Do not publish
Please consult if feature image need to change
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়েছে একটু আগে। ৩০ নভেম্বর বিদায় নিয়ে ১ ডিসেম্বরের শুরু হলো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় থাকা পাক বাহিনীর জন্য বছরের শেষ ‘উপহার’ পাঠিয়েছেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। তার হয়ে পাক বাহিনীকে উপহার দিতে যাচ্ছেন ২ ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার মেজর মঈন (মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী)। রাত ১টা ‘H Hour’ (সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময়) শুরুর সাথে সাথেই আখাউড়ায় পাক বাহিনীর ঘাঁটির ওপর মুহুর্মুহু কামানের গোলা আর গুলির উপহার দেয়া শুরু হলো! যে কোন মূল্যেই আখাউড়া উদ্ধার করতে হবে। কৌশলগতভাবে আখাউরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান!
৩ নং সেক্টরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া । ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে মাত্র মাইল তিনেক দূরে অবস্থিত আখাউড়া। উত্তরে আশুগঞ্জ, দক্ষিণে কুমিল্লার সাথে এই জংশনের যোগসূত্র ছাড়াও এই স্থানটি অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পাকসেনারা তাই শক্ত ঘাঁটি করে দখলে রেখেছে এই জংশনক কেন্দ্র করে। ঢাকা-সিলেট রেললাইন এই আখাউড়ার ওপর দিয়ে চলে গেছে। পাক বাহিনী তাদের শক্তিশালী ২৭ পদাতিক ব্রিগেডের অংশ ১২ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স রেজিমেন্টকে দুটি ট্যাংক ট্রুপ সমেত এই এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত রেখেছিল। আশেপাশে পাক সেনা প্রচুর। আখাউড়া দখল করতে পারলে ঢাকার সাথে সিলেট এমনকি চট্টগ্রামের দিকেও আগ্রসর হওয়া সহজ হবে।
এদিকে 'এস ফোর্স' এর অংশ ২ ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানিকে 'ব্যাটল অফ বিলোনিয়া'র জন্য ফেনীতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিজেদের সেক্টরে ফেরত আসার পরই এই সেক্টরের সেনাদের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ দেখতে পান এস ফোর্সের কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ (কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ, বীর উত্তম)। বিলোনিয়ার যুদ্ধ সৈন্যদের আত্মবিশ্বাসের পারদকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, সেনাদের মনোবল হয়ে দাঁড়ায় পাহাড়সম। পাক বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে এত বড় অনুপ্রবেশ এবং এমনকি বিমান ভ‚পাতিত করে এসেছে তারা। আর এই আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশের অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান আখাউড়া দখলের ছক কাটেন কে এম সফিউল্লাহ।
তারই পরিকল্পনায় আখাউড়া উদ্ধারে ১ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় 'অপারেশন নাট ক্র্যাক'।
১. মূল আক্রমণ চালাচ্ছে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। নেতৃত্বে মেজর মঈন। এদের ওপর আখাউড়া থেকে সিঙ্গারবিল পর্যন্ত শত্রæমুক্ত করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এদের ফায়ার সাপোর্ট দিবে মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট 'মুজিব ব্যাটারি' এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী।
২. বিলোনিয়া থেকে যুদ্ধ করে আসা ডেল্টা কোম্পানি ২ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগ দিয়েছে। হেলাল মোর্শেদের এই কোম্পানি রাজাপুর এবং আলিমপুর গ্রামে অবস্থানকারী পাকসেনাদের ওপরে আক্রমণ চালাবে।
৩. ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নতুন ব্যাটালিয়ন সিলেট থেকে আখাউড়া আসার মহাসড়ক ধরে অবস্থান নিয়েছে। পাক বাহিনীর রিইনফোর্সমেন্টকে থামিয়ে দেবে এরা।
৪. ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা আগরতলার দিকের ধর্মঘরে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছে। এতে সিলেটের মনতলা হয়ে পাক বাহিনী পেছনের মুক্তিসেনাদের ওপর আক্রমণ করতে পারবে না। ধর্মঘরকে সামনে রেখে অবস্থান নিয়েছেন ডেল্টা কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন ভ‚ঁইয়া (সুবিদ আলী ভ‚ঁইয়া)।
৫. আরেকটা ব্যাটালিয়ন ৩০ তারিখে মুকুন্দপুর, হরশপুর এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ১১ রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর নাসিমের নেতৃত্বে থাকা ব্যাটালিয়নও ঘিরে রাখবে পাক বাহিনীকে। সেদিক দিয়ে শত্রæ না আসা নিশ্চিত করবে তারা।
৬. ৩ নম্বর সেক্টর থেকে দুই কোম্পানি নতুন সেনা (এদের ট্রুপস বলা হয়) আগরতলা বিমানবন্দরের উত্তর-পশ্চিম বরাবর বাংকার বানিয়ে অবস্থান নিয়েছে। এদের নেতৃত্বে আছেন মেজর মতিন (মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন বীর প্রতীক)
সবমিলে পরায় সবদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ধরার কৌশলে হাতছিল মুক্তিবাহিনী।
আক্রমণের শুরুতে দখল করে নিল সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশন এবং সিঙ্গারবিল ঘাঁটি। রাতের অন্ধকারে পাক বাহিনীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে ২ ইস্ট বেঙ্গল। ভোর ৫টা পর্যন্ত চলে প্রাথমিক লড়াই। অবশ্য সূর্যের আলো ওঠার সাথে সাথেই পুনরায় সংগঠিত হয়ে হামলার চেষ্টা করে পাক বাহিনী। কিন্তু দেশের জন্য যারা প্রাণ দেয়ার নিয়ত করে এসেছে তাদের সাথে যুদ্ধ করে খুব সুবিধা করতে পারছিল না পাক বাহিনী। দুপুর ৩টা নাগাদ আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন এবং তার দক্ষিণ দিকের এলাকাও মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়।
স্টেশনে পাকসেনাও ছিল এক ব্যাটালিয়ন। সাথে কয়েকশ রাজাকার। ১ তারিখ রাতে বিপুল শক্তি নিয়ে পাল্টা আঘাত চালায় পাক বাহিনী। কিছুটা পিছু হটে মুক্তিবাহিনী। ২ তারিখ আবার পুনরায় হামলা চালিয়ে আজমপুর স্টেশন দখল করে নেয় মুক্তিবাহিনী। একজন পাকসেনা ধরা পড়ে। ২০ জন নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২ জন শহিদ হন। আহত হন ১১-১২ জন।
এদিকে ২ তারিখ পর্যন্ত একনাগাড়ে যুদ্ধ চলে। আর্টিলারি, মেশিনগান নিয়ে দুই পক্ষই পাল্টা জবাব দিচ্ছে। পাকসেনারা এখানে প্রচুর গোলাবারুদ এবং খাবার নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। রেলওয়ে স্টেশনের সামনে পাক বাহিনীর সব থেকে শক্ত বাংকার। কোনোভাবেই সেগুলো ভেদ করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। ২ দিন মনে হয় এক মিনিটের জন্যও গোলাগুলির শব্দ থামেনি।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান তার মূল ভ‚মি থেকে ভারতে হামলা করে বসে। সীমান্তসংলগ্ন অনেক বিমানঘাঁটিতে হামলা চালালে ভারত সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । এদিন রাতেই ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের দুটি ব্রিগেড এসে হাজির হয় আখাউড়াতে। প্রতিটি ব্রিগেডে ছিল একটি করে ট্যাংক স্কোয়াড্রন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ায় এসে এস ফোর্সের সঙ্গে মিলিত হয়। দুটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট জঙ্গি বিমান আখাউড়ায় মুক্তিবাহিনী অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। ভারতীয় জঙ্গি বিমান পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানগুলো পালিয়ে যায়। ৩ তারিখ রাত থেকেই আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে ৩ তারিখের তুমুল যুদ্ধে গঙ্গাসাগর মুক্ত হয়। পরদিন ৪ তারিখে মিত্রবাহিনী আখাউড়ার উত্তরে অবস্থান নিলে আখাউড়া পতনের কাছাকাছি চলে আসে। উলেখ ৩ তারিখ গঙ্গাসাগরের যুদ্ধে নিহত আলবার্ট এক্কা এই ফ্রন্টে ভারতের একমাত্র পরম বীর চক্র (বাংলাদেশের বীরশ্রেষ্ঠ সমতুল্য) উপাধি পাওয়া সেনা। তিনি ১৪ গার্ডের সেনা ছিলেন।
মিত্রবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশ দখল করে ফেলে। এতে আখাউড়াতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাক বাহিনী। সামরিক পরিভাষায় একে বলে ঊহপরৎপষবসবহঃ। চতুর্দিক থেকে কোনো বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে ফেললে আর বাইরে থেকে কেউ সাহায্য করতে না এলে তাদের সামনে পরাজয় ছাড়া আর পথ খোলা থাকে না।
আখাউড়া এবং আশেপাশের অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চার ব্রিগেড সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। আরো কিছুদিন যুদ্ধ করার রসদ থাকলেও তাদের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল। এছাড়াও অযথা যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর হাতে খতম হওয়ার চেয়ে আত্মসমর্পণই যৌক্তিক। সব মিলিয়ে ১৬০ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাক সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর ১০-১৫ জন নিহত হয়। নিহতের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান। একজন আর্মার্ড অফিসার হয়েও বীরের ন্যায় তিনি পদাতিক যুদ্ধে অংশ নেন। পাক বাহিনীর শেলের আঘাতে শহিদ হন তিনি। আজমপুর রেলওয়ের সাথেই তার কবর।
বাংলাদেশের মাটিতে সর্বাধিক পরিমাণ কামানের গোলার ব্যবহার এই যুদ্ধে হয়েছিল। প্রায়ই এই অঞ্চলে মর্টার কিংবা কামানের অবিস্ফোরিত শেল উদ্ধার হয়। আখাউড়া দখলের ফলে মুক্তিবাহিনীর ঢাকা অভিযানের পথ সুগম হয়। মুক্তিসেনারা এগিয়ে যেতে থাকে ঢাকার দিকে পাক বাহিনীকে সমূলে উপড়ে ফেলত।
As Pakistani troops occupying Bangladesh in 1971, Freedom Fighters trying to kick out the enemy from the border & move toward the capital. Akhaura, a very strategic point of B Baria is now MuktiBahini's target as it could be an easy access to the capital and even to sylhet & chittagong. Operation Nut Crack begin to recover akhaura!
References
১. ১৯৭১: ফ্রন্টলাইনের সেরা অপারশেন, সারতাজ আলীম (একই লেখকের বইয়ের অংশবিশেষের পরিমার্জিত সংস্করণ)
২. মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান (৪)। সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংগৃহীত সম্মুখযুদ্ধের তথ্যবিবরণী
৩. সাক্ষাৎকার : মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া
৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (৯)
৫. মুক্তিযুদ্ধের সেরা লড়াই- সেজান মাহমুদ
৬. মুক্তিযুদ্ধের দুশো রণাঙ্গন-মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত
৭. কে ফোর্স এস ফোর্স জেড ফোর্স-মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
৮. এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য-জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী
Feature Image: ?