অর্ধ শতকেরও বেশি সময় যাবৎ ভারতীয় ফ্যাশন জগতের মুকুটহীন রানীর আসনে অধিষ্ঠিত ঋতু কুমার, ভারতীয় ফ্যাশন জগতে ‘বুটিক সংস্কৃতি’র প্রবর্তক এবং প্রারম্ভিক সময়ের ডিজাইনারদের মধ্যে অন্যতম। তার কাজ মূলত লোকজ হস্তশিল্প নিয়ে, যা তিনি তার স্বকীয় সৃজনশীলতার মাধ্যমে আধুনিক বিয়ের পোশাকে ফুটিয়ে তোলেন। এই লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির ছোঁয়াও দেখা যায়, কারণ ফ্যাশন ও শিল্পের সন্ধানে ঋতু তার কর্মজীবনের একটা বড় সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। পরিহিত পোশাকের পাশাপাশি, গৃহস্থালির সাজসজ্জায় ব্যবহৃত কাপড়ের তৈরি বিভিন্ন পণ্যও তিনি ডিজাইন করে থাকেন।
পরিকল্পিত যাত্রা
প্রবাদ রয়েছে, ‘উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়’, অর্থাৎ একজন মানুষের গন্তব্য তার যাত্রার শুরু দেখেই বুঝতে পারা যায়। কথাটা হয়তো সবার ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য না-ও হতে পারে; কিন্তু, আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ কোনো না কোনোভাবে আমাদের জন্য নির্ধারিত গন্তব্যের পথেই এগিয়ে নিয়ে যায়। আর সে যাত্রা যদি আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটে থাকে, তাহলে সাফল্য সুনিশ্চিত। অনেকসময় আমরা লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পনা করে থাকি, আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দকেই লক্ষ্যে পরিণত করি। ঋতুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দু'ভাবেই ঘটেছিল বললে ভুল বলা হবে না।
তিনি ‘মিউসিওলোজি’ বা ‘প্রদর্শনশালা সংক্রান্ত বিদ্যা’ এবং ‘আর্ট হিস্ট্রি’ বা ‘শিল্পের ইতিহাস’ বিষয়ে ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কের ‘ব্রায়ারক্লিফ কলেজ’ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। আর এই দুই বিষয়েরই প্রতিফলন তার কর্মজীবনে প্রত্যক্ষ করা যায়। ১৯৪৪ সালের ১১ নভেম্বর ঋতু কুমার ভারতের অমৃতসরে জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লীতে বেড়ে ওঠা ঋতু ১৯৬৪ সালে সেখানকার ‘লেডি আরউইন কলেজ’ থেকে স্নাতক পাস করেন। তারপরেই উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
ফ্যাশন জগতে পদার্পণ ও সাফল্য
ফ্যাশন ব্যবসায়ে ঋতুর পদার্পণ ঘটেছিল খুবই অনাড়ম্বরভাবে। মনে রাখতে হবে, তিনি ছিলেন ভারতীয় ফ্যাশন জগতের পথিকৃতদের একজন। তাই তাকে একেবারে শুরু থেকেই শুরু করতে হয়েছিল। ১৯৬০ সালে কোলকাতার কাছে একটি ছোট্ট গ্রামে তিনি মাত্র দু'টি টেবিল ও কয়েকজন ব্লক প্রিন্টারকে নিয়ে তার এই ব্যবসায়ের যাত্রা শুরু করেন। আজ অর্ধ শতকেরও বেশি সময় পরে ভারত ও ভারতের বাইরে ‘ঋতু কুমার’ ব্র্যান্ডের ৯০টিরও বেশি শো-রুম রয়েছে। তার এই ব্র্যান্ডের বদৌলতেই ভারতরে হাজারো হস্তশিল্পীর রোজগারের ব্যবস্থা হচ্ছে এবং লোকজ হস্তশিল্প সংরক্ষণও হচ্ছে।
২০০২ সালে পুত্র অমরিশ কুমারের সাথে অংশীদার ভিত্তিতে তিনি, কনের পোশাক তৈরিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ব্র্যান্ডটির দ্বিতীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘ঋতু কুমার, লেবেল’ গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের পোশাকও একই নীতিতে তৈরি হয়। কিন্তু এর ক্রেতা গোষ্ঠী কিছুটা ভিন্ন। এখানে ভারতের চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও সংস্কৃতিকে আধুনিক যুগের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কিছুটা সমসাময়িক ডিজাইনের পোশাক তৈরি করা হয়।
ঋতুর প্রতিষ্ঠানের মূল পোশাক জারদৌসি কাজে তৈরি, যা অত্যন্ত ভারি ও জমকালো। আর লেবেলের পোশাক তুলনামূলকভাবে কম ভারি ও কম জমকালো এবং ভারতের বাইরে, পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয়।
২০১৯ সালে ‘ঋতু কুমার হোম’ নামে গৃহস্থালীর সাজসজ্জায় ব্যবহৃত কাপড়ের তৈরী পণ্যের একটি নতুন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন ঋতু। লক্ষ্ণৌয়ের সূক্ষ্ম জালি কারুকাজের ‘আওয়াধ’, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার হ্যান্ডপেইন্ট ও ব্লকপ্রিন্টের ‘কলমকারি’, রাজস্থানি বগ্রু ও সঙ্গানের প্রিন্টের ‘বঙ্কু’, কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ ‘জামেভার’ ও কাঁসাসহ মোট ১০টি ভিন্ন ভিন্ন হস্তশিল্পের নকশায় তৈরী মোট ১০টি কালেকশন দিয়ে তিনি এই ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু করেন। এই ব্র্যান্ডের পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টেবিলের কভার, বিছানার চাদর, পর্দা ও গৃহস্থালির সাজসজ্জার অন্যান্য পণ্য।
হস্তশিল্পের সংরক্ষণে অবদান
যেহেতু তার প্রতিষ্ঠানের মূলেই রয়েছে হস্তশিল্প ও এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কারিগরেরা, সুতরাং এই শিল্পের সংরক্ষণে অবদান রাখার বিষয়টা বেশ প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে। এক্ষেত্রে ঋতুর প্রতিষ্ঠানের অবদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতের অনুন্নত স্থানে বসবাসকারী শিল্পীদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করা। ১৯৭০ এর দশকের শুরুতেই তিনি কোলকাতার নিকটবর্তী ‘রানীহাটি’ গ্রামের হস্তশিল্পীদের হাতে তৈরি এমব্রয়ডারি কাজের খোঁজ পান এবং তাদের জন্য নিজস্ব বাসস্থানেই কাজ করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেন।
এছাড়াও মুঘল আমলের প্রসিদ্ধ ‘জারদৌসি’ শিল্পের সংরক্ষণেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার ব্র্যান্ডের মূল পণ্য- কনের পোশাক ও রাতের অনুষ্ঠানের জমকালো পোশাক- তৈরিতে মূলত: দামি ফ্যাব্রিকের ওপরে স্বর্ণের তৈরি সুতোর এমব্রয়ডারি আর স্বকীয় প্যাটার্নের জারদৌসি কাজেরই ব্যবহার হয়ে থাকে। এই জারদৌসির প্রবর্তন হয়েছিল ভোপালের অধিবাসী, পতৌড়ির নবাবের মায়ের কাছ থেকে। ঋতু কুমার জানান, সেই সকল পোশাকের সূক্ষ্ম কারুকার্য তৈরিতে খাঁটি স্বর্ণের ব্যবহার করা হতো।
১৯৯৯ সালে ভারতের বুনন ও নকশা শিল্পের ইতিহাস নিয়ে ঋতু ‘কস্টিউমস্ অ্যান্ড টেক্সটাইলস্ অভ রয়্যাল ইণ্ডিয়া’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। বইটি রচনার জন্য তিনি ভারতের বিভিন্ন রাজপরিবারের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেন। এরই এক পর্যায়ে, ভরতপুরের রাজ পরিবারের ফুশিয়া বা রানী গোলাপ রঙের একটি লেহেঙ্গা তার নজর কাড়ে। হস্তশিল্পের সংরক্ষণে তিনি বিভিন্ন প্রদর্শনীরও আয়োজন করে থাকেন। সেই লেহেঙ্গা নিয়ে ঋতুর ভাষ্য,
"লেহেঙ্গাটি ঐ পরিবারের কোনো মেয়ে কোনো এক সময়ে পরেছিল; আর আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না, সেটা যদি এই ঘরে (মুম্বই- এর একটি আধুনিক হোটেলের কক্ষে) মেলে ধরা হয়, তাহলে সেটা এই পুরো ঘরটিকে ঢেকে ফেলবে। যখন মেয়েটি ঐ লেহেঙ্গাটি পরতো, ১০ জন দাসীকে তা ধরে রাখতে হতো। এতে প্রায় ১৯০টি সরু কলি দেওয়া ছিল, যার প্রতিটি বেনারসে তৈরি হয়েছিল। হয়তো প্রায় ২০টি তাঁতে অন্তত এক বছর ধরে ঐ লেহেঙ্গাটি বানানো হয়েছিল। এটা নিজস্ব মাত্রাতেই একটি বিলাস-দ্রব্য।"
পুরস্কার ও অন্যান্য স্বীকৃতি
ভারতের ফ্যাশন জগৎ ও হস্তশিল্পের সংরক্ষণে অবদান রাখার জন্য ঋতু কুমার বেশ কিছু পুরস্কার ও স্বীকৃতিতে ভূষিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতের ফ্যাশন জগতে স্বকীয় অবদান রাখার জন্য ২০১৩ সালে ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’ অর্জন। ২০১২ সালে ল‘রিয়েল প্যারিস তাকে ‘ফেমিনা উইমেন্স অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ফ্যাশন জগতে অবদানের জন্য তিনি ‘ইন্দিরা গান্ধী প্রিয়দর্শিনী’ পুরস্কারেও ভূষিত হন।
২০০০ সালে ‘কিংফিশার গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ’ তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করে। তার কাজের জন্য ফরাসি সরকার তাকে ‘শেভালিয়ে দে আর্ট এহ দে লেতার্স’ (নাইট অভ দ্য অর্ডার অভ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স) নামক সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৯৮ সালে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দু'টি পুরস্কার লাভ করেন: পিএইচডি চেম্বার অভ কমার্স কর্তৃক প্রদত্ত ‘আউস্ট্যান্ডিং উইম্যান অন্ট্রাপ্রেনর অ্যাওয়ার্ড’ ও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অভ ফ্যাশন কর্তৃক প্রদত্ত ‘আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’।
ভারতীয় ফ্যাশন জগতে প্রথমবারের মতো আধুনিক পাশ্চাত্য বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সমসাময়িক পোশাকের প্রবর্তনকারী, ৭৫ বছর বয়সী ফ্যাশন ডিজাইনার ঋতু কুমারের যাত্রা খুব সাদামাটাভাবে শুরু হলেও তার পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প ও স্বকীয় সৃজনশীলতার কারণে আজও তিনি ভারতীয় ফ্যাশন জগতের অন্যতম কর্ণধার হিসেবে সমাদৃত। শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যই নয়, দেশটির লোকজ হস্তশিল্পের সংরক্ষণেও তিনি দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছেন। তার অর্ধশতকেরও বেশি সময়ের এই কর্মজীবনে তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের পরিমাণ অনেক বেশি।
This Bengali article is written about a famous Indian fashion designer Ritu Kumar. This is based on online research and sources of information have been hyperlinked inside the article.
Featured image: DNA India