“যারা নিজেরা জানে যে তারা কী চায়, অন্যরাও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলে”
ঠিক এমনিভাবেই গোটা ফ্যাশন জগতকে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখিয়েছেন বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন তথা ফ্যাশন জগতের বাইবেল নামে খ্যাত ‘আমেরিকান ভোগ’ এর প্রধান সম্পাদক ও প্রসিদ্ধ প্রকাশনী সংস্থা ‘কণ্ডে নাস্ট’ এর আর্টিস্টিক ডিরেক্টর অ্যানা উইন্টোর। ১৯৮৮ সালে তিনি আমেরিকান ভোগ এর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে নিজের ব্যক্তিত্ব ও মেধা দিয়ে ফ্যাশন জগতের বাইরেও নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন। তবে লরেন্স ওয়েসবার্জারের লেখা বই অবলম্বনে ২০০৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য ডেভিল ওয়্যার্স প্রাদা’র মূল চরিত্র ‘মিরাণ্ডা প্রিস্টলী’ (অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ এর চরিত্রায়ন করেন, ওয়েসবার্জার একসময়ে অ্যানার অধীনেই ম্যাগাজিনে কাজ করতেন) ছিল ফ্যাশন জগতে অ্যানার (এই নামেই তিনি পুরো ফ্যাশন জগতে সমাদৃত) প্রভাবকে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
অ্যানা উইন্টোর ১৯৪৯ সালের ৩ নভেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। সংবাদ মাধ্যম ও সম্পাদনার সাথে তার সম্পর্ক পরিবার থেকেই তৈরি। তার বাবা চার্লস ভেরে উইন্টোর লন্ডনের ‘ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড’ সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে দুই দফায় দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৬ সালে ‘নর্থ লন্ডন কলেজিয়েট’ থেকে পড়া শেষ না করেই অ্যানা প্রতিষ্ঠানটি ত্যাগ করেন এবং এর চার বছর পরে ‘হার্পার্স এন্ড কুইন’ ম্যাগাজিনে ফ্যাশন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন। এরপরে তিনি নিউ ইয়র্কের বেশ কিছু ম্যাগাজিনে ফ্যাশন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ‘ব্রিটিশ ভোগ’ এবং ১৯৮৭ সালে ‘হাউজ এন্ড গার্ডেন’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি আমেরিকান ভোগ এর তৎকালীন সম্পাদক গ্রেস মিরাবেলা’র স্থলাভিষিক্ত হন এবং ম্যাগাজিনটির প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত হন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য সাফল্যের সাথে তিনি এই অবস্থানেই বহাল রয়েছেন। সেই সাথে তার প্রভাবকে আরও ব্যাপ্ত করেছেন; বিচরণ করেছেন রাজনীতি, সমাজসেবা, শিল্পোন্নয়নসহ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
ফ্যাশন জগতে অবদান
“মাস উইথ ক্লাস- এটাই আমার কাজ করার মূলমন্ত্র।”
১৯৮৮ সালে তার দায়িত্ব গ্রহণ কালে রোনাল্ড রিগ্যান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। তারপর থেকে এই পর্যন্ত হোয়াইট হাউজ মোট পাঁচজন রাষ্ট্রপতির আসা-যাওয়া প্রত্যক্ষ করলেও, আমেরিকান ভোগ এর নেতৃত্বে কোনোরকম পরিবর্তন আসেনি। এমনকি অ্যানা’র অবসর গ্রহণ সম্পর্কিত সামান্য একটি গুজবে এত আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে কণ্ডে নাস্ট কর্তৃপক্ষ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে সকলকে আশ্বস্ত করে যে অ্যানা ‘আজীবন’ আমেরিকান ভোগ এর দায়িত্ব পালন করবেন।
১৯৮৮ সালের আমেরিকান ভোগ এর নভেম্বর ইস্যুর কভারে মডেলের পরনে ল্যাক্রোয়া খচিত জ্যাকেট ও নীল রঙের জিন্স দেখে ছাপাখানা থেকে ভোগ এর অফিসে ফোন করা হয় এটা নিশ্চিত করার জন্য যে, ঐ কভারটি উক্ত ইস্যুর সঠিক কভার ছিল কি না। এভাবেই অ্যানা নিজের চেতনাবোধের সাথে ফ্যাশন জগতকে প্রথমবারের মতো পরিচয় করিয়ে দেন। ঐ কভারটি ছিল ফ্যাশন জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার সূত্রপাত। একসময় যে ফ্যাশন জগতকে সমাজের শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য উপযোগী বিবেচনা করা হত, তা সর্বস্তরের ফ্যাশনপ্রেমীদের মাঝে বিচরণের যাত্রা শুরু করে ঐ কভারটির মাধ্যমেই। ১৯৯৩ সালে অ্যানার তত্ত্বাবধানে ‘টিন ভোগ’ নামে আরও একটি ফ্যাশন ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয়। এটি ছিল তার তত্ত্বাবধানে কণ্ডে নাস্টের অধীনে সৃষ্টি হওয়া বেশ কয়েকটি উদ্যোগের একটি।
১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর ইস্যুতে আমেরিকান ভোগ এর কভারে কোনো মডেলের পরিবর্তে অভিনেত্রী রেনে জেলেউইগার এর ছবি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল প্রথম ফ্যাশন ম্যাগাজিন যার কভারে কোনো মডেলের ছবি ছিল না। উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বর ইস্যু ফ্যাশন ম্যাগাজিনের জগতে সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত। এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য আরও দুই অভিনেত্রী হলেন নিকোল কিডম্যান ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
অভিনেত্রীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় নারীদেরও আমেরিকান ভোগ এর কভারে দেখা যায়। প্রথমবারের মতো দেশটির ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে হিলারি ক্লিনটন ভোগ এর কভারে আবির্ভূত হন। ২০১৬ সালে ম্যাগাজিনটি হিলারির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারণা কাজেও সহযোগিতা করে এবং সমর্থন যোগায়। এই তালিকায় আরও রয়েছেন প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। এছাড়াও মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী আমাল ক্লুনি, টেনিস খেলোয়াড় সেরেনা উইলিয়ামস্- ভোগ এর কভারে আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপারস্টার এর মর্যাদা লাভ করেন। অ্যানার নেতৃত্বে পরিচালিত আমেরিকান ভোগ, বরাবরই নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বকে সমর্থন করেছে এবং সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে।
ব্যক্তিগত স্টাইলিং
“এটাকে (ব্যক্তিগত স্টাইলিং) তোমার নিজের সাথে স্বকীয় এবং অন্যদের কাছে সহজে চিনতে পারা যায়- এমনভাবে গড়ে তোলো।”
সর্বস্তরের ফ্যাশনপ্রেমীদের জন্য ফ্যাশন জগতে বার বার ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ঘটালেও, অ্যানার ব্যক্তিগত স্টাইলিং কিন্তু প্রায় সব সময়ই এক বলা যায়, অন্তত গত তিন দশকেরও বেশি সময়ে সেরকম কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী সেলাই করা ক্রু-নেক ও ক্যাপ-স্লিভওয়ালা শিফ্ট ড্রেস, শার্ট ড্রেস ও স্কার্টের সাথে শার্ট- মোটামুটি এই তিনটির যেকোনো এক ধরনের পোশাক তিনি গ্রীষ্মকালে পরে থাকেন। সাথে সব সময়ই থাকে দুধ বিশিষ্ট কফির রঙের মধ্যম হিলওয়ালা ‘মানোলো ব্লাহনিক’ এর স্লিংব্যাক (পিছনের দিকে বেল্ট দেওয়া) জুতো। আর শীতকালে তার পোশাকে থাকে স্টেটমেন্ট কোটের সাথে হাঁটু অব্দি লম্বা বুট। তিনি ট্রাউজার্স পরেন না।
বৈচিত্র্যময় রঙের ব্যবহার তিনি পছন্দ করেন। বিশেষত অ্যানিমেল প্রিন্টের প্রতি তার ভালোলাগা বেশ লক্ষণীয়, অন্যদিকে ফুলেল প্রিন্টের প্রতি রয়েছে অনীহা। স্বভাবতই একটু চড়া মূল্যের পণ্যই তার পছন্দের তালিকায় থাকে। তিনি বেশির ভাগ সময়েই রাল্ফ লরেন ও মাইকেল কোর্স এর মতো আমেরিকান ডিজাইনারদের পোশাক পরে থাকেন। এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের জনপ্রিয় রঙ ও ফ্যাব্রিক দিয়ে তৈরি করা গুচ্চি ও প্রাদার পোশাকও তিনি পরেন। আর সবচেয়ে উঁচু দরের কোনো অনুষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে- যেমন মেট গালা বা বাকিংহ্যাম প্যালেস এ ‘ডেম’ খেতাব গ্রহণ- তিনি বেশিরভাগ সময়েই শ্যানেল’কে বেছে নেন। আর চারপাশে যতই সমালোচনা বা প্রতিবাদ করা হোক না কেন, তিনি আজও পশুর প্রকৃত লোম দিয়ে তৈরি পোশাক পরেন।
তার বাহ্যিক অবয়বের সবচেয়ে স্বকীয় অংশ হলো তার চুল। তার চিরচেনা বব-কাট চুলের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে ‘ইনক্রেডিবলস্’ এর মত অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে তা ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা তার চুলের কাট- যা ‘পাওয়ার বব’ নামে পরিচিত- এতটাই স্বকীয় যে যতই ভিড় থাকুক না কেন, অ্যানা বেশ দূর থেকেও সহজেই নজরে পড়েন।
স্বীকৃতি
আমেরিকান ভোগ, তার এই কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি গড়ে তোলার যাত্রায় শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রাথমিক পদক্ষেপকে কাজে লাগিয়েই তিনি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সফলভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন।
২০১২ সালে সংঘটিত বারাক ওবামা’র নির্বাচনী প্রচারণায় তার উদ্যোগে চতুর্থ সর্বোচ্চ অর্থায়নের জোগান হয়। ২০১৪ সালে তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘কস্টিউম ইন্সটিটিউট অফ দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম’ এর নতুন করে নামকরণ করা হয়। এছাড়া ব্রিটিশ রাজ-পরিবার তাকে ‘ডেম’ স্বীকৃতিও প্রদান করেছে। তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ‘দ্য সেপ্টেম্বর ইস্যু’ ও ‘দ্য ফার্স্ট মানডে ইন মে’ নামক ডকুমেন্টরি যেখানে তিনি নিজ ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। এছাড়াও তাকে ‘জুল্যাণ্ডার২’ ও ‘ওশান’স এইট’ চলচ্চিত্রেও দেখা গিয়েছে।
This article, written in Bengali, describes the professional life of Anna Wintour. Sources of information have been hyperlinked inside the article.
Fearture image: mirror.co.uk