Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একাত্তরের বিস্মৃত অধ্যায়: কুমিরার দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ (২৬-২৮ মার্চ)

উত্তাল একাত্তর। শুরু হয়ে গেছে দুর্বার মুক্তিযুদ্ধ; স্বাধীনতা সংগ্রামের তরে অসম এক লড়াই। সুসংগঠিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অপ্রস্তুত নিরীহ বাঙালীর উপর। যেখানেই যাচ্ছে তারা জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে সব, যেখানেই পাচ্ছে যাকে বানিয়ে দিচ্ছে শব। ২৫ মার্চ রাত শেষ হবার আগেই নিদারুণ বর্বরতায় ঢাকার উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে কুমিল্লার দিক থেকে চট্টগ্রামের দিকে ধেয়ে আসছে ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের একটি বিশাল কনভয়। বাঁধা দেওয়ার জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো ১০২ জন যোদ্ধার ছোট্ট একটি দল।

২৬ মার্চ, ১৯৭১। তোপখানা রোডের এই দৃশ্যের মতোই এদেশের নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনী; © Rashid Talukder/Muktijuddho e-Archive

বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআরের সমন্বয়ে গঠিত এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রুখে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা। যে করেই হোক পাক বাহিনীর চট্টগ্রাম অভিমুখী এই যাত্রাকে হয় থামিয়ে দিতে হবে, নতুবা যথাসম্ভব বিলম্বিত করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড ও ভাটিয়ারীর মাঝামাঝি এক স্থানে, শিল্প এলাকা কুমিরায়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে কুমিরার এই প্রাথমিক প্রতিরোধ এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেসব প্রতিরোধ যুদ্ধ পাকিস্তানিদের হকচকিত করে দিয়েছিল, ভাঁজ ফেলেছিল তাদের ললাট রেখায়, কুমিরার যুদ্ধ ছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম, তিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা, কক্সবাজার আর ফেনীর মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত ছিল ১ নং সেক্টরের বিস্তৃতি; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস-সেক্টর এক

২৬ মার্চ, বিকেল পাঁচটা। অস্তাচলের ওপারে হারিয়ে যাচ্ছে বসন্তের রক্তিম সূর্য। আঁধার ঘনিয়ে আসছে পূর্ব পাকিস্তানের বুকে। বিগত রাতের বিভীষিকার শঙ্কায় কাঁপছে জনপদ। কিন্তু মুক্তিকামী জনতার বুকে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন তা তো কাঁপবার নয়। দুরুদুরু বুকে লালন করা মুক্তির চেতনা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করছে। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় এ দেশবাসী ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী। জায়গায় জায়গায় ফুঁসে উঠছে সেই দ্রোহের অনল। চট্টগ্রাম থেকে উত্তরে ২০ কিলোমিটার দূরের শহরতলী কুমিরা। কুমিরার উত্তরে পাহাড়শ্রেণী, আধ মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর; মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এখানেই প্রতিরোধের জন্য অবস্থান নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা যে সংখ্যাতেই কেবল কম ছিল তাই নয়, অস্ত্রশস্ত্রও ছিল অপ্রতুল।

কী ছিল তাঁদের কাছে? বলার মতো কিছুই না। একটি মাত্র এইচএমজি, গুটিকয়েক এলএমজি আর বাকিসব রাইফেল। এত অল্প সংখ্যক সৈন্য আর অস্ত্র নিয়ে পুরো একটি সুসংগঠিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার ঝুঁকি যে কী বিরাট আর তার পরিণাম যে কী মারাত্মক ভয়াবহ হতে পারে তা খুব সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তারপরেও আমাদের বীরযোদ্ধারা দাঁড়িয়েছিল অসম শক্তির বিপরীতে, ভয় করেনি মৃত্যুকে, মায়া করেনি নিজের অমূল্য প্রাণকে।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কুমিরা ছিল (চিহ্নিতকৃত) ১ নং সেক্টরের তবলছড়ি সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রতিকূল এলাকা; © লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম বীর প্রতীক

কুমিল্লা সেনানিবাসস্থ ৫৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির কাছে জেনারেল অফিসার ইন-কমান্ড (জিওসি) টিক্কা খানের কাছ থেকে আদেশ আসে- একটি শক্তিশালী সেনাদল নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার। কারণ, চট্টগ্রামে হাজার পাঁচেক বাঙ্গালী সৈন্যের বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা সৈন্য সংখ্যা ছিল মোটে ছয়শ’। যতক্ষণ ইকবাল শফি তার সৈন্য নিয়ে এখানে এসে না পৌঁছায় ততক্ষণ চট্টগ্রামে অবস্থানরত ২০ বালুচ রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতেমিকে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়।

ব্রিগেডিয়ার শফি তার ব্রিগেডের অধীন ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের সাথে ইঞ্জিনিয়ার, সিগন্যাল, ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী একটি রেজিমেন্ট এবং অন্যান্য ইউনিটের সৈনিকদের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে ২৫ মার্চ সন্ধার পর পর সড়কপথে রওয়ানা হয়। চট্টগ্রাম অভিমুখে ৮০ থেকে ১০০ গাড়ির সে এক বিশাল কনভয়। এফএফ রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে- এই ভয়াবহ তথ্যটি কুমিল্লা থেকে সিগন্যাল বিভাগের মেজর বাহার চট্টগ্রামের টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমে সেক্টর অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে জানালে তিনি তৎক্ষণাৎ নায়েক সুবেদার মুসাকে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে হালিশহর থেকে শুভপুরের দিকে রওয়ানা হতে নির্দেশ দেন।

মেজর রফিকুল ইসলামঃ ১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস-সেক্টর এক

কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব একশ’ মাইলের কিছু বেশি। এই শতাধিক মাইলের মহাসড়কটি অসংখ্য কালভার্ট ও অনেক ছোট ছোট সেতুতে ছিল অবিচ্ছিন্ন। মুক্তিকামী মানুষ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাহসী যোদ্ধাদের সহায়তায় পথের এই অবিচ্ছিন্ন ধারায় ছেদ ঘটায়। যেভাবেই হোক, বাঁধা দিতে হবে যে ধেয়ে আসা হানাদারদের। আর তাই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ফেনী নদীর উপরে নির্মিত শুভপুর সেতুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়। বাঙালীর এই প্রতিরোধের মুখে শত্রুবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে (তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে) শুভপুর সেতু অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়।

মেজর জেনারেল খাদিম রাজার নির্দেশ মোতাবেক ব্রিগেডিয়ার শফি তার পদাতিক সৈন্যদের নিয়ে ২৬ মার্চ সকাল ১০টায় নদী পার হয়ে পুনরায় চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করে। পিছে শুভপুর ব্রিজ মেরামতের জন্য মর্টার ও ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটের সাথে রেখে যায় বহরের কিছুসংখ্যক সৈন্য। এদিকে মুক্তিবাহিনী শত্রুর (ফেনীর কাছে) শুভপুর ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে আসার খবর পেয়ে যায়।

ক্যাপ্টেন রফিকের পরামর্শে প্রস্তুত হয়ে যায় ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে থাকা ছোট্ট মুক্তিসেনার একটি দল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের হোল্ডিং কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া ১০২ জন সৈন্য নিয়ে কুমিরার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার আদেশে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী পাঁচটি সাধারণ পরিবহন ট্রাক এনে হাজির করলো। ক্যাপ্টেন তাঁর দলকে চারটি ট্রাকে তুলে বাকি ট্রাকটিতে গুলির বাক্স উঠিয়ে রওয়ানা হলেন যুতসই একটা জায়গা খুঁজে বের করার জন্যে। তিনি নিজে একটি মোটর সাইকেলে চড়ে সবার আগে আগে রেকি করতে লাগলেন।

সেই যাত্রাপথের দৃশ্য ছিল অবিস্মরণীয়। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া পরবর্তীতে “মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস” নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর মুখেই শুনুন না হয় কিছু কথা…

“রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমিয়েছে। তাদের মধ্যে কল-কারখানার শ্রমিকই বেশী। মুখে তাদের নানান শ্লোগান। হাজার হাজার কণ্ঠের সেই শ্লোগান আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলছিল। গতরাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বর্বর বাহিনী কর্তৃক অতর্কিত আক্রমণ, নির্মম হত্যা, পাশবিক অত্যাচার, বিশেষতঃ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদেরকে পাশবিকভাবে হত্যা করার খবর এরই মধ্যে প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে। যে-কোনভাবে এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত। সুতরাং যখন দেখতে পেল খাকি পোশাক পরা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই-পি-আর’এর জওয়ানরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মুহুর্মুহু তারা শ্লোগান দিতে লাগল- জয় বাংলা, বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিন্দাবাদ, ই-পি-আর জিন্দাবাদ। এদিকে তাদের কেউ কেউ সৈন্যদেরকে কি দিয়ে এবং কিভাবে সাহায্য করতে পারবে তাই নিয়ে মহাব্যস্ত।আমাদের সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলি তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। এমন সময় একজন বুড়ো লোক তার পথের পাশের দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিল। বললোঃ “স্যার, আমি গরীব মানুষ, কিছু দেওয়ার মত আমার ক্ষমতা নেই, এই নিন আমার দোকানের সিগারেট (সিগারেট ৩ কার্টুন ছিল); আপনার জওয়ানদের মধ্যে বিলিয়ে দিন।” বৃদ্ধের এই সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠল। আর একজন একটি ট্রাকে করে প্রায় এক ড্রাম কোকাকোলা নিয়ে এল। কেউ কেউ খাদ্যসামগ্রীও নিয়ে এলো।” 

একাত্তরে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া; © মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস, মেজর জেনারেল (অব.) এম এস এ ভূঁইয়া

পুরো ঘটনাটিকে এবার একজন হোমিও চিকিৎসকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাক। কানাই লাল চক্রবর্ত্তী কুমিরার বাসিন্দা। তিনি তাঁর “শরণার্থীর দিনলিপি” নামক স্মৃতিচারণমূলক বইতে উল্লেখ করেছেন,

“পূর্বরাত্রে (২৫/৩/৭১) শুনিয়াছিলাম, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে নাকি সাধারণ গুলি-গোলা ও গণ্ডগোল হয়েছে বাঙালী ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে। এর বেশ কিছু নয়। কিন্তু শেষ রাতে ঘুম থেকে আমাকে (লিখক স্বয়ং) জাগিয়ে দেওয়ার পর শুনিতেছি, অসম্ভব সোরগোল। আমার বাড়ীর নিকটে পূর্ব্বদিকে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের উপর বড় কুমিরা বাজার ও উক্ত বাজারেই আমার হোমিও ডিসপেনসারী। বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে গেলাম ও প্রভাতের সামান্য প্রাতরাশ সারিয়া অবসর হওয়ার সাথেই দেখি অনেক মিলেটারী, মানুষজন ও কিছু সংখ্যক গুলিগোলা ইত্যাদি। বাজারের রাস্তা, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড লোকে লোকারণ্য, শুধু বলাবলি ও দৌঁড়াদৌড়ি করিতেছে।… আরও শুনিতেছি: একদল পাঞ্জাবী সরকারী সৈন্য পায়দলে উত্তর দিকে হইতে (কুমিল্লার দিক হইতে) চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হইয়াছে। … শুনিতেছি, বাঙালী সৈন্যরা কুমিরা রেলওয়ে ষ্টেশনের সংলগ্ন যক্ষা হাসপাতালে ঘাঁটি করিয়াছে। বাজার হইতে ইহার দূরত্ব প্রায় আধ-মাইল।”

সন্ধ্যা ছয়টা। কুমিরায় পৌঁছে গেছে মুক্তিযোদ্ধারা। এখন শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করতে হবে। মহাসড়কের পূর্বদিকে চন্দ্রনাথ পাহাড় শ্রেণী আর পশ্চিমে আধা কিলোমিটার দূরে সমুদ্র। পাহাড় ও সাগরেরর মধ্যে দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি নয়। অতএব শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধকতা আছে। সামনে এগোতে হলে তাদের পাকা রাস্তা তথা মহাসড়ক ধরে সরাসরি আসতে হবে।

ক্যাপ্টেন সুবিদের আদেশে শুরু হয়ে গেল রণ প্রস্তুতি। প্রথমে কুমিরা স্কুলের মাঠকে আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাজার এবং বসতির কথা চিন্তা করে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। নতুন পরিকল্পনা মোতাবেক এমএন পালের ইটখোলা (বর্তমানের কুমিরা বালিকা বিদ্যালয়) থেকে আক্রমণ করা হবে। বাঙ্কার খোঁড়া হলো অনেকগুলো। যে জায়গাটা পজিশন নেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হল তার ৫০০ কী ৬০০ গজ পিছনে ছিল একটি খাল। উদ্দেশ্য, পর্যায়ক্রমিকভাবে পশ্চাদপসরণ প্রক্রিয়ায় যেন খালের পাড়ে বিকল্প প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করা যায়। যদিও খালটি পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন একটা বাধা নয়। তবু এটা পিছনেই রাখা হল।

তিনি তাঁর তিন প্লাটুন কম্যান্ডারকে ডেকে সংক্ষেপে যুদ্ধের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন। সেই মোতাবেক সবাই দ্রুত যার যার আদিষ্ট পজিশনে অবস্থান নেওয়া আরম্ভ করলো। একমাত্র হেভি মেশিনগানটি (এইচএমজি) ফিট করা হলো উত্তরদিকের পাহাড়ের ঢালুতে। ইপিআরের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার মুসার উপর এই এইচএমজির দায়িত্ব অর্পিত হল। ক্যাপ্টেন বামদিকের কয়েকটি এলএমজির পজিশন ঠিক করে দিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দক্ষিণ, উত্তর এবং পূর্বদিকে (চট্টগ্রামের দিকে) অনেকটা ইংরেজি U (ইউ) অক্ষরের মতো সবাই অবস্থান নিল। অর্থাৎ ডানে, বাঁয়ে এবং পিছনে মুক্তিযোদ্ধারা আর যেদিক থেকে (কুমিল্লার দিক থেকে) শত্রু এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটা হাঁ করে থাকা সাঁড়াশির মতো খোলা।

মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ৭০ কী ৮০ গজ সামনে একটি বড় গাছ ছিল। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় সেই গাছের মোটা ডাল কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেলা হল। রাস্তার আশপাশ থেকে ইট এনে মহাসড়কের উপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হল। অতি অল্প সময়ের ভিতর আশ্চর্যজনকভাবে একটা সুন্দর ব্যারিকেড তৈরি হয়ে গেলো। মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দেওয়া হলো যে, শত্রুসৈন্য যখন ব্যারিকেড সাফ করতে গাড়ি থেকে নামবে এবং সাফ করার জন্য একত্রে জমা হবে তখন সবাই একযোগে গুলি ছোড়া আরম্ভ করবে। বিশেষ করে উত্তর পাহাড়ে ফিট করা এইচএমজি থেকে অবিরত গুলিবর্ষণ হতে থাকবে। এহেন কার্যকরী ‘নির্দয়’ অর্ডার দিয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য শত্রুহননের অপেক্ষায় রইলেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া।

এদিকে ২৬ মার্চ সন্ধায় ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি তার সৈন্যদের নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে মাত্র বিশ কিলোমিটার দূরের কুমিরার কাছাকাছি এসে পৌঁছান। ছোট কুমিরার গুল আহমদ জুট মিলের গেটে এক বিহারি দারোয়ান তাদের সর্তক করে দিল, ‘দুশমন সামনে হ্যায়’। কিন্তু ইতোমধ্যেই ছোটোখাটো বাধা অতিক্রম করে এ পর্যন্ত পৌঁছে ইকবাল শফি বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। আর তো মোটে ৪৫ মিনিট; তারপরই সে তার বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছে যাবে এবং সেখানে অবস্থানরত ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার সাথে যোগ দিয়ে বাঙালীর সম্মিলিত প্রতিরোধ মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। ধূলিসাৎ করে ফেলা হবে বাঙালীর স্বাধীনতার তিলোত্তমা আকাঙ্ক্ষাকে।

অন্যদিকে কুমিরা পৌঁছেই ক্যাপ্টেন সুবিদ মোটর সাইকেলযোগে একজনকে পাঠিয়ে দিলেন শত্রুর অগ্রগতির খবর নিতে। তিনি জানেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনীর একটা বিশাল রিইনফোর্সমেন্ট আসছে। কিন্তু তারা আসলে কারা, কোন ব্যাটালিয়ন সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু জানেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এলো যে, শত্রু তাঁদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) অবস্থানের থেকে বেশী দূরে নেই। মাত্র চার কী পাঁচ মাইল দূরে। তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে আসছে। যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল সে পাঞ্জাবীদের নিকটে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছে। সে জানালো, পাঞ্জাবীদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো ব্যাজ এবং কাঁধের উপর কী যে একটা সেটাও কালো। তখন ক্যাপ্টেনের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছে। প্রায় একটা ঘণ্টা কেটে গেলো শত্রু হননের প্রতীক্ষায়।

সন্ধ্যা তখন ৭টা। ধীরে ধীরে সগর্জিত হচ্ছে ইঞ্জিনের আওয়াজ, নিরেট পিচ কামড়ে আসছে এক বিশাল বহর। হঠাৎ থেমে গেলো সব আওয়াজ। কারণ সামনে যে ব্যারিকেড। কিছু সংখ্যক সিপাহি নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলো। তারা ইটগুলো তুলে দূরে ফেলে দিতে লাগলো। কনভয়ের পিছনের গাড়িগুলোও ততক্ষণে চলে এসেছে জায়গামতো। সোয়া সাতটা। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত এমনি সময়ে গর্জে উঠলো ডানদিকের এইচএমজি। সাথে সাথে গর্জে উঠলো অন্য মারণাস্ত্রগুলোও। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লো সামনের সারির সবক’টা।

মৃত্যুকাতর আর্তনাদ আর দিশেহারা ছুটাছুটিতে হকচকিত পাকিস্তান আর্মি। অবিশ্রাম গুলিবর্ষণে একের পর এক লাশ পড়ছে মহাসড়কের নিষ্প্রাণ পিচের উপরে। এদিকে প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে মেশিনগান, মর্টার আর আর্টিলারি থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বেঁধে গেলো দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। বহু চেষ্টা করেও শত্রুরা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করতে পারল না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিন ট্রাকে আগুন ধরে গেলো। হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র মেশিনগানটি নিউট্রালাইজ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করলো। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেলো। প্রায় দু’ঘণ্টার প্রাণপণ লড়াই শেষে পাক আর্মিরা দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলো।

২৬ মার্চের এই খণ্ডযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর চরম ক্ষতিসাধিত হয়েছিলো। তাদের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ার ও একজন লেফটেন্যান্টসহ ১৫২ জন সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারায়। সাথে দু’ট্রাক অ্যামুনিশন মুক্তিযোদ্ধাদের কব্জায় আসে। আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের চৌদ্দজন বীরযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। কুমিরায় লড়াই চলেছিল সর্বমোট তিনদিন। প্রথমদিনে হেরে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে তারা আবার আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। আর্টিলারি আর মর্টার দিয়ে গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকে তাদের।

অবশেষে ২৮ তারিখে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় পাক আর্মিরা। পিছন থেকে নৌবাহিনীর গানবোট ফায়ার সাপোর্ট দেয়। রাতের আঁধারে শত্রুরা পাহাড়ের উপর অবস্থিত টি.বি. হাসপাতালের নিকটে মেশিনগান বসায়। শেষতক পিছু হটে যায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাগণ। পতন হয় কুমিরার। হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। যাওয়ার পথে রাস্তার দু’পাশের সমস্ত গ্রাম ও হাটবাজার জ্বালিয়ে দেয়। সামনে যাকে দেখে তাকেই গুলি করে হত্যা করে। বার আউলিয়া মাজারের উত্তরে মাউধ্যার হাটে দুটো চা দোকানের ভিতরে সাত জন বাঙালিকে শিকল দিয়ে বেঁধে দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়।

লোকমুখে শোনা যায়, কুমিরা পতনের পর রাস্তার দু’পাশে নাকি কয়েকদিন ধরে আগুন জ্বলেছিল। কুমিরার যুদ্ধে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের আপাত পরাজয় হলেও এটাই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর পাকিস্তান আর্মির উপর হানা সম্মিলিত আক্রমণের প্রচণ্ড আঘাত। তিন দিনের এই যুদ্ধে গোলাবারুদের যোগান কমে আসাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটে কুমিরা ছেড়ে আসার প্রধান কারণ। তাছাড়া অপ্রস্তুত বাঙালি জাতি যুদ্ধের প্রথমদিকে ছিল অগোছালো ও অসংগঠিত। তথাপি কুমিরার প্রতিরোধ যুদ্ধ পাকিস্তানী জেনারেলদের আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেয়। এই সংঘর্ষের পর ঢাকায় ১৪ পদাতিক ডিভিশনের কর্নেল স্টাফের সাথে চট্টগ্রাম থেকে কোনো এক পাকিস্তানী সামরিক অফিসারের ওয়্যারলেসে জরুরি কথা হয় যা ইন্টারসেপ্ট করা হয়েছিল। তাতে শোনা যায় যে, কর্মকর্তাটি বলছিল,

“আমাদের অনেক হতাহত হয়েছে, আমাদের সৈন্যরা সীতাকুণ্ডের দক্ষিণে আটকা পড়ে আছে। বিমানে সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য হতাহতদের জরুরি ভিত্তিতে বিমানে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।”

স্বয়ং ঢাকাস্থ জিওসি টিক্কা খান বিধ্বস্ত ব্রিগেডটিকে খুঁজতে হেলিকপ্টারে বেড়িয়ে পড়ে। চালকের আসনে ছিল মেজর লিয়াকত বোখারী ও তাকে সাহায্য করছিল মেজর পিটার। চট্টগ্রামে অবস্থানরত ২০ বালুচ রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফাতেমীর সঙ্গে দেখা করে টিক্কা খান কুমিল্লার দিকে রওয়ানা হল হারিয়ে যাওয়া এফএফ রেজিমেন্টের সৈন্যদের খোঁজে। ঘন মেঘ থাকায় যেই না হেলিকপ্টার মেঘের আড়াল থেকে নিচে নেমে আসলে লাগলো সাথে সাথে এক ঝাঁক গুলি ভুমি থেকে লাফিয়ে উঠল। মেজর লিয়াকত বোখারী এবং তার সহকারী পাইলট পিটার মুহূর্তে উপরে উঠিয়ে নিলেও হেলিকপ্টারটি মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে বিদ্ধ হয়। একটি গুলি আঘাত হানলো লেজে। অপরটি তেলের ট্যাংকি থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে গিয়ে কপ্টারের গেট বিদ্ধ করে। বিফল মনোরথে ফিরে যায় টিক্কা খান।

নৃশংসতার জন্য ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাত এক নরপিশাচের নাম টিক্কা খান; © Wikimedia Commons

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কুমিরার প্রতিরোধ যুদ্ধের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এখানেই পাকবাহিনী সর্বপ্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আর তাই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন,

‘‘কুমিরায় শক্রর বিরুদ্ধে ইপিআর সেনাদের এই অ্যামবুশ ছিল আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম সরাসরি আক্রমণ। কুমিরার যুদ্ধের গুরুত্ব এতই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, এই ঘটনা পাকিস্তানি সৈন্যদের চট্টগ্রামে অবাধে কিছু করার মূল পরিকল্পনা ব্যাহত করে দেয়।’’

তথ্যসূত্র

১. লক্ষ প্রাণের বিনিমিয়ে, রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, অষ্টম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১১০-১১৩

২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খন্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, প্রথম সংস্করণ নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৬৬-৭০

৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস-সেক্টর এক

৪. মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস, মেজর জেনারেল (অব.) এম এস এ ভূঁইয়া, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, দশম সংস্করণ (২০১৬)

৫. মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত, অনন্যা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮

৬. শরণার্থীর দিনলিপি, কানাই লাল চক্রবর্ত্তী, দি রয়েল পাবলিশার্স, ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৭-১৮

 

ফিচার ইমেজ: Collected by writer

Related Articles