রং নিয়ে পাবলো পিকাসো বলেছেন, "আবেগের পরিবর্তনকে অনুসরণ করাই হলো রঙের বৈশিষ্ট্য"। এখন প্রশ্ন হলো- রং কি আসলেই আমাদের মনে কোনো প্রভাব বিস্তার করে? আর যদি করেই, তাহলে তা কীভাবে হয়? কৌতূহলী মনের জেগে ওঠা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়াবো আজকের এই পুরো লেখাটি জুড়ে।
কখনো কি বিশাল নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে মন লেগেছে? আবার হলুদ একটি রুমে থাকা অবস্থায় কখনো কি নিজেকে উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে? কিংবা নীলাভ আভা কি কখনো আপনার মন প্রশান্তিতে পূর্ণ করে দিয়েছে? শিল্পী এবং নকশাকারদের একটি দীর্ঘ বিশ্বাস যে, রং মানুষের মানসিক অবস্থার একটি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। রং মানুষের আবেগ, অনুভূতি, বোধশক্তিতে একটি বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ রংকে যোগাযোগ ও বিভিন্ন ধরনের সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কিছু রং আছে যা রক্তচাপ ও শারীরবৃত্তীয় বিপাক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন ১৬৬৬ সালে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখেন যে, একটি প্রিজম আকৃতির স্বচ্ছ বস্তু, যার মধ্য দিয়ে সাদা আলোকরশ্মি যাবার সময় সাতটি রঙে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন তিনি দেখেন, প্রতিটি রঙেরই আলাদা আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্য রয়েছে। পরবর্তী আরো কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে বিভিন্ন রঙের আলো একসাথে করে আরেকটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি রঙে পরিণত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি লাল আলো ও একটি হলুদ আলোকে একত্রে করলে এর ফলস্বরূপ কমলা রঙের আলো পাওয়া যাবে। আবার সবুজ এবং ম্যাজেন্টাকে একত্র করলে এরা পরস্পরকে বাতিল করে সাদা আলোয় পরিণত হয়।
আমরা হয়তো রঙের এই ব্যবহারগুলো ছবি আঁকার ক্ষেত্রে অনেক প্রয়োগ করে এসেছি। গবেষক মার্কাস মাইয়ার উল্লেখ করেছেন,
"আশ্চর্যজনকভাবে মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারিতার উপর রঙের যে প্রভাব, সেটা নিয়ে আজ অবধি খুবই সামান্য তাত্ত্বিক বা অভিজ্ঞতাবাদী কাজ পরিচালিত হয়েছে, এবং যতটুকু পরীক্ষামূলক কাজ হয়েছে, তা বেশিরভাগ ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে, বৈজ্ঞানিক কঠোরতার দ্বারা নয়"
তবে রং নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাধারণ ঘাটতি থাকলেও রঙের মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারিতা বর্তমানে সবধরনের মার্কেটিং ব্যবস্থার একটি অন্যতম অংশ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে তাদের নকশা ও অন্যান্য জায়গায় রঙের এই মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারিতা খুবই গুরুত্বের সাথে প্রয়োগ করা হয়। কারণ, রং মানুষের মনোভাব, আবেগ, অনুভূতি ও মানসিক অবস্থা এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণেও একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে।
রং সম্পর্কে অনুভূতিগুলো প্রায়ই ব্যক্তিগত, আবার তা নিজের অভিজ্ঞতা বা সংস্কৃতিতে জড়িত। যেমন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সাদা রঙের ব্যবহার দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে। এটি তাদেরকে বিশুদ্ধতা ও সরলতার প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু পূর্বের দেশগুলোতে সাদা একসময় শোকের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
রঙের মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারিতা
রঙের উপলব্ধিগুলো কিছুটা বিষয়ভিত্তিক হলেও কিছু রঙের প্রভাব রয়েছে, যার নির্দিষ্ট সার্বজনীন অর্থ রয়েছে। রং বর্ণালীগুলোর লাল অঞ্চলের রংগুলো উষ্ণ রং হিসেবে পরিচিত এবং এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে লাল, কমলা এবং হলুদ। এই উষ্ণ রংগুলো উষ্ণতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি থেকে শুরু করে রাগ এবং শত্রুতা পর্যন্ত অনুভূতিগুলোকে প্রভাবিত করে। নীল বর্ণালীগুলোর অন্তর্ভুক্ত রং হচ্ছে নীল, গোলাপি ও সবুজ। এগুলোকে শীতল রং হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে এই রংগুলো প্রশান্তির পাশাপাশি মনে উদাসিনতারও ছাপ ফেলতে পারে।
এছাড়াও নির্দিষ্ট রঙের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা হয়। যেমন, লাল রঙের অন্তরালে আছে আবেগ, ভালোবাসা, স্নেহময়তা, উত্তেজনা ও শক্তি। এই রং আমাদের স্নায়ুকোষকে উদ্দীপিত করে এবং মনোযোগ আকর্ষণের জন্য লাল রঙের ব্যবহার আদি থেকে লক্ষ্যনীয়। নীলকে বলা হয় শীতল রং, যা আপনার মনের গভীরে এক প্রশান্তির শীতলতা বহন করে। এ রং আমাদের মস্তিষ্ককে শান্ত রাখে। কেউ কেউ আবার নীলকে বিশ্বস্ততা ও শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে। সবুজ রংটি লাল রঙের বৈশিষ্ট্যের একেবারেই বিপরীতে অবস্থান করে। সবুজ হচ্ছে স্নিগ্ধতা ও প্রশান্তির প্রতীক।
সাদা রংকে পবিত্রতা, নিরপেক্ষতা, সরলতা ও শূন্যতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার কালো রংকে বলা হয় সবচেয়ে রহস্যময়, এই কালোতেই নাকি লুকিয়ে আছে ভয়, উৎকণ্ঠা, আক্ষেপ, মৃত্যু, শোক। অন্যদিকে সংবেদনশীল রং হিসেবে গোলাপিকেই বিবেচনা করা হয়; বলা হয়, ভালোবাসা ও আবেগের এক অপরূপ সংমিশ্রণ নাকি গোলাপিতেই পাওয়া যায়। তবে রঙের এই অর্থগুলো কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে অনেক মনোবিজ্ঞানীর দ্বিমত রয়েছে। কারণ অঞ্চলভেদে রঙের অর্থগুলোর পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়।
থেরাপিতে রঙের ব্যবহার
রংকে থেরাপির কাজেও ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন থেরাপির কাজে রঙের ব্যবহার হয়ে আসছে। মিশরীয় এবং চীনাসহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন সংস্কৃতি ক্রোমোথেরাপি বা নিরাময়ের জন্য রঙের ব্যবহার অনুশীলন করেছিল। ক্রোমোথেরাপিকে কখনও কখনও হালকা থেরাপি বা রংবিজ্ঞান হিসাবে উল্লেখ করা হয়। রঙের এই চিকিৎসা আজও কিছু ক্ষেত্রে বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- লাল রং ব্যবহার করা হয় শরীর ও মনকে উদ্দীপিত করতে এবং শারীরিক সঞ্চালন বৃদ্ধি করতে।
- হলুদ স্নায়ু উদ্দীপনা ও শরীরকে বিশুদ্ধ করে বলে মনে করা হয়।
- কমলা রং ফুসফুসের নিরাময় ও শক্তির মাত্রা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়।
- নীলকে অসুস্থতা প্রশমন ও ব্যথা উপশমে কার্যকর বলে বিশ্বাস করা হয়। এছাড়া হালকা নীল ত্বকের সমস্যা হ্রাস করতে পারে বলে মনে করা হয়। রঙের এই থেরাপি বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানীর কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ বিভিন্ন সংস্কৃতিতে রঙের পৃথক অর্থ রয়েছে।
রঙের মেজাজ পরিবর্তনকারী প্রভাবগুলো কেবলমাত্র অস্থায়ী হতে পারে। একটি নীল কক্ষ প্রাথমিকভাবে শান্ত অনুভূতির কারণ হতে পারে, তবে এ অনুভূতির প্রভাব ক্ষণস্থায়ী, অল্প সময় পরে বিলুপ্ত হয়। তবে রং বিভিন্ন আশ্চর্যজনক উপায়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।
- আরেকটি গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয় যে, নীল বর্ণের স্ট্রিটলাইটগুলো অপরাধ প্রবণতা অন্য যেকোনো উষ্ণ বর্ণের আলো অপেক্ষা অধিক হ্রাস করতে পারে।
- লাল রং মানুষকে আরও বেশি গতি এবং শক্তি সামর্থ্যের প্রতিক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ করে এবং গবেষকদের মতে, অ্যাথলেটিক ক্রিয়াকলাপের সময় লাল রঙের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। লাল রং শরীরের রেসপন্সকে শক্তিশালী করে তোলে, তাই তাৎক্ষণিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সিগন্যাল এ লাল আলোর ব্যবহার হয়।
- কালো বর্ণের ইউনিফর্মগুলোতে বেশি শাস্তি পাওয়ার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির লাভের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। খেলাধুলার একটি ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান থেকে গবেষকরা দেখেন যে, কালো পোশাক পরিহিত এক দল খেলোয়াড় তার বিপরীত দলের সাথে আগ্রাসী ব্যবহারের কারনে দণ্ডিত হয়েছে।
রং শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থায় যে প্রভাব ফেলে
শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তনে রঙের প্রভাব রয়েছে। কোনো শিক্ষার্থীই চায় না তার পরীক্ষায় মার্কশীটে কখনো লাল কালি উঠুক। কিন্তু একটি গবেষণার ফলাফল এটাই দাঁড়ায় যে, কোনো শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষার আগে লাল রং দেখে, তাহলে এটা তার মানসিক অবস্থার এমন পরিবর্তন করে, যা পরে তার পরীক্ষার পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে। পাঠকের কাছে বিষয়গুলো খুবই আজগুবি মনে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ৭১টি কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়।
এতে একটি পাঁচ মিনিটের পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা নেবার পূর্বে শিক্ষার্থীদের একটি দলকে লাল রং, আর অন্য আরেক দলকে সবুজ রঙের কক্ষে কিছু সময়ের জন্য রাখা হয়। পরে তাদের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, যেসব শিক্ষার্থী লাল রঙের কক্ষে ছিল, তারা সবুজ রঙের কক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের থেকে ২০ শতাংশ কম মার্ক পেয়েছে।
এ বিষয় নিয়ে মনোবিজ্ঞানের আগ্রহ বাড়ছে, তবে অনেকগুলো উত্তর না দেওয়া প্রশ্ন এখনও রয়েই গেছে। রং সংঘের বিকাশ কীভাবে হয়? বাস্তব সংস্থার আচরণে এই সংঘগুলোর প্রভাব কতটা শক্তিশালী? রং কি শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বা কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে? ভোক্তাদের আচরণে কোনো রঙের প্রভাব রয়েছে? নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষগুলো কি নির্দিষ্ট কোনো রং পছন্দ করে? সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য, নকশা, এবং পরিকল্পনা বিভাগের অনুষদীয় সদস্য জেনা ও'কনর পরামর্শ দিয়েছেন,
রঙের মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে লোকেরা যে সমস্ত দাবি রাখেন, সে সম্পর্কে তাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এবং এই দাবিগুলোর মধ্যে অনেকের অনুগত অভিজ্ঞতা হিসাবে পদক্ষেপের অভাব রয়েছে, দাবিগুলো সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করার পূর্বে এগুলোর বৈধতা যাচাই করা উচিত।
This is a Bangla article. This is about color spectrum and the effects of different colors on our mental state.
References:
1. Color Psychology: Does It Affect How You Feel?
2. Color Psychology: How Color Meanings Affect Your Brand
3. Psychological Properties Of Colours
Featured Image: Wikimedia Commons