Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যাক্রোফোবিয়া বা উচ্চতাভীতির আদ্যোপান্ত

পাঠক, কখনো কি এমন হয়েছে যে, একটি উঁচু দালানে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতেই আপনার ভয় হতে লাগলো, অস্থিরতা বেড়ে গেলো, মনে হতে লাগলো, এই বুঝি পড়ে গেলেন? যদি এমন হয়ে থাকে, তবে জেনে রাখুন, আপনি একা নন। এমন অবস্থা আরও অনেকের সঙ্গেই হয়ে থাকে এবং কারো কারো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়। তারা উঁচু কোনো স্থানে যাওয়া তো দূরে থাক, যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও তাদের মনে তীব্র ভয় ও দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। উচ্চতা নিয়ে মানবমনে তৈরি হওয়া বিচিত্র এই ভীতি সম্পর্কেই জানানো হবে আজকের এই লেখায়।

উচ্চতাভীতিকে ইংরেজিতে বলা হয় অ্যাক্রোফোবিয়া। গ্রিক শব্দ ‘acron’ অর্থ উচ্চতা এবং ‘phobos’ অর্থ ভয়। এই শব্দ দু’টো নিয়েই ‘Acrophobia’ নামের উৎপত্তি।

উচ্চতাভীতি কী?

প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন জানান যে, তারা উঁচু কোনো জায়গায় গেলে এক ধরনের অস্বস্তি বা চাপ অনুভব করেন। উঁচু জায়গায় গেলে এমন অনুভূতি হওয়া স্বাভাবিক এবং তারা কিন্তু অ্যাক্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত নন

অ্যাক্রোফোবিয়াক ব্যক্তি উঁচু জায়গা সম্পর্কে অযৌক্তিক ভয় ও উদ্বেগে ভোগেন; Source: flickr.com

অ্যাক্রোফোবিয়া শব্দটি সেক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, যেখানে ব্যক্তির মনে উচ্চতা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কে দীর্ঘ সময় ধরে অযৌক্তিক, তীব্র ভয় কাজ করবে। অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগের কারণে উঁচু কোনো জায়গা থেকে নেমে আসাটাও তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

অ্যাক্রোফোবিয়াক ব্যক্তিরা উঁচু জায়গা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। উঁচু স্থানে গেলে বা যাওয়ার আশঙ্কা করলে তাদের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় হয়ে ওঠে, যার কাজ শরীরকে জরুরী অবস্থার জন্যে প্রস্তুত করে তোলা। এর ফলে শরীর আসন্ন বিপদের মোকাবেলা করা অথবা তা থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়, সাধারণভাবে যা ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট রেসপন্স’ নামে পরিচিত।

ফাইট-অর-ফ্লাইট রেসপন্স; Source: globalkaizengroup.com.au

এ সময়ে ব্যক্তিটি মাথা ঘোরানো, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, ঘাম হওয়া, কাঁপুনি এবং বমি বমি ভাব অনুভব করতে পারেন। সাধারণভাবে বিপজ্জনক কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট রেসপন্স’ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অ্যাক্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ‘বিপজ্জনক নয়’, এমন পরিস্থিতিতেও ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট রেসপন্স’ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি অনেক সময় ব্যক্তিটি শ্বাসকষ্ট, নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা বা মৃত্যুভয়েও আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারেন

মানব মনে কীভাবে অ্যাক্রোফোবিয়া তৈরি হয়?

কেন মানুষের মধ্যে অ্যাক্রোফোবিয়া বা উচ্চতাভীতি গড়ে ওঠে, তার কারণ দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, বিবর্তনমূলক এবং আচরণমূলক।

বিবর্তনমূলক মনোবিজ্ঞান অনুসারে, ভয় হচ্ছে মানুষের জন্মগত বা সহজাত প্রবৃত্তি। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উচ্চতার সংস্পর্শে না আসলেও একজন মানুষ উচ্চতা সম্পর্কে ভয় পোষণ করতে পারেন।

বিবর্তনমূলক মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অ্যাক্রোফোবিয়াক ব্যক্তিরা যে কোনো উপায়ে বিপজ্জনক উঁচু এলাকা এড়িয়ে চলেন। ফলে তারা বিপদ আপদ থেকে মুক্ত থাকেন, টিকে থাকেন এবং পরবর্তীতে বংশ বিস্তার করেন। আর এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদের জিন বাহিত হয়ে চলে

মানব মনে সহজাত বা Innate Phobia মূলত এমন কোনো বস্তু বা পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়, যার সাথে মানুষকে দীর্ঘকাল মোকাবেলা করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়েছে। যেমন- অধিক উচ্চতা বা সাপের প্রতি ভীতি। কিন্তু কেউ কেউ ডাক্তারের কাছে যেতে বা বক্তৃতা দিতে যে ভয় পান, তার উৎপত্তির ক্ষেত্রে এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে বিহেভিয়ারিস্টরা মনে করেন, ভয় সহজাত বা জন্মগত প্রবৃত্তি নয়, বরং আমরা ক্ল্যাসিক্যাল কন্ডিশনিংয়ের মাধ্যমে ভয় পেতে ‘শিখি’। একটি উদাহরণ থেকে ক্ল্যাসিক্যাল কন্ডিশনিং কীভাবে কাজ করে, সেটির পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। ধরা যাক, একজন ব্যক্তি প্রথমবারের মত গাছে চড়েছেন। গাছে চড়ার পর স্বাভাবিকভাবে ঐ উচ্চতায় তিনি হয়তো ভয় অনুভব করবেন না। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে তিনি যদি গাছ থেকে পড়ে যান, তাহলে গাছে চড়ার ব্যাপারে তার মনে এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হবে। উঁচুতে ওঠার পর পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার এই অভিজ্ঞতা তাকে উচ্চতার প্রতি নেতিবাচক ভাবাপন্ন করে তুলবে। ফলে পরবর্তীতে তিনি উঁচু জায়গা এড়িয়ে চলতে চাইবেন

যদিও অনেক সময় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি বাস্তবে কখনো একটি বিশেষ বস্তু বা অবস্থার সম্মুখীন না হওয়া সত্ত্বেও সেই বিশেষ বস্তু বা অবস্থার প্রতি ভয় অনুভব করেন। ক্ল্যাসিক্যাল কন্ডিশনিং তত্ত্ব থেকে এ ধরনের ভয়ের কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না।

দুর্ঘটনা আতঙ্কের সৃষ্টি করে; Source: pinterest.com

সুতরাং অ্যাক্রোফোবিয়া কীভাবে মানুষের মনে স্থান করে নেয়, তা বুঝতে হলে বিবর্তনমূলক এবং আচরণমূলক- উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই এর উৎপত্তি বিবেচনা করতে হবে।

চিকিৎসার মাধ্যমে কি এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?

অ্যাক্রোফোবিয়া কাটিয়ে ওঠার জন্যে প্রথমেই যা দরকার, তা হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির আন্তরিক ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা। তিনি নিজে যদি ভয় থেকে মুক্তি পেতে চান, তাহলে মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন উপায়ে তাকে ভয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন।

  • ইতিবাচক চিন্তা করা, মেডিটেশন, হিপনোসিস এক্ষেত্রে কাজে দিতে পারে।
  • ভয় কাটিয়ে ওঠার চিকিৎসা হিসেবে ‘সিস্টেম্যাটিক ডিসেনসিটাইজেশন’ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে রোগীকে নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ পরিবেশে রেখে ধীরে ধীরে তার ভয়ের সম্মুখীন করা হয়। যেমন- অ্যাক্রোফোবিক ব্যক্তিকে মই বা উঁচু সিঁড়ি বেয়ে ওঠা এবং ধীরে ধীরে ধাপ সংখ্যা বাড়িয়ে অধিকতর উচ্চতায় উঠতে অভ্যস্ত করে তোলা হয়, উঁচু দালান বা পাহাড় থেকে তোলা ছবি দেখানো হয়। এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে এরপর রোগীকে উঁচু দালানের ব্যালকনি বা ছাদ থেকে নিচে তাকানো, চলন্ত সিঁড়িতে চড়া- এসব কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে তার ভয় কাটানো যেতে পারে। তবে এ সময় বিশ্বস্ত কেউ অবশ্যই রোগীর সঙ্গে থাকা জরুরী
  • রোগীর উদ্বেগ কাটানোর জন্যে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে কিছু ঔষধও সেবন করতে হতে পারে।
  • এটির চিকিৎসার আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে- ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি এক্সপোজার থেরাপি (VRET)। ১৯৯৫ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসা এ পদ্ধতিটি অ্যাক্রোফোবিয়ার চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর বলে জানা যায়।

‘ফিয়ার অব হাইট’ নামক একটি গেইমের বর্ণনা দিলে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’র মাধ্যমে কীভাবে উচ্চতা-ভীতি কাটানো হয়, তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। ২০১৬ সালে এপ্রিলের ১৫ তারিখে জাপানি ভিডিও গেইম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান Bandai Namco Entertainment Inc. টোকিওর এক ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি এক্সপো সেন্টারে তাদের বিভিন্ন গেইম প্রদর্শন করেছিলো, যার মধ্যে ‘ফিয়ার অব হাইট’ অন্যতম। এই গেইমটিতে VRET থেরাপির প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে একটি কাঠের পাটাতনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গিয়ে একটি ছোট পুতুল বিড়ালের ছানাকে উদ্ধার করতে হয়।

অ্যাক্রোফোবিয়া কাটানোর জন্যে ফিয়ার অব হাইট-এর মত গেইমের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে; Source: en.brilio.net

আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটি সাধারণ মনে হলেও গেমে অংশগ্রহণকারীর জন্যে এটি বেশ জটিল, কারণ গেমে অংশ নেওয়ার সময় তার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয় একটি হেডসেট, যা তাকে নিয়ে যাবে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’র জগতে। তার মনে হবে তিনি উঁচু একটি দালানের চলন্ত এলিভেটরের ভেতরে আছেন। ষাট তলায় পৌঁছে এলিভেটর থামার পর দরজা খুলে গেলে তিনি দেখতে পাবেন, তার সামনে রয়েছে একটি কাঠের পাটাতন যার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিড়াল ছানা। যেকোনো সময় বিড়াল ছানাটি পাটাতন থেকে পড়ে যেতে পারে। যদিও বাস্তবে পাটাতনটি ঘরের মেঝেতেই রাখা হয়েছে, কিন্তু ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে এটিকে মাটি থেকে প্রায় ২০০ মিটার উচ্চতায় দেখানো হবে। অংশগ্রহণকারীর কাজ হচ্ছে বিড়াল ছানাটিকে পাটাতনের অপর প্রান্ত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা। এভাবেই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির সাহায্যে কোনো ঝুঁকি ছাড়াই একজন অ্যাক্রোফোবিয়াক তার ভয়ের সম্মুখীন হন এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি তার ফোবিয়া কাটিয়ে উঠতে বেশ সহায়ক হয়

শুধুমাত্র উচ্চতা সম্পর্কে ভীতি ও উদ্বেগের কারণে রোলার কোস্টার রাইডে চড়া, পাহাড়ে ওঠা, বিমানে ভ্রমণ করা, বাঞ্জি জাম্পিং, প্যারাগ্লাইডিংয়ের মতো অনেক উত্তেজনাকর আর উপভোগ্য মুহূর্তগুলো জীবন থেকে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এমনকি সমস্যা হতে পারে দৈনন্দিন জীবনে সিঁড়ি বা মই বেয়ে ওঠা, এলিভেটর ব্যবহার করা, উঁচু দালানের ছাদ বা ব্যালকনিতে দাঁড়ানো, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করার মতো সাধারণ কাজেও।

উচ্চতা ভীতি কাটিয়ে উঠুন; source: renatures.com

সুতরাং পাঠক, আপনার বা আপনার পরিচিত কারো মধ্যে উচ্চতা সম্পর্কে অতিরিক্ত ভীতি বা উদ্বেগ দেখা দিলে অবহেলা না করে একজন মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন, কাটিয়ে উঠুন অকারণ ভীতি।

ফিচার ইমেজ- fear-busters.com

Related Articles