্ন মৃত্যু পর্যন্ত তাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে।

শেষ বয়সে তিনি পেয়েছিলেন সরকাররের সহযোগিতা; Source: youtube.com

যুদ্ধের পর থেকে কাঁকন বিবি সুনামঞ্জের দোয়ারাবাজারে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত বাড়িতেই কন্যা ও জামাতাসহ থাকতেন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বীরপ্রতীক উপাধি দেন। তবে এখনো এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। সংগ্রামের সেই দিনগুলোর কথা শুনুন কাঁকন বিবির মুখ থেকে।

এদেশে জন্মগ্রহণ না করেও এদেশকে ভালোবেসে যে নারী জীবনের সবচেয়ে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন তার প্রতিদান আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি সেই হিসাব না হয় তোলা থাক। কিন্তু নারী হয়েও যে অসীম সাহসিকতা আর সংগ্রামের গল্প তিনি লিখে গেছেন এদেশের ইতিহাসে তা লেখা থাকবে যুগের পর যুগ। এই বছরের গত ২০ মার্চ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ২১ মার্চ বুধবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে সেখানেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

ফিচার ইমেজ: en.prothomalo.com

Related Articles