Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পুঁতির জানা-অজানা যত কথা

শাড়ির সাথে একটি সুন্দর গলার মালা না পরলে সৌন্দর্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আবার আধুনিক সাজপোশাকের সাথে বা সাধারণ সেলোয়ার-কামিজের সাথে ছোট একজোড়া কানের দুল আর হাতে একটি ব্রেসলেট না হলে তো চলেই না। তবে এখনকার যুগে গলায় স্বর্ণের হার কিংবা হাতে স্বর্ণের ব্রেসলেট দিয়ে সচরাচর কেউ বাইরে যান না। আর প্রতিদিনের কর্মজীবনে সেগুলো মানানসইও নয়। তাই এখন সকলের প্রিয় পুঁতির তৈরি গহনা। নানা নকশার, নানা আকৃতির পুঁতি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ছোট বড় গলার মালা, কানের দুল, হাতের চুড়ি বা ব্রেসলেট। এমনকি পোশাকে স্টাইলিশ ভাব আনতেও পুঁতি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই সময়োপযোগী বস্তুটির জানা-অজানা নানা তথ্য।

পুঁতির গহনা; source: naij.com

পুঁতি কী?

পুঁতি হলো দুই প্রান্তে ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট ছোট আলঙ্কারিক বস্তু, যা কাঠ, প্লাস্টিক, কাঁচসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ থেকে বিভিন্ন গড়নে তৈরি করা হয়। এর দু’প্রান্তে ছিদ্র রাখা হয় সেলাই বা গাঁথুনির সুবিধার্থে। পুঁতি সাধারণত ১ মিলিমিটার থেকে ১ সেন্টিমিটার ব্যাসের হতে পারে। সাধারণত সুতা বা তারের সাহায্যে অনেকগুলো পুঁতি জুড়ে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত অলংকার বানানো হয়ে থাকে।

পুঁতি; source: beadsandpieces.com

উৎপত্তি

অনেকেই হয়তো ভেবে থাকবে পুঁতির ব্যবহার হয়তো খুব পুরনো নয়। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা থেকে জানা গিয়েছে যে ৭৫,০০০ বছর আগেও মানুষ পুঁতি তৈরি করেছে এবং পরিধান করেছে। এতেই বোঝা যায়, পুঁতির গহনা দিয়ে হয়তো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং সামাজিক অবস্থান প্রকাশ পেত। একটা সময় ছিল যখন পুঁতিকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

২০০৪ সালে তানজেনিয়ায় উটপাখির ডিমের খোলস থেকে বানানো একজোড়া পুঁতির সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকগণ। তাদের মতে, এই পুঁতিজোড়া ৭০,০০০ বছরের পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস, ঐ পুঁতিজোড়াই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো পুঁতির গহনার নিদর্শন।

লৌহযুগের পাথর এবং কাঁচের তৈরি কিছু পুঁতি; source:dessertationreviews.com

ইউরোপে প্রথম পুঁতির ব্যবহার ৩৮,০০০ বছর পূর্বে বলে ধারণা করা হয়। এর নমুনা পাওয়া গিয়েছে ফ্রান্সের লা কুইনায়। প্রাণীর খাঁজকাটা দাঁত এবং হাড় থেকে তৈরি পুঁতিগুলো সম্ভবত তখন পেন্ডেন্ট হিসেবে পরা হতো এবং সেই সময়ে থেকেই মানুষ কিছুটা জটিল জীবনযাপন শুরু করেছিল।

প্রাচীন রাশিয়ার সাঙ্গিরে একেকটি পুঁতি তৈরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় অতিবাহিত করতো। প্রায় ২৯,০০০ বছর আগে একটি পুঁতি তৈরি করতে প্রায় এক থেকে তিন ঘন্টা সময় অতিবাহিত করতো। এই সংস্কৃতিতে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখেও নিশ্চয়ই তাদেরকে পড়তে হয়েছিল। তাহলেই ভেবে দেখুন, তারা এই কাজে কতটা নিবেদিত ছিলেন।

প্রত্নতাত্ত্বিকগণের প্রাপ্ত আফ্রিকার প্রাচন কিছু পুঁতি; source: dailyheritage.com

কাচের পুঁতির সৃষ্টি প্রায় ৫,০০০ বছর পূর্বে। এগুলো তৈরিতে কাচ এবং আগুনের ব্যবহার ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২১৮০ অব্দ পর্যন্ত সময়ের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে মেসোপটেমিয়ায়। প্রাপ্ত নমুনা দেখে জানা গেছে, কাচের পুঁতি তৈরির সময় কাচের দন্ডকে আগুনের শিখার উপর ধরা হতো এবং নিচে একটি ধাতব শাবলের মতো যন্ত্র রাখা থাকতো। যখন কাচ গলে পড়তো তখন ধাতব যন্ত্রটি দ্বারা পেঁচিয়ে সেটিকে পুঁতির গঠন দেয়া হতো। এই প্রক্রিয়াকে বলা হতো ‘কোর-ফরমিং’।

ভেনিসে পুঁতির প্রচলন শুরু হয়েছিল মার্কো পোলোর ভ্রমণের পর থেকে। পোলো এশিয়া থেকে ফিয়ে যাবার সময় বেশ কিছু কাচের পুঁতি নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সেখানকার কারিগরেরা নিজেরা পুঁতি তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯২০-৩০ সালের দিকে এই পুঁতি তৈরি করে ভেনিসের অনেক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দের কিছু পুঁতির কাজের সন্ধান মিলেছে প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিতে। ধারণা করা হয়, তারা পুঁতির ব্যবহারকে ‘সৌভাগ্যের চাবিকাঠি’ বলে মনে করতো। আদি আমেরিকানরা তাদের পূর্বপুরুষদেরকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য পুঁতি ব্যবহার করে আসছে। আবার আফ্রিকান সংস্কৃতিতে আত্মা এবং ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে পুঁতি রাখতো। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে, পুঁতি তাদের জীবনকে আলোকিত করবে।

প্রাচীন মিশরের কাচের নীল পুঁতি; source: sciencenews.org

আফ্রিকান মাসাই সংস্কৃতিতে পুঁতির গুরুত্ব ছিল খুব বেশি। সেখানে সাধারণত পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হতো। যখন বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যেত তখন কনের মা পুঁতির একটি মালা তৈরি করে কনের গলায় পরিয়ে দিত যেটি দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে মেয়েটি বাগদত্তা। এই মালাকে ‘এঙ্গেজমেন্ট নেকলেস’ এবং যে সুতা দিয়ে গাঁথা হতো সেটিকে ‘দম্পতির যোগসূত্র’ বলা হত।

পুঁতি তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ

উপকরণের ভিত্তিতে পুঁতির নানা ধরন রয়েছে। কিছু কিছু উপকরণ প্রাকৃতিক, আবার কিছু উপকরণ মানবসৃষ্ট। আধুনিক কারখানাজাত পুঁতিতে কাঠ, প্লাস্টিক, কাচ, ধাতু এবং পাথরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

প্রাকৃতিক উপকরণ

সেই প্রাচীনকাল থেকে এখন অবধি নানা প্রাকৃতিক উপকরণ থেকে পুঁতি তৈরি করা হচ্ছে। উপকরণগুলো সংগ্রহ করা হয় উদ্ভিদ বা প্রাণী থেকে, কখনোবা খনিজ পদার্থ ব্যবহার করে। প্রাকৃতিক উপকরণগুলোতে প্রাকৃতিক কিছু বিশেষত্ব পাওয়া যায় গঠনে এবং বর্ণে। এর সাথে আরও কিছু নতুনত্ব এনে সহজেই বানানো যায় অসাধারণ পুঁতি।

সাধারণত হাড়, দাঁত, শিং, কোরাল, হাতির দাঁত, উদ্ভিদের বীজ, প্রাণীর খোলস এবং কাঠ ব্যবহৃত হয় পুঁতি তৈরিতে। মানব ইতিহাসে সবচেয়ে মুল্যবান পুঁতি হিসেবে মুক্তার কদর সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এটি সহজলভ্য না হওয়ায় অন্যগুলোর কদর বেড়েছে। এখন মুক্তা চাষের মাধ্যমে সেই হারানো গৌরব কিছুটা হলেও ফিরে আসছে।

কাঠের পুঁতি; source: hobbycraft.co.uk

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের রত্ন পাথর, ধাতব পদার্থ এবং খনিজ পদার্থ থেকে পুঁতি তৈরি করা হয়। আজকাল কাগজ থেকেও পুঁতি তৈরি হচ্ছে।

কৃত্রিম উপকরণ

অনেক আগে থেকে ব্যবহৃত কৃত্রিম পুঁতির মধ্যে চিনামাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়াও কিছু প্রাচীন সংকর পদার্থ, যেমন- ব্রোঞ্জ এবং পিতলের তৈরি পুঁতিরও যথেষ্ট কদর রয়েছে।

পুঁতির যত আকার

প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো আকারের পুঁতিরই দেখা মেলে। যেমন-

বিভিন্ন আকারের পুঁতি; source: thebeadlady.com

গোলাকার পুঁতি সাধারণত গলার মালায় এবং হাতের ব্রেসলেটে ব্যবহার করা হয়। অনেকগুলো গোলাকার পুঁতি যখন পাশাপাশি থাকে তখন চোখে একপ্রকার প্রশান্তি পাওয়া যায়। এই ধরনের পুঁতিগুলো সাধারণত কাঁচ, পাথর, চিনেমাটি বা কাঠের তৈরি হয়ে থাকে।

বর্গাকার বা ঘনাকার পুঁতিগুলো গলার হারের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বা ডিজাইনের বিশেষত্ব আনতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া শুধুই বর্গাকার পুঁতি দিয়েও বানিয়ে ফেলতে পারেন একটি গলার হার। এগুলো সাধারণত কাঠের বা কাঁচের তৈরি হয়ে থাকে। শামুক/ ঝিনুকের খোলস দিয়েও এরকম পুঁতি বানানো যেতে পারে।

ডিম্বাকৃতির বা টিউবাকৃতির পুঁতির চলও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে সরিষা বীজের মতো ক্ষুদ্রাকৃতির পুঁতিও।

পুঁতি যেমন আকারেরই হোক না কেন, তা সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে চলে। জমকালো সাজে কিংবা হালকা সাজে, সাধারণ নকশা বা আকর্ষণীয় পোশাকের নকশায় পুঁতির ব্যবহার অভাবনীয়। তসবীহ্‌তেও কিন্তু পুঁতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পুঁতি দিয়ে বানানো হচ্ছে অসাধারণ সব শৌখিন জিনিসপত্র এবং ভ্যানিটি ব্যাগ। মোট কথা, পুঁতি একটি দেশের অর্থনীতির বেশ খানিকটা অংশই দখল করে রয়েছে।

ফিচার ইমেজ-pxhere.com

Related Articles