শরীর ঠিক রাখতে আজকাল আমরা কী না করি। ডায়েটিশিয়ানের কাছে দৌড়ানো, নিউট্রিশিয়ান নিয়োগ, জিমে দৌড়ানো, ক্র্যাশ ডায়েট, এগ ডায়েট- কী নেই এই তালিকায়। এসব থেকে কি একটি চিরস্থায়ী ফলাফল পাওয়া সম্ভব? এক জরিপে দেখা গেছে, জাপানীদের মাঝে এ ধরনের দৌড়ােদৌড়ি অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক কম। আবার তাদের গড় আয়ুও অনেক বেশি। একজন জাপানী সুস্থ শরীর আর মজবুত হাড় নিয়ে বেঁচে থাকে প্রায় ৮৪ বছরের বেশি সময়। এদের শরীরে মেদের চিহ্ন প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু কেন? পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, জাপানীরা স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে শুধু খাবার নিয়ন্ত্রণ করে বিষয়টা এমন না। বরং তাদের জীবনযাপনের নিয়ম কানুন, অভ্যাস সব মিলিয়েই তাদের সুস্বাস্থ্য।
জাপানের ওকিনোয়া দ্বীপের নাগরিকদের গড় আয়ু ৮৪ নয়, বরং বেশিরভাগ মানুষ এখানে শতবর্ষ পার করেছেন। এই দ্বীপকে বলা হয়ে থাকে 'দ্য ল্যান্ড অফ ইমমর্টালস'।
জাপানীরা তিনটি আদর্শ মেনে চলে। তারা প্রচুর হাঁটাহাঁটি করে, জীবনযাত্রায় সাইকেলের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। অফিস আদালত, স্কুল কলেজে যাবার ক্ষেত্রে এই দুটি মাধ্যমকেই তারা বেছে নেয়। জেনে অবাক হতে হয়, জাপানে ৭২মিলিয়ন মানুষ বাইসাইকেল ব্যবহার করে নিয়মিত এবং বাইসাইকেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ড আর ডেনমার্কের পরই জাপানের নাম উঠে আসে। এছাড়া, তারা সবসময় পরিমিত পরিমাণ খাবার খায়। ছুটি উদযাপনেও পাহাড় ডিঙানো বা হাইকিং তাদের মাঝে ভীষণ জনপ্রিয়।
ভোজনরসিকদের শুনে কষ্ট হলেও এটাই সত্য যে, জাপানীরা কখনো ভরপেট খায় না। সবসময় তারা শতকরা ৮০ ভাগ পেট ভরিয়ে ক্ষান্ত দেয়। তাদের এই ৮০ ভাগ পেট ভরানোর খুব মজাদার একটা নাম আছে। একে তারা বলে হারা হাচি বু। যেন কখনো বেশি খাওয়া না হয়ে যায় সেজন্য তারা খাবার পরিবেশনও করে ছোট পাত্রে। ফলাফল, অবচেতন মনেও বেশি খেয়ে ফেলা সম্ভব হয় না।
তাদের খাবার পরিবেশন পাত্রও ছোট হয়, সেই ছোট পাত্রটিও তারা খাবারে পরিপূর্ণ করে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে জায়গা রেখে খাবার পাত্র সাজায়। বলা হয়, জাপানীরা প্রতিদিন প্রায় ত্রিশ পদের খাবার খায়, কিন্তু খুবই অল্প পরিমাণে।
রেস্টুরেন্ট নয়, বরং বাসায় রান্না করা খাবার জাপানীদের খাদ্যতালিকায় স্থান পায়। তারা যে শুধু খাবার বাসায় রান্না করে তা না, অনেক ক্ষেত্রে ফল-সবজির উৎপাদনও বাসাতেই করে। খাবারের সাথে তাদের আবেগটা অনেক গভীর, আর একটু ভিন্নধর্মীও বটে।
কীভাবে? তারা চায় শুধু ক্ষুধা মিটিয়ে খাবারের সাথে সম্পর্ক শেষ না করে বরং খাবারের সাথে একধরনের বন্ধন গড়ে তুলতে। সেই বন্ধন গড়ে তুলতে বাসা বাড়িতে যেখানে যেটুকু জায়গা থাকে সেখানেই তারা বাগান তৈরি করে।
আরেকটি বিশেষত্ব হলো, তারা খাবার সংরক্ষণের ব্যপারে খুবই সচেতন। যেহেতু তারা খাবারের সাথে একধরনের বন্ধন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাসাবাড়িতে বাগানের ব্যবস্থা করেছে, সে কারণেই হয়তো খাবার যেন কোনোভাবে নষ্ট না হয় সেদিকে তাদের সচেতন নজর থাকে।
কী ধরনের খাবার কতখানি খেতে হবে এই হিসাবের পাশাপাশি কখন খাবার খেতে হবে এ ব্যাপারেও জাপানীরা নিয়ম মেনে চলে। যেমন- সারাদিনের মাঝে সকালের খাবার তাদের কাছে খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে। নাস্তা না করে তারা কাজে বের হয় না।
জীবনযাপনের এত শত নিয়ম কানুনই কি তবে সেই রহস্য? না, রহস্যের এখনো বাকি আছে। জীবনযাপনের পাশাপাশি এদের খাদ্যাভাস এবং খাদ্য উপাদানও ভিন্ন। জাপানের বিখ্যাত খাবার টোফু বা স্যুশি কোনোটিতেই নেই বার্গার বা পিজ্জার মতো ক্ষতিকর তেল বা চর্বি। তাদের জনপ্রিয় প্রতিটি খাবারের পুষ্টিগুণ তাদের সুস্বাস্থ্যে অবদান রাখে। তাদের উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের উপাদানগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
মিসো স্যুপ
স্যুপ জাপানীদের খাদ্যতালিকার বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে। প্রায় সব ধরনের আর সব বেলার খাবারের সাথেই তারা স্যুপ পরিবেশন করে। কেঞ্চিন জিরু, ক্রিম স্ট্যু, রামেন, মিসো স্যুপ এগুলো কিছু উল্লেখযোগ্য স্যুপের নাম।
তাদের মাঝে মিসো স্যুপটা সবচেয়ে জনপ্রিয়। মিসোর বিশেষত্ব হলো এই স্যুপে তেল-চর্বি নেই, বরং প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এবং প্রোটিন আছে। স্যুপের টোফুর সাথে পরিবেশন করা হয় এবং এর মাঝে প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি থাকে বলেই হয়তো এই স্যুপ সহজে পেট ভরতে সাহায্য করে। ত্বকের সুরক্ষায় কসমেটিক্স নয়, বরং এই স্যুপ অবদান রাখে। এছাড়াও হজম শক্তি বৃদ্ধি আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে বিখ্যাত মিসো স্যুপ।
স্যুশি
বিশ্বখ্যাত জাপানী ডিশ স্যুশি আদতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সামুদ্রিক মাছের সাথে ভাতের পরিবেশন। যারা ভেজিটেরিয়ান অর্থাৎ যারা শুধু সবজি খান তাদের জন্য শুধু সবজি দিয়েই স্যুশি তৈরি করা হয়। অনেক সময় বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি ফল দিয়েও স্যুশি পরিবেশন করা হয়।
ন্যাটো
এই ন্যাটো নর্থ আমেরিকান ট্রিটি অর্গানাইজেশন না, এই ন্যাটো জাপানের জনপ্রিয় সকালের খাবার। সয়াবিন এবং সয়া সসে প্রোটিন সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর তন্তুতে তৈরি এ খাবারের মাঝে আছে ভিটামিন কে১ ও কে২। এই দুই ভিটামিন রক্ত জমাট বাঁধতে বাধতে সাহায্য করে।
আমাজেক
আমাজেক ভাত দিয়ে তৈরি একধরনের পানীয়। এর মাঝে প্রচুর পরিমাণ কোজিক এসিড আছে যা হজমে সাহায্য করে। সব বয়সের জন্যই এই পানীয় উপযুক্ত। সাধারণত ঠান্ডা আবহাওয়াতে জাপানীরা গরম গরম আমাজেক পরিবেশন করে থাকে।
সীউইড
অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে তৈরি জাপানের একটি জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে সী উইড। তাদের কাছে এটি সহজলভ্য সবজীর মতো আর এর ব্যবহারও অনেক ধরনের।
কেউ স্যুশিতে সী উইড ব্যবহার করেন, তো কেউ মিসো স্যুপে সীউইড ডুবিয়ে দেন। সহজে পেট ভরানোর এই সবজি একাধারে উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ভাতের ব্যবহার
অনেকেই মনে করেন, ভাত তাদের মুটিয়ে যাবার কারণ। কিন্তু জাপানীরা পাউরুটি নয়, বরং খাবার হিসেবে ভাত বেশি পছন্দ করে। কেননা পাউরুটির বা রুটি খেলে খাবার চাহিদা বেশি থাকে এবং তা হজমে সমস্যা হয়। অনেকে সাদা ভাত ক্ষতিকর মনে করলে খাদ্য তালিকায় বাদামী ভাত রাখে।
মৌসুমী ফল
মৌসুমী ফল আর জাপানীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাসাবাড়িতে যেসব বাগান তারা করে থাকেন, তার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই মৌসুমী ফলের বাহার থাকে। তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার 'ওয়াশকু' মৌসুমী এবং ঘরে উৎপাদিত ফলমূল সবজি দিয়েই বানানো হয়।
মিষ্টি
মিষ্টি জাতীয় খাবারের সাথে জাপানীরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। বরং মিষ্টির ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়েই তারা আলোচনা করে।
গ্রিন টি
মিষ্টিকে দূরে সরিয়ে গ্রিন টি আপন করে নেয়া জাপানী সুস্বাস্থ্যের আরেকটি রহস্য। প্রতি বেলা খাবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই গ্রীন টি।
সব মিলিয়ে ডায়েটিং জাপানীদের কাছে শুধু না খেয়ে থাকা না বা শুধু অল্প খাওয়া না। ডায়েট তাদের কাছে একটা নিয়মানুবর্তিক জীবন ব্যবস্থা। কী খেতে হবে, কীভাবে খেতে হবে, কখন খেতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, কতটা হাঁটাহাঁটি সব মিলিয়েই জাপানী ডায়েট।
না খেয়ে থাকা আর অনিয়ন্ত্রিত শারীরিক কসরতের ক্ষতিকর দিকগুলো যখন প্রকট হয়ে উঠছে, অনেকেই তখন জাপানী জীবনাচরণের দিকে আকর্ষণ বোধ করছেন। এ আকর্ষণের মূলে সম্ভবত দীর্ঘায়ু কামনার চেয়ে সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার আশা বেশি রয়েছে।
Feature Image: USA Online Casino Blog
This article is about the mysteries of Japanese lifestyle that make them live longer than most people on earth.