Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মারক

মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। ভারত সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা হবার কারণে এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এই জেলা মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনার সাক্ষী। যুদ্ধের সময়ে এখানে যেমন ছিল দুঃখের হাহাকার, তেমনই ছিল বিজয়ের উল্লাস। অনেক মানুষ শহীদ হয়েছে এখানের মাটিতে। সেসব মানুষের সম্মানে স্থানে স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। সেসব সৌধের মাঝে বিখ্যাত কয়েকটি সৌধ সম্পর্কে তুলে ধরা হলো এখানে।

১. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ (অবকাশ)

স্মৃতিসৌধ; ছবি: আফতাব উদ্দিন আযহার

এই স্মৃতিসৌধটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। জেলার মানুষেরা এই স্থানটিকে বর্তমানে অবকাশ বলে ডাকে। শহর থেকে দূরে না হওয়ায় এবং মনোরম পরিবেশে খানিকটুকো সময় বসে বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা থাকায় প্রতিদিনই শত শত মানুষের আগমন ঘটে এখানে। এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পেছনে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান বাহিনীর একটি ট্যাংক নষ্ট হয়ে যায়। এটি ছিল উভচর ট্যাংক। স্বভাবত কোনো বাহিনীই গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধযানটিকে ফেলে দিতে চাইবে না। পাকিস্তানও চায়নি। কিন্তু যুদ্ধের শেষ দিকে (ডিসেম্বর মাসে) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে ট্যাংকটিকে ফেলে রেখেই পেছনে হাঁটতে বাধ্য হয় তারা।

দেশ স্বাধীন হবার পরে মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাংকটিকে সরিয়ে শহরের ফারুকী পার্কে এনে স্থাপন করেন। তখন এটিই হয়ে উঠে এখানকার মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। রাস্তার পাশ দিয়ে যাবার সময় একে দেখলে মনে ভেসে উঠতো মুক্তিযুদ্ধের হাহাকার ও বর্বরতার কথা। এটি দেখে মা খুঁজে পেতেন তার হারানো ছেলেকে, স্ত্রী খুঁজে পেতেন তার হারানো স্বামীকে, বোন খুঁজে পেত তার হারানো ভাইকে।[1]

পাকিস্তান বাহিনীর সেই ট্যাংক; ছবি: মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বই থেকে।

কিন্তু এটি এখানে বেশিদিন থাকতে পারেনি। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের আমলে দেশে সামরিক আইন জারি হয়। তখন এই ট্যাংকটিকে ফারুকী পার্ক থেকে সরিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। এটি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর গর্বের ধন। একে এখান থেকে সরানোর পক্ষে ছিল না এখানকার কেউ। মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ জনতা মিলে আন্দোলন করেছিলেন এর বিপক্ষে।[2] কুমিল্লা নেবার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সেখানকার সামরিক যাদুঘরে স্থান হবে এটির। সেজন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক, পৌর চেয়ারম্যান এবং আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে সেনা কর্মকর্তার সাথে একটি সমঝোতা হয়। সমঝোতা অনুসারে ট্যাংকটি এখান থেকে নিলে এখানে মুক্তিযুদ্ধের একটি মনোরম স্মৃতিসৌধ তৈরি করে দিতে হবে।[3]

এই প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সালে ফারুকী পার্কে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে সময়ে সময়ে এর প্রভূত উন্নয়ন করা হয়। বর্তমানে প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে এখানে। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে এখানে মেলা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

পহেলা বৈশাখে স্মৃতিসৌধের পাশে হচ্ছে উৎসব। ছবি: লেখক

২. কুল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ

কুল্লাপাথর অঞ্চলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শেষ দিকে ভারতের কাছে অবস্থিত। এর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে সালদা নদী। সালদা নদী ধরে ধরে হাজার হাজার মানুষ ভারতে প্রবেশ করেছে। এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে প্রায় সময়ই পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হতো মুক্তিযোদ্ধাদের। স্থানে স্থানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হতেন। তাদের কাউকে কাউকে পাওয়া যেতো আর কাউকে কাউকে পাওয়া যেতো না। যাদেরকে পাওয়া যেতো তাদের মৃতদেহ বাংলাদেশের সীমানায় কিংবা ভারতের সীমানায় কবর দেয়া হতো। সেসব কবর হতো বিক্ষিপ্ত ও পরিচয়হীন। আবদুল মান্নান নামে এ অঞ্চলের একজন ব্যক্তি শহীদদের মরদেহ দেখে খুব ব্যথিত হন। মুসলিম নিয়ম অনুসারে লাশকে গোসল করিয়ে, কাফনের কাপড় পরিয়ে, জানাজা দিয়ে কবর দিতে হয়। তিনি তার স্ত্রী, পুত্র ও গ্রামবাসীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহ করতে থাকেন এবং সেগুলোকে গোসল, কাফন ও জানাজার মাধ্যমে কবর দিতে থাকেন। একে একে মোট ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার স্থান হয় সেখানে।[4]

কুল্লাপাথরের ৫০ সমাধি; ছবি: লেখক

যুদ্ধের পরে আবদুল মান্নান ও তার স্ত্রী প্রয়াত হলে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে কবর দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হবার পরে তারা কবরের এই জমিটি এবং এর আশেপাশের আরো কিছু জমি বাংলাদেশ সরকারের নামে দান করে দেন। দানের শর্ত ছিল সরকারের পক্ষ থেকে সমাধিস্থলটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে এবং এখানে একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হবে।[5]

ধীরে ধীরে এখানে স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিফলক, কবর প্রাচীর, নিরাপত্তা দেয়াল, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, রেস্ট হাউজ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, পুকুর, মসজিদ, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, দিনাজপুর সহ বিভিন্ন জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার শেষ ঠাই হয়েছে এখানে।

৫০ জন শহীদের নাম ফলক; ছবি: লেখক

৩. সৌধ হিরণ্ময়

জেলা শহরের শেষ দিকে কাউতলীতে এটি অবস্থিত। এ অংশে কুমিল্লা-সিলেট রোডের একটি বাইপাস রয়েছে। বাইপাস রোদের ফলে এখানে তিন রাস্তার সমাহার ঘটেছে। তিন রাস্তার মাথায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতিসৌধটি। কাউতলী একটি জনপ্রিয় স্টেশন, প্রচুর লোকের আনাগোনা হয় এই অংশ দিয়ে। এটি জেলা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। জেলা থেকে বের হয়ে দক্ষিণ দিকে যেতে হলে কাউতলীর উপর দিয়েই যেতে হয়। তাই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সামনে পড়ে এই স্মৃতিসৌধটি। বর্তমানে (২০১৭ সাল) জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সময়ে সময়ে পানি দিয়ে ধৌত করা হয় এটি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, ব্যস্ততায় এদিকে ফিরে তাকানোর সময়ই হয় না মানুষের।

৪. বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল শহীদ হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানার দরুইন গ্রামে। ১৯৭১ সালের ১৭ ও ১৮ এপ্রিল এই অঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল যুদ্ধ হয়। ১৮ এপ্রিল সকালে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়েছিল এমন আবহাওয়ায় পাকিস্তানীরা আক্রমণ করবে না। কিন্তু এই ধরে নেবার আকস্মিক সুবিধাটাই নিয়েছিল পাকিস্তানী সেনারা। অতর্কিত হামলা করে বসলো এবং ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলো। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধের মাঠ থেকে সরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে সরে যেতে হলেও থেকে থেকে কাউকে না কাউকে যুদ্ধ করে যেতে হয়। কেউ একজন বিপক্ষ দলকে ঠেকিয়ে রাখলেই না তবে নিজের দলের লোকেরা নিরাপদে সরে যেতে পারবে।

দরুইনে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পাকিস্তানীদেরকে ঠেকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সিপাহী মোস্তফা কামাল। ৮০০ রাউন্ড গুলি সহ একটি এলএমজি নিয়ে চারদিক থেকে নিরাপত্তা দিতে লাগলেন মুক্তিবাহিনীকে।[6] এই নিরাপত্তায় প্রায় এক প্লাটুন মুক্তিসেনা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যায়। কিন্তু মোস্তফা কামালকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পাকিস্তানী সৈন্যরা। এর মাঝে তার এলএমজির গুলিও শেষ হয়ে যায়। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে তিনি সেখানে শহীদ হন। দরুইন এলাকাবাসী ভালোবাসার সাথে তাকে একটি পুকুর পাড়ে সমাহিত করে।[7] পরবর্তীতে কবরটি পাকা করা হয় এবং এর পাশে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে নির্মাণ করা হয়।

দরুইনে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি, ছবি: সামহোয়্যার ইন ব্লগ

৫. জাগ্রত বাংলা

মেঘনা নদীর পাড়ে অবস্থিত আশুগঞ্জ থানায় মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির স্মরণে আশুগঞ্জ সার কারখানার প্রবেশ পথে নির্মাণ করা হয় জাগ্রত বাংলা নামে এই ভাস্কর্যটি। এর স্থপতি ছিলেন বিখ্যাত ভাস্কর হামিদুর রহমান। এটি স্থাপিত হয় ১৯৮৯ সালে এবং এটি নির্মাণে তখন ব্যয় হয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা।[8]

জাগ্রত বাংলা; ছবি: আরিফ খান

৬. লক্ষ্মীপুর শহীদ সমাধিস্থল

কসবা থানার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরে একটি স্থানে ১৩ জন শহীদের একটি সমাধিস্থল আছে। এ অঞ্চলের যুদ্ধে শহীদ যোদ্ধাদেরকে এখানে সমাহিত করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর কমান্ডার মোহাম্মদ আইনুদ্দিন এখানে শায়িত সকল মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা করে একটি সাইন বোর্ড স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, এখানে শহীদ সকলেই ছিল তার সহযোদ্ধা। পরবর্তীতে এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলা সদরে এই সমাধিস্থলটির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের দাবী করেন। সেই দাবীর প্রেক্ষিতে এখানে একটি বেষ্টনী দেয়াল ও প্রতিটি সমাধিতে একটি করে সমাধি ফলক নির্মাণ করা হয়।[9]

তথ্যসূত্র

[1] কবি জয়দুল হোসেন কর্তৃক গৃহীত মুক্তিযোদ্ধা এ.কে.এম. হারুনুর রশিদের বক্তব্য।
[2] জয়দুল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গতিধারা, ২০১১
[3] ফারুকী পার্ক স্মৃতিসৌধের সামনে লাগানো ইতিহাস ফলকে উল্লেখিত তথ্য
[4] কুল্লাপাথর সমাধিস্থলের নাম ফলকে উল্লেখিত তথ্য
[5] জয়দুল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গতিধারা, ২০১১
[6] দেলোয়ার হোসেন খান, বাংলাদেশের বীরগাথা, আদর্শ প্রকাশনী, ২০১৭
[7] জয়দুল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গতিধারা, ২০১১
[8] জয়দুল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গতিধারা, ২০১১
[9] জয়দুল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গতিধারা, ২০১১

ফিচার ছবি- লেখক

Related Articles