রায়গঞ্জের রেইড: এক ব্যাটেলিয়ন শত্রুর বিরুদ্ধে ৩৫ কমান্ডো

১৯শে নভেম্বর, ১৯৭১ সাল। কুড়িগ্রামের রায়গঞ্জ। সময় রাত ৯-১০টা।

চাঁদ রাত। পরের দিন ঈদ। আতরের বদলে শরীরে বারুদ আর রক্তের গন্ধ মাখতে যাচ্ছে একদম মুক্তি কমান্ডো। পাঞ্জাবির বদলে সাধারণ পোশাক, আর পায়ে নতুন জুতার বদলে জঙ্গল শু। তাদের লক্ষ পাকিস্তানি বাহিনীর রায়গঞ্জ ঘাঁটি। দুদিক থেকে ১৫/২০ জনের দুটি কমান্ডো দল একই সাথে আঘাত হানবে।  পরিকল্পনা মত ১৯ নভেম্বর রায়গঞ্জ দখলের জন্যে দুর্ধর্ষ কমাণ্ডো কায়দায় আক্রমণের উদ্দেশ্যে লেফট্যানেন্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ (বীর উত্তম) এবং লেফট্যানেন্ট আবদুল্লাহ এগিয়ে চলেছেন দলবল নিয়ে…

গল্পের শুরু এক মাস আগে। এরই মধ্যে সমগ্র রংপুর জেলা এবং দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা নিয়ে গঠিত হয়েছে ৬ নং সেক্টর। তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর উইং কমাণ্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার (এম কে বাশার নামে পরিচিত; পরে এয়ার ভাইস মার্শাল এবং বীর উত্তম) সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিমান বাহিনীর এক অফিসার হওয়া সত্বেও তাকে ৬ নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনিও যোগ্যতার সাথে, নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন সেই দায়িত্ব।  দায়িত্ব নিয়েই তিনি নতুন যোদ্ধাসংগ্রহ, পরিকল্পনা, ট্রেনিং এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন।

এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর-উত্তম, credit: jugantor

৬ নং সেক্টরে রয়েছে পাঁচটি সাব-সেক্টর, ভজনপুর, পাটগ্রাম, সাহেবগঞ্জ, মোগলহাট, চাউলাহাটি। এ সেক্টরে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, তা হলো কয়েকটি সাব-সেক্টরের অবস্থান বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ তা দখল করতে পারেনি। ৬ নম্বর সেক্টর সামরিক ও ভৌগোলিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের শিলিগুড়ি করিডর। শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে দেশের অবশিষ্ট অংশের সংযোগরক্ষাকারী একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড। ২১-৪০ কিলোমিটার প্রস্থের এই পথ দিয়েই দেশের বাকি অংশের সাথে উত্তর পূর্বের প্রায় ৩ লক্ষ বর্গকিমি এলাকার যোগাযোগ রক্ষা হয়। যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর হামলার শঙ্কায় ভারতীয় বাহিনীও সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক সেনা মোতায়েন করেছিল।

খাদেমুল বাশারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করেন। সেক্টরের প্রায় ৬০০ বর্গমাইল এলাকা কোনোভাবেই পাকবাহিনী ছিনিয়ে নিতে পারেনি। জুন মাসে এই সেক্টরের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৭০০ মতো, সেই সংখ্যা এখন বেড়ে দাড়িয়েছে ১০ হাজারে। এর মধ্যে ১০০ ই-পি-আর সদস্য, ৭০০ জন পুলিশ, আর অবশিষ্টরা মুক্তিবাহিনী। সেক্টর হেডকোয়ার্টার পাটগ্রামের কাছে বুড়িমারীতে। ৩৫টি গেরিলা ক্যাম্প গড়ে উঠে এই সেক্টরে।

এদিকে ১৯৭১ সালের ৯ই অক্টোবর ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন জলপাইগুড়ি থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে মূর্তি শহরে ১৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণের বা ওয়ার কোর্সের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের সেনা অফিসারদের পাসিং-আউট অনুষ্ঠিত হয়। ৬১ জন তরুন যোদ্ধা এই প্রশিক্ষণ লাভ করে লেফট্যানেন্ট পদবি পান। এদের মধ্যে একজন ছিলেন লেফট্যানেন্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ। তার ডাকনাম ছিল আশফি। যদিও মুক্তিবাহিনীতে তাকে লেফট্যানেন্ট সামাদ নামে চিনত সবাই। ট্রেনিং শেষ করার পর লেফট্যানেন্ট পদ পান সামাদ। তাকে পাঠানো হয় সেক্টর ৬-এর সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে!

‘বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’ এর পাসিং আউট প্যারেডের দিন, Credit: Jugantor

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে পড়তেন। ৩য় বর্ষে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রশিক্ষণ শেষে ৯ অক্টোবর কমিশন লাভ করে পোস্টিং পান ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে। তার সহযোদ্ধা ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম), গাজী গোলাম দস্তগীর (বীর উত্তম), ফতেহ চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ। তার ছোট ভাই ইশতিয়াক আজিজ উলফাতও ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধা। বাবা আজিজুস সামাদকে গ্রেফতার করে পাকবাহিনী চালাতে থাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন। এসবের মধ্যে লেফট্যানেন্ট সামাদ মাঝে মাঝেই বলতেন,

“কবে জানি খরচা হইয়া যাই…..”

কঠোর প্রশিক্ষণ নিতে যেয়ে তার মতিভ্রম হয়েছে বলে মজা করতো সহযোদ্ধারা।

১৩ই অক্টোবর, ১৯৭১। ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম।

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সেক্টরে গেরিলা এবং ঝটিকা হামলাকেই প্রাধান্য দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনী। কিন্তু পাক বাহিনীর বড় ক্ষতি করা যায়নি। অক্টোবরে ধীরে ধীরে পাক বাহিনীকে চিরতরে ঝেটিয়ে বিদায় করার পরিকল্পনা করেন ঊর্ধ্বতনরা।

সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের কমাণ্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন। এই সাব-সেক্টরের সম্মুখভাগের অঞ্চলের নাম ভুরুঙ্গামারী। পাকবাহিনীর শক্ত ঘাটি আছে এখানে। পাকিস্তান সৈন্যরা ভুরুঙ্গামারী কলেজে এবং কলেজ থেকে ৩ প্রায় কিলোমিটার জয়মনিতে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে অবস্থান নিয়েছে। পাক বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাবের একদল সেনা। নেতৃত্বে আছেন একজন মেজর। যুদ্ধে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের খ্যাতি ছিল। ব্রিটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত এই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনেক যুদ্ধ করার ইতিহাস রয়েছে।  নাকের ডগায় শত্রুর এই অবস্থান অসহনীয়। তাই এই দুই ঘাটি আক্রমণের পরিকল্পনা করা হলো।

মানচিত্রে ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম; Image Credit: Google Maps 

পরিকল্পনা মোতাবেক ৩টি দল প্রস্তুত করা হয়। ২টি রেইডিং পার্টি (যারা শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করে বা ধ্বংস করে; কিন্তু এরা সাধারণত ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকা দখল করে না) নিয়ে কলেজে রেইড করা হবে। অপর দলটি নিয়ে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন কভারিং ফায়ার দিবেন। সীমান্তের পেছন থেকে আর্টিলারি সাপোর্ট দিবে মিত্রবাহিনী। সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর সাথে সরাসরি কয়েক দফা গুলিবিনিময় হয়েছিল আগেও। রাত ১২টার আগেই পরিকল্পনামাফিক নিজ নিজ জায়গায় পৌছে গেল মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল নিম্নরূপ:

  1. সুবেদার আব্দুল ওহাবের নেতৃত্বে একদল মুক্তিবাহিনী (রেইডিং পার্টি) ঘাঁটির সম্মুখভাগে সরাসরি চার্জ করবে। এই দলের পেছনে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি ফোর্স অবস্থান নেবে। তাদের গোলাবর্ষণের কাভারে আক্রমণ করবে মুক্তিসেনারা।

  2. হাবিলদার সোনামিয়া এক প্লাটুনের বেশি সৈন্য নিয়ে সম্মুখভাগে সুবেদার ওহাবের দলের ঠিক পেছনে থাকবেন ফাইটিং পেট্রল পার্টি হিসেবে।

  3. ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে সুবেদার ওহাবের এবং ফাইটিং পেট্রল পার্টির পেছনে থাকবে। এদের বলা হয় রিয়ার পার্টি। বিপজ্জনক অবস্থায় উইথড্র বা পিছু হটতে এই দলের ভূমিকা অনেক বেশি। অন্য দলগুলো যখন সামনে থেকে হামলা করে ফেরত আসবে, তখন যেন পাক শত্রু পিছু না নিয়ে হামলা না করে বসে, সেটা নিশ্চিত করবে এই দল।

  4. জয়মনিরহাট এবং রায়গঞ্জের মাঝে সি এণ্ড বি সড়কে কাট-অফ পার্টি হিসেবে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অবস্থান নিয়েছে আজহার আলীর নেতৃত্বে। এদিক থেকে যেকোনো রসদ সরবরাহ অথবা সাহায্য আসা বন্ধ করবে এরা।

  5. রায়গঞ্জ এবং নাগেশ্বরীর মধ্যস্থলে আজিজের (সম্ভবত আব্দুল আজিজুল হক, বীর প্রতীক) নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য সিএণ্ডবি সড়কে ডিফেন্স নিয়েছে। এরাও কাট-অফ পার্টি।

  6. মুক্তিবাহিনীর প্রায় ২০০ জন সদস্য সুবেদার মাজহারুল হকের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে জয়মনির হাট আক্রমণ করবে। সুবেদার আরব আলীকে রাখা হয়েছে এই দলকে সাহায্য করার জন্যে।

  7. ভুরুঙ্গামারী ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাবে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের বাহিনী।

সার্বিক নেতৃত্বে থাকবেন কমাণ্ডার এম কে বাশার এবং মিত্র পক্ষের ব্রিগেডিয়ার যোশী থাকবেন সীমান্তের ওপারে আর্টিলারির নেতৃত্বে।

ভুরুঙ্গামারী আক্রমণের মানচিত্র (মাপবিহীন), ১৯৭১ ফ্রন্টলাইনের সেরা অপারেশন; Image Credit: Google maps

রাত ১টা অর্থাৎ ১৪ই অক্টোবর। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার শুরু হলো পাক অবস্থানের ওপর। ভারতের সীমানার ভেতর থেকেই আর্টিলারি চার্জ করে মিত্রবাহিনী। একটানা গোলাবষর্ণের কাভার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো মুক্তিসেনারা।

শক্রর প্রতিটি ভারি মেশিনগানসহ বাংকারে ২ জন এবং পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণায় (বর্তমানে এই পুকুরের অবস্থান কোথায় নিশ্চিত হওয়া যায়নি, সময়ের সাথে সাথে ভরাটও হয়ে যেতে পারে) ২ জন ক্রলিং করে গিয়ে একসাথে পর পর ৩টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে মেশিনগানসহ বাংকারগুলো উড়ে যায়। এর পরই মুক্তিযোদ্ধারা হালকা মেশিনগান এবং রাইফেল ঠেলে ফায়ার করে পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে করতে কলেজের মধ্যে প্রবেশ করেন। আকস্মিক আক্রমণে কলেজে অবস্থানরত পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। শক্র গুলি ছুড়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে তারা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এ আক্রমণে ২৫ পাঞ্জাবের ১ জন মেজরসহ (কোথাও ক্যাপ্টেন বলা) ১৫-২০ জন পাকিস্তানি নিহত এবং ১০-১২ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অতি দ্রুত ফুলকুমার নদ অতিক্রম করে পূর্বনির্ধারিত নিরাপদ জায়গায় ফিরে যেতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

জয়মনিরহাটে সুবেদার মাযহারুল হকের সৈনিকেরা তছনছ করে দেয় পাক অবস্থানগুলো। ভুরুঙ্গামারীতে একই ঘটনা ঘটলো। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালো প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেই। শুরু হলো ব্যাপক লড়াই। আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণ চলছে। এদিকে রাত প্রায় শেষের দিকে। সকাল ৭টায় মুক্তিসেনাদের আক্রমণের মুখে ঘাটি ছেড়ে পালালো খানসেনারা। প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ মুক্তিদের দখলে এলো। পাকিস্তানের ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৮ জন সৈন্য এবং একজন আর্টিলারি অফিসার (ক্যাপ্টেন) বন্দী হলো। নিহত হলো বেশ কয়েকজন। এই হেডকোয়ার্টারের একটি কক্ষে বন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হলো ১৫ জন বাঙালি যুবতীকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে এদের উপর নির্যাতন করেছে নরপশুরা। কিন্তু এই দুই ঘাঁটি দখলের পরও পাকসেনারা নির্মূল হলো না। এখান থেকে পালিয়ে তারা অবস্থান নিল রায়গঞ্জে, সেখানে আরো শক্ত-ঘাঁটি তৈরি করল। এরই মধ্যে ৬০০ বর্গকিমি এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।

রায়গঞ্জ ভুরুঙ্গামারী থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিবাহিনীর হাতে নাস্তাবুদ হবার পড় সেখান থেকে দ্রুত পাক বাহিনী পিছু হতে। নিকটতম ঘাঁটি রায়গঞ্জে চলে যায় তারা। আগে থেকে সেখানে কিছু সেনা ছিল। তাদের সাথে মিলে শক্ত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যায় তারা। সেখান থেকে তারা মুক্তিবাহিনীর উপর পাল্টা হামলা করতে পারে। এদিকে তাদের উপরও মুক্তিবাহিনীর  আঘাত হানবে নিশ্চিত ছিল তারা।

এদিকে ভুরুঙ্গামারীতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে থাকে মুক্তিবাহিনী। পাশাপাশি দুই এলাকা ছিল দুই বাহিনীর দখলে। মাঝে মাঝেই ভুরুঙ্গামারীর সাথে রায়গঞ্জ এবং নাগেম্বরীর সীমানা এলাকায় মুক্তি এবং পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হতো। সব মিলে এই এলাকা ফ্রন্টলাইনে পরিণত হয়।

২৩শে অক্টোবর নাগেশ্বরীতে পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের জনসভায় GF Rifle থেকে গ্রেনেড ছুঁড়ে ৪-৫ পাকসেনাকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী এবং জনসভা পণ্ড করে দেয়। 

নভেম্বেরের ১৩ এবং ১৪ তারিখ

নাগেশ্বরী- ভুরুঙ্গামারী সড়ক; credit: GOOGLE MAP

বিছিন্ন করতে অভিযান চালান ক্যাপ্টেন আজিজ। ২ জন পাক সেনাকে আটক করা হয় এখান থেকে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আটক সেনাদের ছবি প্রকাশ হলে এই অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে পাক বাহিনী মুক্তিবাহিনিকে হটাতে পাক বাহিনীর অভিযানের শঙ্কা বেড়ে যায়।

১৬ নভেম্বর নাগেশ্বরীতে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী। নিহত হয় ৭৩ জন নিরীহ মানুষ।

১৯শে নভেম্বর, ১৯৭১ | রায়গঞ্জ

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাই রায়গঞ্জ আক্রমণ অতি জরুরী হয়ে দাঁড়াল। ছোট কিন্তু ক্ষিপ্র গতির এক বাহিনীকে প্রস্তুত করে মুক্তিবাহিনী। বাছাই করা হয় প্রায় ৩০-৩৫ জন কমান্ডো।  বাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। দুই দিক থেকে যেয়ে পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেলা হবে। ১৯ নভেম্বর রাতে রায়গঞ্জ দখলের জন্যে দুর্ধর্ষ কমাণ্ডো কায়দায় আক্রমণের উদ্দেশ্যে লেঃ সামাদ এবং লে. আবদুল্লাহ্ এগিয়ে যান কমান্ডোদের নিয়ে। ভুরুঙ্গামারী থেকে রাত ৯টায় নিঃশব্দে বেরিয়েছে এই দু’দল। লে. সামাদের গ্রুপে আছেন কমান্ডো কাসেম, মাহবুব এবং অন্যান্যরা। এবং লে. আবদুল্লাহর গ্রুপেও আছেন ১৫ জন কমান্ডো। অন্যদিকে একটি সুশিক্ষিত দুর্ধর্ষ বাহিনী হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের খ্যাতি আছে। আগের যুদ্ধগুলোতেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

রায়গঞ্জে পাক অবস্থানগুলোকে মাঝে রেখে দু’দিক থেকে দুই গ্রুপ এগিয়ে যাচ্ছে। কমান্ডার দু’জন ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন। আগে থেকেই নির্ধারণ করা আছে যে, শত্ৰু-সীমানার ৫০০ গজ ভেতরে গিয়েই পরস্পরের অবস্থান জানিয়ে দেবে তারা। তারপর পাকবাহিনীর উপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

শীত পড়তে শুরু করেছে তখন। শীত আর পাক বাহিনীর যন্ত্রণায় সন্ধ্যার পর খুব দরকার ছাড়া বের হয় না কেউ। পৃথিবী যেন নিস্তব্ধ। শার্ট, প্যান্ট, আর চাদর পড়া মুক্তি কমান্ডোদের সাধারণ বেসামরিক মানুষের মতই মনে হয়। তবে ভুলটা ভাঙবে পায়ের দিকে তাকালে – সবাই জঙ্গল শ্যু পড়া। মূল রাস্তা এড়িয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায় দুই দল। ভৌতিক ছায়ার মতো অগ্রসর হতে থাকে তারা। পরের দিন ঈদ। পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকা সবাই আনমনে হয়তো আগামী ঈদের কথা ভাবছিলেন। এই বছর হানাদার তাড়িয়ে আগামীবার পরিবারেরের সাথে ঈদ করবে সবাই!  সেই আশায়ই পাকবাহিনীকে তাড়াতে মৃত্যুর সাথে খেলতে যাচ্ছেন তারা!

প্রায় ৭৫-৮০ মিনিট পথ চলার পর লে. সামাদ রায়গঞ্জ ব্রিজের কাছে এসে থমকে দাড়ালেন। গোয়েন্দা তথ্যে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, বড় ভুল হয়ে গেছে। ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা ব্রিজের পাশে বাংকারে খুঁড়ে অবস্থান নিয়েছে। লাইট মেশিনগান আর মর্টার নিয়ে অবস্থান নিয়ে রীতিমতো ফাঁদ তৈরি করেছে। সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন লে. সামাদ এবং তার দল।

মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে এক সেকেন্ড তফাৎ। লে. সামাদ যে বুঝে গেছেন সামনে পাক বাহিনী, এটা পাকবাহিনী ধারণা করতে পারিনি তখনও। তাদের ইচ্ছা ছিল আরেক পা সামনে এলেই তারা গুলি চালাবে। লে. সামাদ ছোট্ট করে শিস বাজিয়ে সংকেত দিলেন। সাথে সাথে কমান্ডোরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ল। পাকবাহিনী দেখল মুক্তিবাহিনী তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকলে সবাইকে গুলিতে খতম করা যেত। পাকবাহিনী দেরি না করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এদিকে মুক্তি কমান্ডোরাও শুয়ে পজিশন নিয়েছেন।

ওয়্যারলেস সেট ওপেন করে লে. সামাদ দ্রুত বার্তা পাঠালেন লে. আবদুল্লাহকে। এদিকে তীব্র গুলি আরম্ভ করেছে পাকবাহিনী। মেশিনগান আর মর্টারে কেঁপে উঠছে এলাকা। দুই বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব খুব কম। অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে উঠল পাকবাহিনী যখন আর্টিলারি ফায়ার করা শুরু করে। অবস্থা চরম বিপজ্জনক। শুরু হলো জীবন-মৃত্যুর ভয়াবহ লড়াই। কিন্তু কমান্ডোদের ভয়ডর নেই। লে. সামাদও বললেন,

“কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে একসাথে বাঁচব।”

মুহূর্মুহূ মর্টার, শেল, আর বুলেট এসে আঘাত হানছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে। কিন্তু কমাণ্ডারের আদেশ কেউ অমান্য করছে না। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শেষ বুলেট পর্যন্ত লড়াই করছে তারা। পাক বাহিনীর দিকেও গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছে তারা। পাশে থেকে লুটিয়ে পড়ছে সহযোদ্ধার দেহ, মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পাশের জনকে বলছে, যুদ্ধ চালিয়ে যাও। অন্যদিকে তখন লে. আবদুল্লাহ্ দ্রুত অবস্থা বুঝে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে খবর পাঠালেন। সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশারের নেতৃত্বে মূল বাহিনী দ্রুত এগিয়ে এলো রায়গঞ্জের দিকে। মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার যোশীও আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে এগিয়ে এলেন।

লে. সামাদ আর তার বাহিনী শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে রাতভর ঠেকিয়ে রাখল ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে। পাকবাহিনী এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতে পারল না। ২০ তারিখ ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কামান ও আর্টিলারি দিয়ে পাকবাহিনীর উপর মরণ আঘাত হানতে থাকলেন কমান্ডার বাশার। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক আক্রমণে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা ছিন্নভিন্ন হয়ে পরাজয় মেনে নিল। ২১ তারিখ ভোরে জীবিত পাক সৈন্যরা পালিয়ে গেল পাঁচ মাইল দূরে নাগেম্বরীতে। রায়গঞ্জ দখলের পর ব্যাপক এলাকা মুক্তিযাদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

এই যুদ্ধে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অন্তত ৩০০ সৈন্য হতাহত হয়। রণাঙ্গনেই পড়েছিল ৩০-৩৫ জনের মৃতদেহ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গর্ব ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে বিলুপ্তের খাতায় উঠিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা। লে. সামাদ আর তার ১৫-২০ জন সহযোদ্ধা মুক্তিসেনা যেভাবে বীরবিক্রমে লড়াই করেছেন, তা পৃথিবীর যেকোনো বীরত্বব্যঞ্জক লড়াইয়ের সমতুল্য। লে. সামাদের গ্রুপের মাহবুব ও কাশেম শুধু ফিরে আসেন জীবিত অবস্থায়। বাকিরা মৃত্যুর আগেও গুলি ছুঁড়ে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করেছেন।

এ যুদ্ধ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশলের একটি বড় পরীক্ষা এবং ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের জন্য একটি বড় পরাজয়। কেননা, ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল পাকিস্তানের গর্ব। তাদের সে গর্ব চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টেকে পর্যুদস্ত ও পশ্চাৎপসারণে বাধ্য করে। ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা সেদিন এক ব্যাটালিয়ন সেনার বিরুদ্ধে যে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছেন, পৃথিবীর যেকোনো বীরত্বসূচক লড়াইয়ের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে।

লেফট্যানেন্ট সামাদ; credit: Wikimedia Commons

২১ তারিখ ভোরে রায়গঞ্জ ব্রীজের কাছে লেফট্যানেন্ট সামাদের লাশ পড়ে থাকতে দেখলো সবাই। প্যান্টের সাথে হাফ শার্ট পরনে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উপুড় হয়ে পড়ে আছেন লেফট্যানেন্ট সামাদ।  জীবিত অবস্থায় যেমন বীর বিক্রমে লড়াই করেছেন তেমনি বীরের মত মরণে পরেও মাতৃভূমিকে গভীর আলিঙ্গণে জড়িয়ে রেখেছেন তিনি। তার হেলমেট ভেদ করে একটা গুলি মাথায় বিদ্ধ হয়েছিল। সেক্টর কমাণ্ডার বাশার সামরিক কায়দায় ডান হাত তুলে স্যালুট করলেন তাকে। সাথে সাথে স্যালুট করলো সবাই। এই বীর যোদ্ধাদের সাহায্য করতে এগিয়ে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা দুভাইও মৃত্যুবরণ করেছিলেন। জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে এদের সবাইকে কবর দেয়া হয়। এদিকে রাজাকাররা গুজব রটিয়ে দেয় লে সামাদের জানাজা পড়ালে ওই ইমামের কপালে দুঃখ আছে। সবকিছু বিবেচনা করে ভারত থেকে একজন ইমাম এসে তাদের জানাজা পড়ান। ৪১ বার গান স্যালুটের সাথে সাথে রণাঙ্গনে বেজে ওঠে বিরহের সুর। শহীদদের জানাজা ও দাফন সেরে যুদ্ধের ময়দানের দিকে এগিয়ে চললো বাঙালি সৈনিকেরা। চোখে সহযোদ্ধা হারনোর অশ্রু নিয়ে মুক্তিবাহিনী সামনের দিকে এগিয়ে যায়। লেফট্যানেন্ট সামাদকে বীর উত্তমে ভূষিত করা হয়।  তার স্মরণে ভূরুঙ্গামারীর জয়মনিরহাট ইউনিয়নের নাম রাখা হয় সামাদনগর। 

As Bangladeshi freedom fighters tried to outrun the enemy and head toward the capital city Dhaka in 1971, they started raiding enemy positions near the border first. Rayganj, a place in the Kurigram district was a stronghold of the enemy. 35 commando advanced to raid that position. Soon the commando team found themselves encircled by roughly 1 battalion of enemy soldiers. The article discusses the Rayganj raid.

Featured Image Credit: Al Jazeera (Metaphoric image)

References:

  1. মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান(৫)। সামরিকবাহিনী কর্তৃক সংগৃহীত সম্মুখযুদ্ধের তথ্যবিবরণী
  2. সাক্ষাতকার এয়ার ভাইস মার্শাল এম কে বাশার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র
  3. রংপুর ও কুড়িগ্রামে ১৯৭১ সালে গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর(৩য় পর্ব) দৈনিক প্রথম-আলোতে ০৪/১২/২০১৯ এ প্রকাশিত
  4. মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

Related Articles

Exit mobile version