Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বর্ণিল রঙে জীবনকে রাঙিয়ে তুলুন

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে রাঙিয়ে তোলে বিভিন্ন রঙ। রঙ আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই এক অংশ। এটি আমাদের ইন্দ্রিয়, দৃষ্টি, স্পর্শ, স্বাদ, এমনকি শ্রবণেন্দ্রিয়কেও প্রভাবিত করে। আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে রঙ। মানুষের চোখের রেটিনায় মূলত লাল, নীল এবং সবুজ- এই তিনটি রং ধরা পড়ে। এই রংগুলো মস্তিষ্কে পৌঁছে নিজের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী মিলেমিশে তৈরি করে অফুরন্ত রঙের ভাণ্ডার।

প্রকৃতিতে নিয়ত চলে বিচিত্র রঙের খেলা

আমাদের এই বসুন্ধরাও নানা রঙে নিজেকে সর্বদা রাঙিয়ে তোলে। এই প্রকৃতির নীলাকাশে শ্বেত শুভ্র মেঘের নিয়ত ভেসে চলা, রামধনুর রং, সবুজ গাছপালার রঙ-বেরঙের ফুলের উপর রঙিন প্রজাপতি, এককথায় প্রকৃতি রঙের জাদু দিয়ে তার অনবদ্য সব সৃষ্টিকর্ম করে যাচ্ছে। প্রকৃতি তার নিপুণ হাতে একেক রকম জিনিসের জন্য যেভাবে একেক রকম রং তৈরি করেছে, তা দেখলে বেশ অবাকই লাগে। তাই তো নীল মানেই আমরা বুঝি জল বা আকাশ, সবুজ মানেই গাছের পাতা, লাল মানেই ফুল। রংই যেন এসব জিনিসের প্রতিশব্দ তৈরি করে নিচ্ছে। আর তাই তো ছোটবেলায় পড়া সেই ছড়া ‘রোজেস আর রেড, স্কাই ইজ ব্লু …” আমাদের সকলের কাছেই এত আপন। 

সবুজ গাছপালার রং বেরঙের ফুলের উপর রঙিন প্রজাপতি; Image Source: Pinterest.com

প্রাচীনকালে যেভাবে রঙ তৈরি হতো

প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন গুহাচিত্রে বা বস্ত্রশিল্পে প্রাকৃতিক রঙই মানুষ ব্যবহার করে এসেছে। টাই অ্যান্ড ডাই বা অজন্তা গুহাচিত্রে যেসব রং ব্যবহার করা হয়েছে, সেসবই ছিল প্রকৃতিরই দান। সেজন্যই সেই গুহাচিত্রগুলো আজও অক্ষয়। মানুষের অনিসন্ধিৎসু মন প্রকৃতির নানা উপাদান থেকে এই রঙ তৈরি করতে শিখিয়েছিল। আর তাই প্রাচীনকালে রং তৈরি হতো হলুদ, মেহেন্দি, চন্দনকাঠ এবং বিভিন্ন ফুলের নির্যাস থেকে। 

প্রাচীনকালে প্রকৃতির নানা রঙে সেজে উঠেছিল অজন্তা ইলোরা; Image Source: abhijna-emuseum.com

রং খেলার শুরু

কথিত আছে যে, গৌরাঙ্গী রাধার গায়ের রঙে দারুণ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আর সেজন্য তিনি রাধার গায়ে রং মাখিয়ে  দিয়েছিলেন। সে থেকেই নাকি রঙ খেলার উৎসব ‘হোলি’র প্রচলন শুরু হয়। মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও এই খেলা আর এখন কোনো দেশ আর ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে, পেয়েছে সার্বজনীনতার রূপ। আট থেকে আশি, সকলেরই প্রিয় এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো আবির খেলা এবং পিচকিরি ভরা রঙের ফোয়ারা ছোটানো। 

হোলি উৎসবে সকলেই নানা রঙে নিজেদের রাঙিয়ে তোলে; Image Source: zeebiz.com

মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা নানা রং

মানুষের কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তোলে নানা রঙ। আর কল্পনাকে ফুটিয়ে তুলতে মানুষ হাতে নেয় রঙ আর তুলি। এই দুইয়ে মিলিত রূপ কল্পনাকে জাগিয়ে তোলে ক্যানভাসে। আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে অপরূপ দৃশ্যাবলী। তাতে বুঁদ হয়ে যায় গোটা জগৎ। ছবি আঁকার শখ কম-বেশি সকলেরই থাকে। তুলি হাতে ক্যানভাসে নানা রঙের আঁচড় টানা মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা রঙের জাদুকরকে বাইরে বের করে আনার মতো আনন্দ জাগে। মনের আবেগ, উচ্ছলতা সবই যেন ফুটে ওঠে তুলির বাহারি রঙে।  

শিল্পীর ক্যানভাসে ফুটে ওঠা বিমূর্ত ছবিতে নানা রঙের ব্যবহার; Image Source: chicagoskylineart.com

রঙই যখন জীবিকার একমাত্র উপাদান

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বর্ণের মানুষ নিজের মেধা ও রঙকে পুুঁজি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তুলি দিয়ে রিক্সার পেছনে তুলে ধরেন নানা মনোহর চিত্রকর্ম। কেউ পোস্টারে, কেউ চিত্রকর্মের মাধ্যমে তার জীবিকা অর্জন করে থাকেন। নামী চিত্রকর, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, কার্টুনিস্ট থেকে হোর্ডিং পেইন্টার- এদের সকলের পেশায় ছড়িয়ে আছে রঙ।

চিত্রকর রঙ-তুলির আঁচড়ে রিক্সার পিছনে তুলে ধরেন নানা মনোহর চিত্রকর্ম; Image Source: kathmanduandbeyond.com

চিকিৎসাশাস্ত্রে রঙ

বিশেষজ্ঞরা রঙকে উচ্চ ও নিম্ন কম্পাঙ্কে ভাগ করেছেন। বেগুনি, নীল, আকাশি রং হলো উচ্চ কম্পাঙ্ক আর হলুদ, কমলা এবং লাল রং হলো নিম্ন কম্পাঙ্কের। এর উপর ভিত্তি করে চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় নানা রঙ। হোমিওপ্যাথিক, অ্যালোপেথিক কিংবা ভেষজ ওষুধে রঙের রয়েছে এক আলাদা গুরুত্ব। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে নানা রোগের উপশম হিসেবে ‘কালার থেরাপি’ চিকিৎসা প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাতে বেশ সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রঙের সাহায্যে নিরাময় করা যায় গভীর অসুখ। চলুন তাহলে জানার চেষ্টা করি ‘বেনীআসহকলা’- এর কোন রং শরীরের কোন অংশের জন্য উপকারী।

উন্নত দেশগুলোতে নানা রোগের উপশমে ‘কালার থেরাপি’ চিকিৎসা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; Image Source: theessenceofme.com
  • বেগুনি: সেরেব্রাল কর্টেক্স এবং স্নায়ুতন্ত্র।
  • নীল: পিটুইটারি গ্ল্যান্ড, নাক, কান এবং চোখ।
  • আকাশি: থাইরয়েড, কণ্ঠ এবং মুখ।
  • সবুজ: হৃদয়, সার্কুলেটরি সিস্টেম, বাহু এবং ফুসফুস।
  • হলুদ: বৃক্ক, পাকস্থলী, যকৃত, পেশি, কোলন, গল ব্লাডার এবং ডাইজেস্টিভ সিস্টেম।
  • কমলা: ব্লাডার এবং ডাইজেস্টিভ সিস্টেম
  • লাল: স্পাইনাল কর্ড, অ্যাড্রিনাল কোলন, পা এবং অস্থি।

মানব জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে রঙ

মানব মনের ভাবাবেগ, আনন্দ,অনুভূতি, উত্তেজনা, ভালো লাগা সবকিছুর সাথে জড়িয়ে রয়েছে রঙ

সাদা: পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা, আন্তরিকতা এবং পরিপূর্ণতার রঙ। সাদা রঙ মনের নেতিবাচক অনুভূতি দূর করে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। তবে অতিরিক্ত সাদা রঙ মনকে শীতল এবং নিঃসঙ্গ করে তোলে।

কমলা: এটি সূর্যের রঙ। সূর্য সমগ্র জগতে জীবন দানকারী হিসাবে বিবেচিত। কমলা রঙের ঔজ্জ্বল্য মনকে চনমনে করে তোলে। অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট হিসেবে এই রং তুলনাহীন।

লাল: ভালবাসার রং লাল। অশুভ চিন্তাকে দূর করে মনের মধ্যে জীবনীশক্তি সঞ্চার করতে এই রঙ তুলনাহীন। তবে তীব্র লাল রং জীবনে নিয়ে আসে অধৈর্য ও অস্থিতিশীলতা।

গোলাপি: বলা হয়ে থাকে, প্রেমের রঙ গোলাপি। রাগ কমিয়ে মনকে শান্ত করতে, স্বার্থহীন ভালবাসায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গোলাপি রঙ। একাকিত্ব, নিরাশা, স্পর্শকাতরতা এবং হিংস্রতা কমায় গোলাপি।

প্রকৃতির মধ্যেই ছড়িয়ে আছে নানা বৈচিত্র্যময় রঙ; Image Source: meteoweb.eu

সবুজ: মানসিক চাপমুক্ত রাখতে চমৎকার কাজ করে সবুজ রং। আবার সবুজ ঈর্ষারও প্রতীক।

হলুদ: মহাবিশ্বের রঙ, যা আনন্দিত এবং অন্ধকার দূর করে। হলুদ রং বন্ধুত্ব এবং খুশির প্রতীক। নতুন নতুন আশাবাদী ধ্যান ধারণা তৈরিতে এবং সিদ্ধান্ত তৈরির ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে হলুদ।

সোনালি: শক্তি, সম্পদ, প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয় সোনালি রঙকে। বিষণ্নতা দূর করতে এবং মনের তীক্ষ্ণতা বাড়াতে সোনালি রঙের জুড়ি নেই।

নীল: মনের প্রশান্তি এবং ধর্মীয় অনুভূতি জাগাতে নীল রঙ কাজ করে থাকে। তবে সৃষ্টি এবং স্পষ্টতা জাগিয়ে তুললেও গাঢ় নীল রঙ মনের বিষণ্নতা নিয়ে আসতে পারে।

রুপোলি: চাঁদের রং রুপোলি, এটা মনের শুদ্ধতা এবং পবিত্রতা প্রকাশ করে।

সবুজ প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষের মনও রঙিন হয়ে ওঠে; Image Source: planwallpaper.com

বেগুনি: অনুমান এবং কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তোলে বেগুনি রঙ। আর তার সাথে ভয় এবং আচ্ছন্নতা কাটায়।

কালো: মানুষের জীবনকে সহজ, সরল, আরাম, সুরক্ষা এবং রহস্যময়তা আনে কালো। এছাড়া কালো শোকেরও বার্তা বহন করে।

ধূসর: সাদা এবং কালোর মাঝামাঝি রঙকে বলে ছাই বা ধূসর। এই রঙকে সবসময় নেতিবাচক প্রতীক হিসেবেই ধরা হয়।

বাদামি: মাটির রং বাদামি নিরাপত্তাহীনতা দূর করে, মানসিক স্থিরতা আনতে সাহায্য করে।

প্রাণ ও প্রকৃতির প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় বিচিত্র রঙের এই জাদু একমাত্র মানুষই অনুধাবন করতে পারে। কারণ, রঙের দৃষ্টি নন্দন সৌন্দর্য এবং তার সূক্ষ্মতা বিচার করার ক্ষমতা যে সৃষ্টিকর্তা শুধুমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন।

আর তাই প্রতিনিয়ত রঙের খেলায় নিজেদের রাঙিয়ে তুলতে বিশ্বকবির ভাষায় বলতে হয়-

রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে–
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে
অশ্রুজলের করুণ রাগে॥

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,
সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে॥

ফিচার ইমেজ- thebrownwine.com

Related Articles