মুক্তিযুদ্ধে যতগুলো সফল অপারেশন চালিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, তার মধ্যে অন্যতম বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশন। মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত জেড ফোর্সের একটি ব্যাটালিয়ন ভারতের তেলঢালা ঘাঁটি থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে এই দু:সাহসী অভিযান পরিচালনা এবং অভিযান শেষে নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করেন। যা ছিল অত্যন্ত একটি দু:সাহসী ঘটনা। বাহাদুরাবাদ ঘাটে দুধর্ষ এই সামরিক অভিযান নিয়ে চলুন জেনে আসা যাক।
বাহাদুরাবাদ ঘাটে অভিযানের কারণ
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বাহাদুরাবাদ ঘাটের অবস্থান ভৌগলিক ও সামরিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তৎকালীন সময়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগকেন্দ্র ও নদীবন্দর। সেখান থেকে যমুনার অপর পাড় ফুলছড়ি ঘাটে চলাচল করত রেলফেরী। এই নৌ-বন্দর ও রেলফেরী ছিল উত্তরাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বাহাদুরাবাদ ঘাটের মাধ্যমেই ঢাকা থেকে বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলে ভারি সরঞ্জাম, অস্ত্র, খাদ্যসামগ্রী, জনবল প্রেরণ করা হত। তাই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তথা তৎকালীন বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ইত্যাদি অঞ্চলে নিয়ন্ত্রন রাখার জন্য বাহাদুরাবাদ ঘাট ও এই নৌ-রুট ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সে সময়ে পাকিস্থানী বাহিনীর এই চেইন ভাঙ্গতে এই নৌ-রুটকে অকার্যকর করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। আর সেকারনেই বেছে নেওয়া হয় বাহাদুরাবাদ ঘাটে অভিযানের মত ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান।
অভিযানের প্রস্তুতি
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে সামরিক বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকগণকে নিয়ে ঘাটি গড়া হয় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের তেলঢালায়। সেখানে প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে একটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। প্রথমে এর নাম রাখা হয় ওয়ান ইবি ব্রিগেড। পরবর্তীতে এর নাম রাখা হয় ১ম আর্টিলারি ব্রিগেড। আরো পরে জুন মাসের শেষ দিকে ব্রিগেডটির কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পান মেজর জিয়াউর রহমান (পরবর্তীতে লেফট্যানেন্ট জেনারেল, বীর উত্তম) । তখন ব্রিগেডটির নাম পরিবর্তন করে মেজর জিয়ার নামের আদি অক্ষর নিয়ে ব্রিগেডটির নামকরণ করা হয় জেড ফোর্স। জিয়াউর রহমান তখন জেড ফোর্সের অধিনায়ক এবং অতিরুক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জেড ফোর্স গঠিত হওয়ার পর মেজর জিয়া খুব দ্রুতই প্রথাগত যুদ্ধের জন্য তার অধিনস্ত ব্যাটালিয়নকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি শেষে, এসিড টেস্ট হিসেবে তেলঢালায় অবস্থান করা তিনটি ব্যাটালিয়নকে তিনটি অভিযানের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। যার একটি ছিল অপারেশন বাহাদুরাবাদ ঘাট। অপর দুটি অভিযান পরিচালিত হয় জামালপুরের কামালপুর বিওপি ও শেরপুরে নকশী বিওপিতে। কামালপুর ও নকশী অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যে সামরিক বিপর্যয় ঘটলেও বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশন দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
বাহাদুরাবাদ ঘাটে অভিযান পরিকল্পনা
বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনের জন্য অ্যাসল্ট কমান্ডারের দায়িত্ব ন্যাস্ত হয় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট নুরন্নবী খানের (পরবর্তীতে লে. কর্ণেল) উপর । তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসীকতা ও বীরত্বের জন্য বীরবীক্রম খেতাব পেয়েছিলেন। এই অভিযানের ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল (পরবর্তীতে কর্ণেল) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মূল আক্রমনের দায়িত্বে থাকবে লে. নুরন্নবী খানের নেতৃত্বে ডেল্টা কোম্পানি, রি-ইনফোর্সমেন্ট, মর্টার ও ফায়ার সাপোর্টে তার নিজের নেতৃত্বে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার কোম্পানি আর আক্রমনকারী বাহিনীর প্রতিরক্ষা ও পশ্চাদপসরণের নিরাপদ করার দায়িত্বে থাকবে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে আলফা কোম্পানি।
নির্দেশনা অনুযায়ী পূর্বেই বাহাদুরাবাদ ঘাটে রেকি করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অ্যাসল্ট কমান্ডার নুরন্নবী খান নিজেও রেকিতে অংশ নেন। এই অঞ্চলে আগে থেকেই সক্রিয় ছিল একটি ফ্রিডম ফাইটার কোম্পানি (এফএফ কোম্পানি)। তারা সর্বতোভাবে এই অভিযানে সহায়তা করেন। এই কোম্পানির দুজন প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল কাদের ও লুৎফর রহমান এই অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড করেন ও তথ্য সরবরাহ করেন। এছাড়াও এ অভিযানে তথ্য সরবরাহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার জন্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী, আজিজুর রহমান মাস্টার, জহুরুল হক মুন্সী, হাবিবুর রহমান, গাজী নাসির উদ্দীন, ভিক্ষু চেয়ারম্যান প্রমুখ ব্যক্তির নাম বিশেষভবে উল্লেখ করেছেন অ্যাসল্ট কমান্ডার নুরন্নবী খান বীরবীক্রম।
সবশেষে ৩১শে জুলাই বাহাদুরাবাদ ঘাটে আক্রমনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ৩০ জুলাই ভারতের তেলঢালা থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটের উদ্দ্যেশে রওয়ানা হন।
অপারেশন বাহাদুরাবাদ ঘাট
৩০ জুলাই ১৯৭১। বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের ভারতীয় অংশে হযরত শাহ কামালের মাজার প্রাঙ্গন। তেলঢালা সামরিক ক্যাম্প থেকে রওয়ানা হয়ে এই মাজার প্রাঙ্গনে সমবেত হন তারা। সেখানে জুম’আর নামায আদায় করে পা ফেলেন বাংলাদেশের মাটিতে। এই অভিযানে প্রায় চারশত মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।
বাংলাদেশে প্রবেশের পর রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানান সর্বস্তরের মানুষ। নানা রকমের খাদ্যদ্রব্য হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের আপ্যায়নের চেষ্টা করেন তারা। দেশের মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত হন মুক্তিযোদ্ধারা। আসার পথে নৌকার মাঝি ও জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। পায়ে হেঁটে ও নদীপথে প্রায় ত্রিশ মাইল অতিক্রম করে রাতের আঁধারে ঘাট থেকে কিছুটা দূরে একটি মাদ্রাসায় পৌঁছে সেখানে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা। আক্রমনের পর পাকিস্থানি বাহিনী যাতে রি-ইনফোর্সমেন্ট না পাঠাতে পারে সেজন্য ঘাটের দুপাশের সড়কেই মুক্তিযোদ্ধাদের দুটো দল অবস্থান নেয়।
তখন বাহাদুরাবাদ ঘাট প্রতিরক্ষায় ছিল পাকিস্থান বাহিনির ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি প্যারা মিলিটারি রেঞ্জার্স। পাকিস্থানী বাহিনীর ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুন নিয়মিত সৈন্যের সাথে কিছু রেঞ্জার্স ও রাজাকার বাহিনীর কিছু সদস্য বাহাদুরাবাদ ঘাট প্রতিরক্ষায় মোতায়েন ছিল। ঘাটের নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু ট্রেঞ্চ স্থাপন ও সার্চ লাইট স্থাপন করলেও যেহেতু দেশের সীমান্ত থেকে অনেক অভ্যন্তরে সেকারণে বিশেষ কোন ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন মনে করেনি তারা। তবে তেতলা ফেরির ছাদে দুটো হেভি মেশিনগানের অবস্থান ছিল তাদের।
চূড়ান্ত অভিযান
৩১ জুলাই ১৯৭১ ভোররাতে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী লে. নুরন্নবী খান তার বাহিনী নিয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটের একদম নিকটে গিয়ে একটি আখক্ষেতে অবস্থান নেন। সরাসরি আক্রমনে অংশ নেন প্রায় ১৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা। ভোর চারটার দিকে শুরু হয় চূড়ান্ত আক্রমন। ঘাটের পাশের আখক্ষেতের আড়াল থেকে একযোগে ফায়ার করা হয় রকেট লাঞ্চার। প্রথম আঘাতেই উড়ে যায় ঘাটে আলো সরবরাহ করা জেনারেটর, পাকবাহিনীর মেশিনগান পয়েন্ট ও তাদের অবস্থান নেওয়া রেলওয়ের কোচগুলো। গোলার আঘাতে ডুবে যায় সেখানে অবস্থান করা লঞ্চ ও রেল ওয়াগন বহনকারী ফেরি।
অকস্মাৎ আক্রমনে পাকবাহিনী তাদের কোন অবস্থান থেকেই কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুর্হুমুহু আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায় ঘাট এলাকা। অভিযানের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুবেদার ভুলু মিয়া গুলিবিদ্ধ হন। অপরদিকে অধিকাংশ পাক বাহিনীর সদস্যরা প্রাণ হারায় এই অভিযানে।
প্রস্থান
অভিযান শেষ করে দ্রুতই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন। কারণ তারা আশংকা করছিলেন পাকবাহিনী আকাশপথে হামলা করতে পারে। বেলা দশটা নাগাদ পাকবাহিনীর দুটো হেলিকপ্টার টহল দিতে থাকে। লে. নুরন্নবী খান, শাফায়েত জামিল সহ পুরো বাহিনী পাশ্ববর্তী দুর্ভেদ্য চরাঞ্চল মদনের চরে গিয়ে দেলোয়ার মাস্টার নামক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িকে হাইড আউটের জন্য বেছে নেন। এই চরটিতে নদীপথ ছাড়া প্রবেশ করা ছিল দু:সাধ্য আর নদীর নাব্যতা কম থাকায় ভারী নৌযান নিয়েও এখানে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না বলে এই অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে অবস্থান গ্রহন করতে সমর্থ হন।
বাহাদুরাবাদ ঘাট অভিযানে সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লে. নুরন্নবী খান প্রস্তাব করেন সেখান থেকে পুনরায় তেলঢালা ফেরত না গিয়ে বরং থানা শহর দেওয়ানগঞ্জ দখলে নেওয়ার। ব্যাটালিয়ান কমান্ডার শাফায়াত জামিলও সায় দেন তাতে। এরপর উপজেলা শহর দেওয়ানগঞ্জ অভিযানেও সফল হন তারা। পরপর এই দুটি সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা চিন্তা করেন জেলা শহর জামালপুর অভিযানের। কিন্তু জেড ফোর্সের একইসঙ্গে চালানো অন্য দুটি অভিযান কামালপুর ও নকশী বিওপিতে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সময়ক্ষেপন না করে দ্রুত ফিরে আসতে বার্তা পাঠান ব্রিগেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান। আদেশ পেয়ে ২ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে পুনরায় ভারতের তেলঢালার দিকে প্রস্থান করেন মুক্তিযোদ্ধারা। নৌকার মাঝিরা তাদের নিরাপদ প্রস্থানে সহায়তা করেন।
এভাবেই শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধের দুর্দান্ত একটি অধ্যায় অপারেশন বাহাদুরাবাদ ঘাট। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই অপারেশন একটি অনন্য ঘটনা। ইতিহাসে এই সফল অভিযানের পেছনে রয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জীবনবাজি রাখা প্রচেষ্টা, সাধারন মানুষের স্বত:স্ফূর্ত সহযোগিতা ও একটি দুধর্ষ নিখুঁত পরিকল্পনা। এখনো এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ফেরে বাহাদুরাবাদ অভিযানের দুর্দান্ত বীরত্বগাঁথার গল্প।
তথ্যসূত্র:
১. অপারেশন বাহাদুরাবাদ ঘাট, লে. কর্ণেল এস আই এম নুরন্নবী খান বীর বিক্রম, দিব্য প্রকাশ (প্রথম সংস্করণ)
২. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর - কর্ণেল শাফায়াত জামিল (অব.), সাহিত্য প্রকাশ
This article is in bangla. based on operation bahadurabad ghat. a major operation in liberation war in 1971. Necessary resources have been hyperlinked.
Feature Image: অপারেশন বাহাদুরাবাদ ঘাট- বই থেকে। খুব সম্ভবত ছবিটি তুলেছিলেন ডা. হুমায়ুন হাই, পৃষ্ঠা-৮৫